—প্রতীকী ছবি।
ফালাকাটা শহরের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে জাতীয় সড়ক। জুলাইয়ের এক বিকেলে সেই সদা-ব্যস্ত সড়কের ধারে বসে কথা হচ্ছিল জনৈক ‘তৃণমূল কর্মী’র সঙ্গে। ২০১৯ সাল। কিছু দিন আগে লোকসভা ভোট হয়েছে। উত্তরবঙ্গে তৃণমূল সব হারিয়ে শূন্য। দক্ষিণেও একাধিক আসন পেয়েছে বিজেপি। চায়ে চুমুক দিতে দিতে তখনও তাই নিয়ে তুমুল আলোচনা। ভদ্রলোক বললেন, “এত দিন তৃণমূল করতাম। কিন্তু ২০১৮ সালে ভোটটাই দিতে পারিনি। পরিবারসমেত বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল। তখনই ঠিক করি, এর শোধ নেব।” কী ভাবে? বললেন, “লোকসভায় (২০১৯) উল্টো দিকে ভোট দিয়েছি। বিধানসভাতেও (২০২১) তাই দেব। তার পরে একেবারে পরের পঞ্চায়েতে (২০২৩) উল্টো দিকে ছাপ দিয়ে তবে সাধ পূরণ হবে।”
২০১৮ সালে পঞ্চায়েত ভোটে এ শুধু ফালাকাটার কথা নয়, রাজ্যের প্রায় সর্বত্রই কমবেশি এমন দৃশ্য দেখা গিয়েছে। কোথাও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শাসক দলের জয়, কোথাও ভোট-বাক্স হিঁচড়ে নিয়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে পাশের ডোবায়। কোথাও আবার হামাগুড়ি দিয়েছে পুলিশ, মাটিতে গড়িয়েছে তার ইনসাস রাইফেল। প্রাণ গিয়েছে বেশ কয়েক জনের। পরিসংখ্যান বলছে, সেই ভোটে ৩৪ শতাংশ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছে তৃণমূল। বিরোধীদের অভিযোগ এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান এক জায়গায় করলে মনে হবে, গ্রামবাংলার বহু জায়গায় ভোটটাই হয়েছে ‘নাম কা ওয়াস্তে’। বহু এলাকা থেকে রিগিং, সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলেছেন বিরোধীরা। সংবাদমাধ্যমের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ভোটের দিন পর্যন্ত মোট ২৯ জনের মৃত্যু হয়েছে নির্বাচনকেন্দ্রিক হানাহানিতে। তার মধ্যে ভোটের দিন পাঁচটি জেলা মিলিয়ে মোট ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি বিরোধীদের।
এমন একটি ভোটের ছাপ কি পড়বে না এক বছর পরে লোকসভা ভোটে? পড়েছে। সেটাই জানিয়ে গেলেন ফালাকাটার ওই বাসিন্দা। গত কুড়ি বছরের পঞ্চায়েত ভোট-চিত্র যদি খুঁটিয়ে দেখা যায়, তা হলে অবশ্য স্পষ্ট হবে যে, শুধু ২০১৮-র ক্ষেত্রেই নয়, প্রতি বারই এই গ্রামীণ নির্বাচন পরের বছরের লোকসভা ভোটের দিকনির্দেশক হয়েছে। ২০০৩ সালের কথাই ধরা যাক। স্মরণকালের মধ্যে সব থেকে বেশি রক্তাক্ত হয়েছিল ২০০৩ সালের পঞ্চায়েত ভোট। সে বারে ভোটের দিন গোটা রাজ্যে মোট ৭৫ জন মারা গিয়েছিলেন। তার মধ্যে শুধু মুর্শিদাবাদেই ৪৫ জন। তৎকালীন শাসক দল সিপিএমের দাবি ছিল, তাদের সমর্থকেরাই সব থেকে বেশি প্রাণ হারিয়েছেন। ঘটনা হল, ২০০৩ সালে সিপিএম সবচেয়ে বেশি প্রতিরোধের মুখে পড়েছিল মুর্শিদাবাদেই। বাকি রাজ্যে তাদের দাপট ছিল একচেটিয়া। এর এক বছর পরে লোকসভা ভোটে তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল তৃণমূল পেয়েছিল মাত্র একটি আসন। বিজেপির কিছু পাওয়ার প্রশ্নই ছিল না।
ঠিক পাঁচ বছর পরে রাজ্যের পঞ্চায়েত ভোটটি ছিল সব দিক থেকেই দিকনির্দেশক। ২০০৮ সালের সেই ভোটের আগেই আমেরিকার সঙ্গে পরমাণু চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে মনমোহন সিংহের ইউপিএ সরকারের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেন সিপিএমের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট। এই দ্বন্দ্বের প্রভাব পড়ে পশ্চিমবঙ্গেও। পঞ্চায়েত ভোটের ক্ষেত্রে তৃণমূল স্তরে কিছু নিজস্ব জোটবন্ধন সব সময় হয়েই থাকে। কংগ্রেসের সঙ্গে বিজেপি বা সিপিএমের সঙ্গে তৃণমূল হাত মিলিয়ে অক্লেশে পঞ্চায়েত দখল করতে পারে।
২০০৮ সালে অবশ্য রাজ্য স্তরে কোনও জোট হয়নি। তবে কংগ্রেস ও তৃণমূল যে একজোট হলে বামেদের সরকার থেকে সরাতে পারবে, তা মনে হতে শুরু করে সে বারের গ্রাম পঞ্চায়েতের ফল দেখার পরে। কেন্দ্রে তত দিনে কংগ্রেসের পাশে দাঁড়িয়েছে তৃণমূল। রাজ্যে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামে আন্দোলনের চাকা গড়াতে শুরু করেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পুরোদস্তুর জমি আন্দোলনে নেমে পড়েছেন। ফলে, সে বারের পঞ্চায়েত ভোটে আনুষ্ঠানিক জোট না হলেও তৃণমূল স্তরে দুই দলের মধ্যে সমঝোতা হয় ভাল মতোই। তার ফলও মেলে হাতেনাতে। দেখা যায়, পঞ্চায়েত আসনের ৫২.৩ শতাংশ পায় বামফ্রন্ট। আর সব বিরোধী মিলে জিতে নেয় ৪৭.৭ শতাংশ আসন। সে বারই প্রথম সিপিএমের একার আসন (৪৫.৮৮%) সমগ্র বিরোধী আসনের থেকে কমে যায়। প্রায় একই চিত্র ছিল পঞ্চায়েত সমিতির ক্ষেত্রেও। তবে জেলা পরিষদ দখলের ক্ষেত্রে সিপিএম নিজেদের শক্তির পরিচয় রাখতে পেরেছিল।
২০০৮ সালের ভোটেও হিংসা হয়েছে। কিন্তু বিরোধীরা একজোট হলে, সিপিএম তথা বামফ্রন্টের একেবারে নিচুতলার জনভিত্তি যে জোর ধাক্কা খেতে পারে, সেই প্রথম বোঝা গিয়েছিল। ফল, এক বছর পরে লোকসভা নির্বাচনে জোট করে লড়াই কংগ্রেস ও তৃণমূলের। বাম পতনের ছবিটা আরও স্পষ্ট হয়েছিল। যা ২০১১-তে চূড়ান্ত রূপ পায়।
তৃণমূল জমানায় প্রথম পঞ্চায়েত ভোট ২০১৩ সালে। সে বারে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডে দেখিয়েছিলেন, কী ভাবে শক্ত হাতে গ্রামের ভোট করাতে হয়। ৮০০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে পাঁচ দফায় ভোট করিয়েছিলেন তিনি। তবে সদ্য দু’বছর আগে রাজ্যে ক্ষমতা দখল করা তৃণমূলের দিকে তখনও পাল্লা ভারী। শাসক দলের সেই একই জনপ্রিয়তা বজায় ছিল ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটেও। গোল বাধল ২০১৮ সালে এসে। তত দিনে সারদা কেলেঙ্কারি, নারদ কাণ্ড সামনে এসে গিয়েছে। বিজেপি শক্তি বাড়াতে শুরু করেছে রাজ্যে। এই পরিস্থিতিতে গ্রামের দখল নিজেদের হাতে রাখতে মরিয়া হয়ে ঝাঁপিয়েছিল তৃণমূল। মারপিট, প্রাণহানি, রিগিং, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়— সব ছবিই পরের পর স্লাইড শো-এর মতো সামনে চলে আসে। বস্তুত, ২০১৬ সালে বিধানসভা ভোটে জেতার পর থেকেই গ্রামে নিজেদের দখল কায়েম করতে উঠেপড়ে লাগে তৃণমূল। গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে জেলা পরিষদ— সব ক্ষেত্রেই দলবদল করিয়ে দখলের অভিযোগ ওঠে বিরোধীদের দিক থেকে। তবে সেটা সম্ভবত চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছয় ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটে।
বছর ঘুরতে না ঘুরতেই এর ফল পেয়েছিল তৃণমূল। লোকসভা ভোটে বিপুল পরিমাণ ভূমিক্ষয়, উত্তরবঙ্গ থেকে মুছে যাওয়া, সিঙ্গুর তো বটেই, জঙ্গলমহলেরও একাংশে অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়তে হয় রাজ্যের শাসক দলকে। ফালাকাটার সেই তৃণমূল সমর্থক ছাপোষা মানুষটির ‘মন কি বাত’ যে রাজ্যের অনেকেরই অন্তরে লুকোনো ছিল, সেটা ভোট দেওয়ার প্রথম সুযোগেই দেখিয়ে দিয়েছে রাজ্যের মানুষ।নিশ্চয়ই এই সব রাজনৈতিক ওঠাপড়ার পিছনে আরও একাধিক কারণ থাকে। যেমন, ২০১৯ সালে নরেন্দ্র মোদীর ভাবমূর্তিও বিজেপির ভোট-বাক্স মজবুত করতে বড় ভূমিকা নিয়েছে। তবে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তৃণমূলের প্রতি বিরাগ। যে বিরাগ তৈরি হয়েছিল ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটে।
দু’দশকের এই ‘ধারা’ কি এ বারেও দেখা যাবে? এ বারের পঞ্চায়েত ভোট এমন একটা সময়ে হতে চলেছে, যখন শাসক দল তৃণমূল একাধিক দুর্নীতি মামলায় জেরবার। এক জন মন্ত্রী, একাধিক বিধায়ক, এক জন দোর্দণ্ডপ্রতাপ জেলা সভাপতি বিচারাধীন বন্দি। দলের সাংগঠনিক দায়িত্ব যাঁর কাঁধে, তাঁকেও বার বার তলব করছে কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলি। এ সবের প্রভাব কি গ্রামের ভোটে পড়বে?
যদি না পড়ে, তা হলে ভোট কিসের নিরিখে হবে? আবাস বা একশো দিনে কাজের টাকা কেন আসছে না— সেই প্রশ্নের উপরে ভিত্তি করে? এ বারের ভোটযুদ্ধ ত্রিমুখী হওয়ারই সম্ভাবনা। শাসকের বিপরীতে এক দিকে বিজেপি, অন্য দিকে বাম-কংগ্রেস জোট। তবে নিচুতলায় জোটে সাগরদিঘির রং যেমন লাগতে পারে, তেমনই লাগতে পারে নন্দকুমার মডেলের (যেখানে সমবায় সমিতিতে বাম, কংগ্রেস ও বিজেপি সমর্থকেরা এক ছাতার তলায় জড়ো হয়েছিলেন) রং। দলীয় ভাবে না হলেও সমর্থকদের মধ্যে এককাট্টা হওয়ার প্রবণতা দেখা দিতে পারে। যে কারণে, ২০১৯ এবং ২০২১ সালে বামেদের ভোটের বড় অংশ বিজেপির বাক্সে গিয়েছিল। এমন কিছু ঘটলে তা অবশ্যই আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের দিকনির্দেশক হতে পারে।
তাই ১১ জুলাই, পঞ্চায়েত ভোটের গণনার দিনটি এখন রাজ্য রাজনীতিতে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy