Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
Business

ছোট জৈব ব্যবসার গল্পটা

জৈব জিনিসের ব্যবসা যাঁরা করেন, তাঁরা সবাই সাধারণ ব্যবসা করলেও অনেকেই কিন্তু একটা বৃহত্তর ভাবনার জায়গা থেকে এই কাজে যুক্ত হচ্ছেন।

গত দশকে কিছু ছোট ব্যবসা গড়ে উঠেছে।

গত দশকে কিছু ছোট ব্যবসা গড়ে উঠেছে। ফাইল চিত্র।

অপরাজিতা সেনগুপ্ত
শেষ আপডেট: ১৮ জানুয়ারি ২০২৩ ০৬:২৯
Share: Save:

খাদ্যে বিষের পরিমাণ নিয়ে সচেতন ক্রেতা এখন বিষহীন খাদ্যের সন্ধান করছেন শহরে। সেই চাহিদা পূরণ করতে গত দশকে কিছু ছোট ব্যবসা গড়ে উঠেছে। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ খাদ্য উৎপাদনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত, কেউ বা আবার উৎপাদকদের থেকে নানান সামগ্রী কিনে ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। এ রকম ছোট ব্যবসায়ীরা কেমন আছেন? জৈব জিনিসের দাম সাধারণ বাজার চলতি আনাজ বা চাল-ডালের চেয়ে বেশি বলেই কি তাঁরা সবাই ফুলেফেঁপে উঠছেন? প্যাকেটের বিস্কুট বা সিম কার্ড বিক্রি না করে তাঁরা আদৌ জৈব জিনিসের ব্যবসা করছেনই বা কেন, যখন বাজারে প্রচুর বড় কোম্পানির জৈব জিনিস এসেই পড়েছে?

জৈব জিনিসের ব্যবসা যাঁরা করেন, তাঁরা সবাই সাধারণ ব্যবসা করলেও অনেকেই কিন্তু একটা বৃহত্তর ভাবনার জায়গা থেকে এই কাজে যুক্ত হচ্ছেন। প্রথম ভাবনা খুব স্বার্থপর। আমাদের সন্তানকে আমরা কী খাওয়াচ্ছি? বিষে ভরা আনাজ, বিষাক্ত প্যাকেট-জাত সমস্ত খাবার? হরমোন এবং অ্যান্টিবায়োটিক যুক্ত মাছ মাংস ডিম? আছে পরিবেশ নিয়ে চিন্তাও; বর্তমান ব্যবস্থায় কৃষিক্ষেত্রে সমস্ত প্রাণকে ধ্বংস করাই প্রগতির একমাত্র পথ হিসেবে দেখা হচ্ছে গত বছর পঞ্চাশ (যদিও কৃষির ইতিহাস ১০ হাজার বছরের)। সে ব্যবস্থাকে স্বাভাবিক এবং প্রয়োজনীয় মনে করা হচ্ছে কেন? রাসায়নিক বিষ না দিলে আদৌ কৃষিকাজ হবেই না, এই ভ্রান্ত ধারণার বিপরীতে দাঁড়িয়ে সুস্থায়ী খাদ্য ব্যবস্থার বণ্টনে যুক্ত হওয়াও ছোট ও আঞ্চলিক জৈব খাদ্যের ব্যবসায়ীদের একটি রাজনৈতিক অবস্থান।

কিন্তু অবস্থান দিয়ে তো ব্যবসা চলে না। বহু সমস্যার সম্মুখীন আজ এ রকম ছোট ব্যবসায়ীরা। প্রথম অভিযোগ, তাঁরা প্রচুর দাম নিচ্ছেন। বাজার চলতি অর্থনীতির নিরিখে ঢালাও উৎপাদন এবং ঢালাও বিতরণই হল ব্যবসার সারমর্ম। তেল পুড়িয়ে অর্থহীন চালানি, যে কোনও অবস্থায় প্রচুর উৎপাদন চালু রাখা, এবং অর্থকরী ভাবনা যাতে সর্বতো ভাবে পরিবেশমুখী ধারণাকে ছাপিয়ে যায়, সেটাই আজকের অর্থনীতির দস্তুর। অথচ জৈব এবং আঞ্চলিক সামগ্রী সারা বছর একই ভাবে বাজারজাত করা সম্ভব না (পরিবেশের স্বার্থে করা উচিতও না)। সঠিক ভাবে উৎপন্ন করা জৈব জিনিসের পরিমাণ সীমিত (জৈব চাষিরা সংখ্যায় কম), এবং তা বহন করে আনার খরচ বেশি। এ ছাড়াও, সঠিক পদ্ধতিতে উৎপন্ন জৈব জিনিস অনেক সময় বাজারচলতি সামগ্রী হিসেবে আপনি যা খেতে অভ্যস্ত, সেই জিনিসটিই নয়। বাজারচলতি সস বা জ্যামে যেমন ফ্রুট-বেস বলে পেঁপে ব্যবহার করাটা দস্তুর, এবং আইনসিদ্ধ, কারণ পেঁপে ফল তো বটেই। জৈব চাষি যখন ৯০ শতাংশ আসল ফল দিয়ে জ্যাম বা সস বানাচ্ছেন, সেটা নামে এক হলেও আদতে অন্য একটি বস্তু। আশ্চর্যের ব্যাপার হল ইলেকট্রনিক সামগ্রী বা ব্র্যান্ডের জামাকাপড়ের জন্য যে দাম মধ্য বা উচ্চবিত্ত ক্রেতা বিনাবাক্যে দিতে রাজি থাকেন, জৈব খাদ্যের জন্য সে ছাড় নেই। সস্তার খাবারে বিষের সঙ্গে মিশে থাকে চাষির অনেকটা পরিশ্রম, বিশেষ করে গ্রামীণ নারীদের অনেক পারিশ্রমিকবিহীন শ্রম। ধান থেকে চাল হতে যে অস্বাভাবিক, হাড়ভাঙা পরিশ্রম, তার অনেকগুলি ধাপের দাম দেওয়াই হয় না সস্তার চাল তৈরি করতে গিয়ে। জৈব জিনিসের দাম বেশি হলে তা হলে কি গরিব মানুষের তাতে অধিকার নেই? নিশ্চয়ই আছে, এমনকি গ্রামের মানুষদের হাতের কাছে জৈব আনাজ এখনও অনেক আছে। বিষবিহীন খাদ্যে সবার অধিকার, যেমন অধিকার সঠিক পারিশ্রমিকের, ফলে সচেতন ভাবে উৎপন্ন জৈব খাদ্য উৎপাদনে আরও অনেক চাষি যুক্ত হলে, এবং এ সব সামগ্রী সঠিক বাজার পেলেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব।

বড় বড় জৈব কোম্পানি এ সব সমস্যার সম্মুখীন হয় না। যেখান থেকে ইচ্ছে কিনে, যেমন ইচ্ছে প্লাস্টিক মুড়ে, যত দূর ইচ্ছে পাঠিয়ে, মরসুম বা মাটির স্বাস্থ্য বা জলস্তর নিয়ে একদম মাথা না ঘামিয়ে, স্বল্প মাইনেয় বাইক-আরোহী ডেলিভারি বাহিনী রেখে ঢালাও ব্যবসা করলে সমস্যা কম। ব্র্যান্ড বড় হলে, মানুষ দাম নিয়েও মাথা ঘামান না, বা আদৌ জৈব কি না, সেটা নিয়েও না। এ সব দায় শুধু ছোট ব্যবসার। ইদানীং প্লাস্টিকে ডুবে যাওয়া শহরের রূপ, পুড়তে থাকা প্লাস্টিকের স্তূপ দেখে প্লাস্টিকবিহীন প্যাকেজিং নিয়েও মাথা ঘামাচ্ছেন ছোট ব্যবসায়ী কেউ কেউ। সঙ্গে এটাও চিন্তা, এর ফলে যে দামটুকু বাড়বে, সেটা দিতে ক্রেতা রাজি হবেন তো? না কি তাঁকে বুঝিয়ে বলতে হবে যে, কাল আপনার সন্তান যাতে এই শহরের হাওয়ায় নিঃশ্বাস নিতে পারে, তাই আজ অনেক সমস্যা সত্ত্বেও আপনাকে প্লাস্টিকের বদলে কাচ, কাগজ বা কার্ডবোর্ড দেওয়ার চেষ্টা করছি?

ছোট ছোট বহু কাজ। উৎপন্ন করা থেকে প্যাকেজিং, লেবেল তৈরি থেকে কম খরচে শহরে নিয়ে আসা পর্যন্ত, জৈব চাষের সঙ্গে যুক্ত পরিবারগুলিকে করে যেতে হয়। তার খুঁটিনাটি হিসেব অনেক সময়েই তাঁরা করে ওঠেন না। রোজগার ঈর্ষাযোগ্য না হলেও তার সঙ্গে নানান গঞ্জনা কুড়িয়ে এগিয়ে যেতে হয়। কাজ চালিয়ে যেতে হয়, কারণ আরও হাজার ব্যবসা ছেড়ে জৈব চাষ ও ব্যবসায় আসার পিছনে আছে দূষণবিহীন পৃথিবী ও বিষবিহীন পরিবেশের ক্রমশ অসম্ভব হতে থাকা একটা স্বপ্ন।

খাদ্য আমাদের জীবনের প্রাথমিক প্রয়োজনগুলির একটি; ভবিষ্যতের ভাতের থালা এবং নিঃশ্বাস নেওয়ার বাতাস বিষমুক্ত রাখার জন্য ক্ষুদ্র, আঞ্চলিক, মরসুমি এবং জৈব উৎপাদকদের স্বপ্নে আরও অনেককে যুক্ত হতে হবে।

অন্য বিষয়গুলি:

Business Organic
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy