জুনের পাঁচ তারিখ দুষ্কৃতীদের হাতে নিগৃহীত হন বৃদ্ধ আবদুল সামাদ সইফি। অভিযোগ, মারধর ও প্রাণনাশের হুমকির সঙ্গে তাঁকে দিয়ে ‘জয় শ্রীরাম’ ও ‘বন্দে মাতরম্’ বলানো হয়, ‘পাকিস্তানের চর’ বলে দাড়ি কেটে নেওয়া হয়। দু’দিন পরে তিনি এফআইআর করেন। দিন সাতেক বাদে তা সংবাদে প্রকাশিত হয়, নিগ্রহের ভিডিয়ো সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হয়। ১৪ তারিখ তিন জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরের দিনই নিগ্রহের খবর, ভিডিয়ো ও সইফির জবানবন্দি টুইট করার অভিযোগে কিছু লেখক, সাংবাদিক, কংগ্রেস কর্মী, সংবাদমাধ্যম ও টুইটার কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ। ভারতীয় দণ্ডবিধির এই ধারাগুলি হল ১৫৩ (দাঙ্গায় উস্কানি), ১৫৩এ (দুই গোষ্ঠীর মধ্যে হিংসায় উস্কানি), ২৯৫এ (ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত), ৫০৫ (অপরাধ), ১২০বি (অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র) ইত্যাদি।
তদন্তের আগেই পুলিশ জানায়, এখানে সাম্প্রদায়িক রং লাগানোর চেষ্টা হচ্ছে, যদিও তা ব্যক্তিগত শত্রুতার ফল। বেআইনি মদ ও মাফিয়া সংযোগ প্রকাশ্যে আনা সাংবাদিক সুলভ শ্রীবাস্তবের রহস্য মৃত্যুতেও তদন্তের আগে দুর্ঘটনার তত্ত্ব সামনে আনে পুলিশ। যদিও মৃত্যুর আগের দিন লিখিত ভাবে জীবনহানির শঙ্কা পুলিশ সুপারকে জানান সুলভ। যে পুলিশ সত্যসন্ধানী সাংবাদিকের জীবন রক্ষা করতে ব্যর্থ, সেই পুলিশ কাঠগড়ায় তুলছে সংবাদমাধ্যমকে! সবচেয়ে উদ্বেগের কথা, প্রশ্ন তোলার মঞ্চ হিসেবে সমাজমাধ্যমও আর নিরাপদ নয়। মাসখানেক আগে টুইটার জানায়, ভারতে কর্মীদের নিরাপত্তা ও ব্যবহারকারীদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর সম্ভাব্য আক্রমণের আশঙ্কায় তারা উদ্বিগ্ন। তার দু’দিন আগেই টুইটারের দিল্লি ও গুরুগ্রামের অফিসে হানা দিয়েছিল দিল্লি পুলিশ। ভারতে সমাজমাধ্যমের অফিসে এমন অভিযান প্রথম।
বৈদ্যুতিন সমাজমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে ২৫ ফেব্রুয়ারি আইন চালু করে কেন্দ্র। বলা হয়, ৫০ লক্ষের বেশি গ্রাহক থাকা সমাজমাধ্যমকে তথ্যের উৎপত্তি থেকে গন্তব্য অবধি সব পর্যায়ে সব গ্রাহকের তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে হবে, প্রয়োজনে প্রশাসনকে তথ্য জানাতে তারা বাধ্য। প্রযুক্তিকে আধুনিক করতে হবে, যাতে ‘ভেরিফায়েড ইউজ়ার’-কে সহজে চেনা যায়, স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে উপযুক্ত কারণ-সহ আপত্তিকর পোস্ট ও অ্যাকাউন্ট বন্ধ করা যায়। গ্রাহকদের অভিযোগ যাতে দ্রুততা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে নিষ্পত্তি হয়, তাই এ দেশে একটি অফিস থাকাও আবশ্যক। এ কাজে নিযুক্ত তিন অফিসারকে ভারতের নাগরিক ও স্থায়ী বাসিন্দা হতে হবে। কোনও সমাজমাধ্যম নীতি লঙ্ঘন করলে তা ‘সমাজমাধ্যম’ হিসেবে গণ্য হবে না। সরকারের বক্তব্য, গুজব, ফেক নিউজ় ও হিংসা ছড়ানো বন্ধ করতে এবং গ্রাহক সুরক্ষা নিশ্চিত করতেই এই উদ্যোগ। তা নিঃসন্দেহে মহৎ। কিন্তু পরিকল্পনা ও রূপায়ণের মধ্যে কখনও ফাঁক থেকে যায়।
আশঙ্কার কারণ দুটো। এক, নাগরিকের মতপ্রকাশের অধিকারের সঙ্কোচন। দুই, ব্যক্তিগত তথ্য ও গোপনীয়তা হারানোর ভয়। এ কারণেই এ নিয়মে আপত্তি হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটারের। হোয়াটসঅ্যাপ তা মানলেও টুইটার জানিয়েছে, তারা তা মেনে চলার চেষ্টা করলেও স্বচ্ছতা ও বহুস্বরকে তুলে ধরতে সচেষ্ট থাকবে। গ্রাহকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বা গোপনীয়তা রক্ষার অধিকারের প্রশ্নে আপসে তারা নারাজ। গ্রাহকের সুরক্ষা অথবা ভুয়ো খবর নিয়ন্ত্রণে তারা নিজস্ব আন্তর্জাতিক মাপকাঠি অনুসারেই চলবে। অতএব, সরকারের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু। লড়াই আদালত অবধি পৌঁছলে ‘তথ্যপ্রযুক্তি আইন, ২০০০’-এর ৭৯ ধারার বলে সমাজমাধ্যম হিসেবে তারা যে আইনি রক্ষাকবচ পেত, তা আর থাকবে না। নয়া নীতি লঙ্ঘনে কার্যত তারা ‘সমাজমাধ্যম’-এর তকমাই হারিয়েছে।
প্রশ্ন হল, ভারতে সমাজমাধ্যমের বিপুলসংখ্যক গ্রাহকের প্রতিটি বার্তার রেকর্ড কী ভাবে রাখা সম্ভব, যখন একই বার্তা অসংখ্য বার আলাদা অ্যাকাউন্ট থেকে শেয়ার করা হয়? আরও জরুরি কথা, ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষা সংবিধান-স্বীকৃত অধিকার। সাংবাদিক ও প্রতিবাদীদের ক্ষেত্রে তা আরও ভয়ের। গোপনীয়তা তাঁদের সামাজিক সুরক্ষার সঙ্গে জড়িত। নয়া নিয়মে প্রতিবাদী স্বরকে যে ‘গুজব’ বা ‘হিংসা’য় অভিযুক্ত করা হবে না, তা জোর দিয়ে বলা যায়? দিল্লির এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার রিপোর্ট বলছে, ২০২০-র ২৫ মার্চ থেকে ৩১ মে-র মধ্যে লকডাউন চলাকালীন ৫৫ জন সাংবাদিককে গ্রেফতারি, এফআইআর, সমন, শো-কজ়, নিগ্রহের মুখে পড়তে হয়েছে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীন ভাবে কাজ করার প্রশ্নে ১৮২টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান নামতে নামতে এ বছর ১৪২। দিল্লি হাই কোর্টে এই নিয়ম প্রত্যাহারের আবেদন জানিয়েছে হোয়াটসঅ্যাপ। টুইটার আইনি পথে হাঁটবে না— এমন নিশ্চয়তা নেই।
আশার কথা, প্রতিবাদী স্বরও সহজে দমার নয়। ‘দেশদ্রোহ’-এ অভিযুক্ত দেবাঙ্গনা কলিতারা জেল থেকে বেরিয়েও লড়াই জারি রাখার শপথ করেছেন। সময়ের দাবি যে চুপ করে থাকার নয়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy