—প্রতীকী ছবি।
এ দেশে সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু সমস্যা মূলত রাজনৈতিক। অনেক অন্য বিষয়ের মতো এই সমস্যাটির ভিতরেও ভাল-মন্দ এক সঙ্গে থাকে। বৃহত্তর পরিবেশে যে সমস্যা নিয়ে দেশ তোলপাড় হয়, তার চেয়েও প্রাসঙ্গিক সমস্যা আমাদের চোখ এড়িয়ে যায় কাছেপিঠে। সে সব সমস্যা থেকেই জাতির সমস্যা তৈরি হয়, রাজনৈতিক ঘোঁট পাকানো সহজ হয়।
ক্ষুদ্রতর পরিসরে দৈনন্দিন সমস্যা কী ভাবে কৌমজনিত সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়, সেটা বোঝা শক্ত নয়। কিন্তু ব্যক্তিসমস্যা যত ক্ষণ বলার মতো সাম্প্রদায়িক সমস্যা না হচ্ছে, তত ক্ষণ এগুলো ব্যক্তিস্তরে অনেক দুঃখ-কষ্টের সৃষ্টি করলেও রাজনীতির তাতে টনক নড়ে না। সারা বিশ্বেই সমস্যা ধামাচাপা দেওয়াটাই রাজনীতির মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়। অনেকে ভাবতে পারেন, এটা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র— ব্যাপারটা মোটেই তা নয়। আসলে রাজনৈতিক-স্বার্থ ব্যক্তি-স্বার্থের মতোই গুরুত্বপূর্ণ বা তার চেয়েও বেশি। তাই শান্তিতে শাসন করার সুযোগ থাকলে রাজনীতি সেই চেষ্টা করবেই। আমাদের কাছে সাম্প্রদায়িক সহাবস্থান মেলবন্ধন, পারস্পরিক সহানুভূতি, শ্রদ্ধা, এগুলোই বিচার্য বিষয়। কিন্তু সাধারণ আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যা থেকে অন্তঃসলিলা যাত্রা করার মতো এই সমস্যা যে রাজনীতির পথে বিশাল অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়, সে কথাটি অনেকেই মানতে চান না।
পৃথিবীতে এমন কোনও ইতিহাস নেই যেখানে সার্বিক ভাবে না হলেও সমাজ ও জীবনের ক্ষুদ্রতর পরিসরে সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘুকে খানিকটা অত্যাচার করে না, বিরক্ত করে না। তবে সব ক্ষেত্রে তা বৃহত্তর সামাজিক বাতাবরণকে তেমন কলুষিত করে না। আসলে সার্বিক ভাবে না দেখে, ক্ষুদ্রতর পরিসরে কে সংখ্যাগুরু কে সংখ্যালঘু, সেটা ভাল করে বোঝা উচিত। আমরা শুধু বৃহত্তর পরিসরে এই সহাবস্থানের সমস্যাটি নিয়ে মাথা ঘামালে ক্ষুদ্রতর পরিসরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবমাননা হতে বাধ্য। কে সংখ্যালঘু, কে সংখ্যাগুরু সেটা ব্যক্তিস্তরে, পারিবারিক স্তরেও একটি আঞ্চলিক সমস্যা। কিন্তু এই সমস্যার ঠিকমতো সমাধান না হলে, প্রতিকূল রাজনীতির স্রোত ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে। ক্ষুদ্রতর পরিসরের সমস্যা বিচ্ছিন্ন সমস্যা, অনেক জায়গাতেই। সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘুর সংজ্ঞাটি সার্বিক, জাতীয় তথ্যভিত্তিক এবং আইনশৃঙ্খলা সমস্যাও পরিমিত। ফলে ধরে নেওয়া হয় যে, সব জায়গায় ওই জাতিভিত্তিক জাতীয় সমস্যাটিই সমস্যা। এমনটা জনগণকে বোঝানো, তাদের খানিকটা ফাঁকি দেওয়া। যে-হেতু ক্ষুদ্রতর পরিসর শাসনযন্ত্রের উচিত আইনশৃঙ্খলা সমস্যাকে সামাল দেওয়া, আঞ্চলিক শাসনযন্ত্রের ব্যবহার অনেক বাড়ানো উচিত সেখানে। সংখ্যাগুরু কিংবা সংখ্যালঘু ভোটকে কুক্ষিগত করার জন্য স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা সমস্যাকে এড়িয়ে যাওয়া অতীব বিপজ্জনক।
জাতীয় স্তরে সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু সমস্যা নিঃসন্দেহে দেশ, রাজ্য, জাতির পক্ষে, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের পক্ষে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। সবাইকে সমান ভাবে সঙ্গে নিয়ে এগোনোর আদর্শের মাহাত্ম্য বারে বারে মনে করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন অপরিসীম। কিন্তু ক্ষুদ্রতর পরিসরে সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু চিহ্নিত করে সেখানে শাসনতান্ত্রিক হস্তক্ষেপের প্রয়োজন। ক্ষুদ্রতর পরিসরে শোষণ এবং সংগ্রামের ইতিহাস জটিল ও বিপজ্জনক। কারণ তাকে সবাই চোখে দেখতে পান না। কেউ সেই দেখাকে গুরুত্ব দেন না। পরিবারের মধ্যে, ব্যক্তিসম্পর্কের মধ্যে, দলের মধ্যে এই প্রবণতা দেখে দেখে বড় হই আমরা সর্বত্র। কিন্তু যখনই সম্প্রদায়ের প্রসঙ্গ এসে পড়ে তখনই রাজনৈতিক-স্বার্থ বুঝে শাসনযন্ত্র এগোয় বা পিছোয়।
তাত্ত্বিক দিক দিয়ে দেখতে গেলে, ঐতিহাসিক ভাবে সব জায়গায় সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘুর অনুপাত জাতীয় স্তরের অনুপাতের মতো হলে এ দেশটা নিঃসন্দেহে অন্য রকম হত— তবে সেটা মোটেই কাম্য হত না। সংখ্যালঘুরা কিছু জায়গায় সংখ্যাগুরু হলে সেই জনশক্তি আঞ্চলিক রাজনীতিকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করে তাদের সমস্যা এবং দাবিদাওয়ার ব্যাপারে খানিকটা সরব হতে পারে, জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারে। ফলে জাতীয় স্তরে একটা আওয়াজ তুলতে পারে। পশ্চিমবঙ্গ তার একটি উদাহরণ। জাতীয় স্তরে যে গোষ্ঠী সংখ্যাগুরু, আঞ্চলিক স্তরেও যদি একই অনুপাতে তারা প্রাধান্য পায়, তখন এক ধরনের সম্প্রদায়-সন্ত্রাসের সৃষ্টি হতে পারে। অন্য দিকে, জাতীয় সংখ্যালঘুর আঞ্চলিক অস্তিত্ব তাদের যেমন কণ্ঠরুদ্ধ করতে দেয় না, তেমনই ক্ষুদ্রতর পরিসরে তাদের কিছু সভ্যের দুষ্কর্মের সংখ্যাও বৃদ্ধি করে। সে কারণেই যেখানে সংখ্যালঘুরাই সংখ্যাগুরু, সেখানে এই সমস্যা খানিকটা প্রবল।
যদি সংখ্যালঘুদের ১০০ জনের মধ্যে ১০ জন দুষ্কর্মে লিপ্ত হয়, আর সেই অঞ্চলের বাইরে সার্বিক ভাবে সংখ্যাগুরুদের ২০০ জনের মধ্যে ৩০ জন সেটা করে, তা হলে সেটা শতাংশের হিসাবে বেশি। সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু জাতীয় স্তরে তথ্য অনুসারে মোটামুটি ভাবে একটি নিরঙ্কুশ ধারণা, কিন্তু এ দেশের সব জায়গায় সেটা নয়। কে সংখ্যালঘু কে সংখ্যাগুরু, সেটা শুধু ধর্মীয় ভাবে নির্ধারিত নয়। জনসংখ্যার আঞ্চলিক চেহারাটাও ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। জনসংখ্যার অসম বণ্টন নিঃসন্দেহে সংখ্যালঘুদের পক্ষে দেশের গণতান্ত্রিক চেহারাটির পক্ষে ভাল। তবে আঞ্চলিক দুঃখ-কষ্ট, আইনশৃঙ্খলা সমস্যা, ক্ষমতাহীনদের বহুমুখী শোষণ সম্পর্কে শাসনযন্ত্রকে সচেতন হতে হবে, জাতি ধর্ম এবং অন্যায় প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে। শুধু আদর্শগত কারণেই নয়, রাজনৈতিক কারণেও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy