Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
এ কী হল! কেন হল!
Mamata Banerjee

বাংলায় ‘মেরু’ বিজয়ের কেতন ওড়ানো গেল না

যদিও রাজ্য চষে প্রচার করতে করতে তিনি নিজে এবং তাঁর ভাইপো অভিষেক অন্তত প্রকাশ্যে দাবি করে এসেছেন যে, দু’শো আসন জয়ের ব্যাপারে তাঁরা নিশ্চিত।

দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০২১ ০৫:২৯
Share: Save:

যাক, এ বার অন্তত ‘জল’ মিশিয়ে জয়ের ‘তত্ত্ব’ খাড়া করা যাবে না! নির্বাচন কমিশন এবং ভোট করাতে আসা কেন্দ্রীয় বাহিনী বিজেপির পৃষ্ঠপোষকতা করেছে কি না, সেই প্রশ্ন নাহয় মুলতুবিই থাক। কিন্তু সত্যের খাতিরে এটুকু বলতেই হবে, কমিশন ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে বিজেপি কার্যত কোনও ক্ষোভ-অভিযোগ জানায়নি। তার পরেও বিধানসভা নির্বাচনের ফল কিন্তু প্রমাণ করে দিল যে, বাংলা বিজেপিকে চায় না।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে এতটা সাফল্য পাবেন, তা অনেকেই বোঝেননি। যদিও রাজ্য চষে প্রচার করতে করতে তিনি নিজে এবং তাঁর ভাইপো অভিষেক অন্তত প্রকাশ্যে দাবি করে এসেছেন যে, দু’শো আসন জয়ের ব্যাপারে তাঁরা নিশ্চিত। কিন্তু অতি বড় পণ্ডিতরাও মনে করেছিলেন, লড়াই হাড্ডাহাড্ডি। মমতা জিতলেও ১৬০-১৬৫’র বেশি আসন জুটবে না।

রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের মতো মাননীয় ব্যক্তি তো তৃণমূলকে সর্বাধিক ১১০-এর বেশি আসন ‘দিতেই’ রাজি ছিলেন না। বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া ‘তথ্য’ থেকে তাঁর হিসেব ছিল— বিজেপি ১৬৫, তৃণমূল ১০৩-১০৪, বাম-কংগ্রেস জোট কম-বেশি ২৫। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় আমার কাছেও তিনি এটা গোপন করেননি।

তবে হ্যাঁ, কিছু বিকল্প ভাবনা হয়তো তাঁরও ছিল। তাই শেষ দফা ভোটের পরের দিন, ৩০ এপ্রিল, তিনি চার বড় দলের নেতাদের ডেকে বৈঠক করতে চেয়েছিলেন। রাজ্যপালের উদ্দেশ্য ছিল, যদি কোনও দল সরকার গড়ার মতো একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায়, তা হলে ভবিষ্যৎ পদক্ষেপগুলি নিয়ে আলোচনা সেরে রাখা।

বৃহত্তম দলকে ডাকা বা দ্বিতীয় বৃহৎ দলকে অন্য কোনও দল সমর্থন করবে কি না, তার আগাম আঁচ পাওয়া, তেমন পরিস্থিতিতে সরকার গড়ার পরে কত দিনের মধ্যে শাসক দলকে বিধানসভায় শক্তি পরীক্ষায় ডাকা উচিত, সেই সম্পর্কে সবার মতামত নেওয়া ইত্যাদি প্রসঙ্গে ফলের আগেই আগাম কুশলী আলোচনা করতে চেয়েছিলেন ধনখড়।

কেন, তা আজ বুঝিয়ে বলার দরকার হবে না। সবাই সেটা জানেন। বিশেষত, দেশে বিজেপির শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে গোয়া, মিজ়োরাম, কর্নাটকের মতো বিভিন্ন রাজ্যে সরকার ‘বসানো’র কাজে রাজ্যপালদের ভূমিকা দেশবাসীর চোখের সামনে রয়েছে।

অনুরূপ ক্ষেত্রে আমাদের রাজ্যপাল তেমন কিছু করতেন, তা অবশ্য বলছি না। তবু বিষয়টি প্রকাশ্যে জানানোর কারণ হল, সে দিনও মমতা একই ভাবে ওই বৈঠকের ভাবনায় জল ঢেলে ধনখড়কে বলেছিলেন যে, তৃণমূল একাই যথেষ্ট বেশি আসন নিয়ে সরকার গড়তে পারবে। তাই অন্য কোনও সম্ভাবনা ধরে বৈঠক ডাকা অবান্তর। রাজ্যপাল শেষ পর্যন্ত বৈঠকটি ডাকেননি। তার প্রয়োজনও ধুয়ে গিয়েছে।

এ কী হল! কেন হল! ব্যাখ্যা-বিচার-দায় চাপানো এখন চলুক। শুধু সাধারণ বুদ্ধিতে কিছু যুক্তির অবতারণা করা যেতে পারে।

প্রথমেই বলি, পশ্চিমবঙ্গে ধর্মীয় মেরুকরণের ভোট হয়েছে বলে মনে করি না। বিজেপির মরিয়া প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বাংলার ভোটারদের সামগ্রিক ভাবে সেই দিকে টেনে নেওয়া যায়নি। যদি তা হত, তা হলে ত্রিশ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোটের বিপরীতে দাঁড়িয়ে ‘হিন্দুত্ব’-এর জিগির তোলা দলটি এই ভাবে খড়কুটোর মতো উড়ে যেত না। তাই আজ এটা দৃঢ় ভাবে বলা যায় যে, বাংলার জনগণ ভোটের মেশিনে বোতাম টেপার সময় হিন্দু-মুসলিম বিচার করেনি। তেমনটা করলে সমগ্র ফলাফলে তার ভিন্ন প্রতিফলন ঘটতই।

মেরুকরণের যুক্তি দেখিয়ে ‘তৃণমূল গেল গেল’ রব উঠেছিল গত লোকসভা ভোটের পর থেকেই। তখন বিজেপির ১৮টি আসনে জয় এবং সিপিএম ও কংগ্রেসের কোণঠাসা অবস্থা দেখে একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল যে, সরাসরি লড়াই হলে মমতাকে বেগ পেতে হবে। লোকসভার ফলের নিরিখে বিধানসভায় বিজেপির ১২১টি আসনে এগিয়ে থাকা দেখে অনেক বিশেষজ্ঞ বলে আসছিলেন, বাংলায় তীব্র মেরুকরণ হয়েছে এবং মমতার ‘সংখ্যালঘু তোষণের রাজনীতি’ তাঁকে পথে বসাচ্ছে। বিধানসভা নির্বাচনে যা আরও বড় ধাক্কা হয়ে দাঁড়াবে।

কিন্তু লোকসভা ভোটেও সাধারণ ভাবে সেই প্রবণতা ছিল বলে মনে হয় না। কারণ যদি তা-ই হত, তা হলে মাত্র দু’বছরের মধ্যে ‘হিন্দুত্ববাদী’দের ভোট-ব্যাঙ্কে এমন ঘাটতি দেখা যেত না। বরং মাঝের এই সময়কালে এত সাম্প্রদায়িক ইন্ধনের ফলে সেই ব্যাঙ্কের ‘তহবিল’ অনেক মজবুত হত। আসলে ২০১৯-এর ভোটে বিরোধীদের অনৈক্যে সারা দেশে মোদী-হাওয়া ছিল। বাংলাতেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। এটাই ছিল সেই নির্বাচনে বিজেপির ওই অগ্রগতির বড় কারণ।

কিছুটা তুলনীয় ১৯৮৪-র লোকসভা ভোট। ইন্দিরা-হত্যার পরে সেই ভোটে তখনকার বামফ্রন্টের বঙ্গে কংগ্রেস ১৬টি আসন পেয়েছিল। কিন্তু সেই ভোট কংগ্রেস আর ধরে রাখতে পারেনি। পরের ভোটেই ফের আসনসংখ্যা কমে যায়।

এই বাস্তবতা মাথায় রাখলে এ বার বিধানসভার ভোটে বিজেপির ৭৭টি আসনে থেমে যাওয়ারও একটি যুক্তিগ্রাহ্য উত্তর হয়তো মিলতে পারে। বস্তুত স্বাধীনতার পর থেকে বাংলার রাজনৈতিক ধারায় জনসঙ্ঘ, হিন্দু মহাসভা, মুসলিম লীগ বা অন্য কোনও রকম সাম্প্রদায়িক পরিচিতি বহনকারী দল বেড়ে উঠতে পারেনি। কখনও কোথাও দু’-চারটি কেন্দ্রে ওই সব দল ভোটে জিতলেও রাজনীতির মূল স্রোতের নিয়ন্ত্রক তারা কখনও ছিল না।

জনসঙ্ঘের উত্তরসূরি বিজেপি এখন অবশ্যই রাজ্য-রাজনীতির বড় অংশীদার। বাংলায় সিপিএম এবং কংগ্রেসের বিশ্বাসযোগ্যতা তলানিতে পৌঁছনোর পরে প্রকৃতির নিয়মেই বিরোধী পরিসরে বিজেপি সেই শূন্যতা পূর্ণ করেছে খুব অল্প সময়ে। তবে বিজেপির হাত ধরেও বাংলায় ধর্মীয় মেরুকরণ যে বিস্তার লাভ করতে পারল না, এই নির্বাচনের ফলে সেটা বেশ প্রমাণিত।

এটা যদি এ বারের বিধানসভা ভোটের একটি লক্ষণ হয়, আর একটি তবে বাঙালির জাত্যভিমান। মমতার নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেসের বিপুল জনসমর্থনে জিতে আসার পিছনে যা সম্ভবত সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে।

দশ বছর ক্ষমতায় থাকা মমতার উপর প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার যথেষ্ট চাপ এ বার ছিল। কিন্তু তাঁর দল ও সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ-অভিযোগ যতই থাক, অধিকাংশ বাঙালি এখনও বিজেপিকে ‘বাংলার দল’ বলে গ্রহণ করতে পারে না। সেখানে বাংলা দখলের লড়াইতে নরেন্দ্র মোদীকে ‘মুখ’ করে তোলা এবং দলে দলে অ-বঙ্গভাষী নেতা ডেকে এনে তাঁদের মাধ্যমে মোদী দেখিয়ে গদি দখলের ডাক অমিত শাহের ভুল কৌশল ছিল। এখানেই তিনি ব্যর্থ।

তৃণমূলের ভোট-কুশলী যখন চ্যালেঞ্জ করে বলতেন যে, বিজেপি ১০০ আসনও পাবে না, তখন তাতে সংশয় হত। তাঁর একটি ব্যাখ্যা ছিল— মোদী বাংলায় যত বেশি আসবেন, বিজেপির আসন তত কমবে। কেন? তিনি বুঝিয়েছিলেন, প্রথমত, ‘বাংলার মেয়ে’ ২৯৪টি কেন্দ্রে ‘মুখ’ হতে পারেন। কিন্তু রোজ দিল্লি থেকে উড়ে এসে কোনও প্রধানমন্ত্রী তা হতে পারেন না। বাংলায় বিজেপির একটি ‘মুখ’ দরকার ছিল। দ্বিতীয়ত, মোদী সারা দেশে সরকার ও শাসক দলের সব রকম ‘ব্যর্থতা’র দায়ভাগী। তিনি যেখানেই যান, ওই সব ব্যর্থতার বোঝা সর্বদা তাঁর কাঁধে থাকে। তাই সেই ব্যক্তি বাংলায় ‘সুশাসন’ দেওয়ার কথা বলতে এলে মানুষ হয়তো সভায় ভিড় করতে পারে, মনে সায় দিতে পারে না। তা হলে, সেটাই কি হল?

বাংলার ভোটকে বিজেপি এ বার যে রকম উচ্চগ্রামে নিয়ে গিয়েছিল, পরাজয়ের আঘাত নিশ্চয় ততোধিক লেগেছে। ‘প্রত্যাঘাত’ তারা করবে না, ভাবা ভুল। নতুন সরকারের শপথের আগে থেকেই সেই ‘প্রকল্প’ জারি হয়ে গিয়েছে।

প্রশাসক মমতারও তাই সতর্ক হওয়ার সময়। বিপুল জনসমর্থন এখন তাঁর সঙ্গে। প্রয়োজনে কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগও তাঁর হাতে।

অন্য বিষয়গুলি:

Mamata Banerjee West Bengal Assembly Election 2021
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy