ভাষা চিন্তার বাহক। ফাইল চিত্র।
বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে সেন্ট্রাল বোর্ড বা সিআইএসসিই কাউন্সিলের বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একটা নতুন ধারা দেখা যাচ্ছে। সম্পূর্ণ বাঙালি পরিবারের ছেলেমেয়েরাও বাংলার বদলে হিন্দি শিখতে আগ্রহী হচ্ছে। ভাষা চিন্তার বাহক। শিশু তার পরিবার-পরিজনের সান্নিধ্যে যে ভাষাটা প্রথমে শেখে, সাধারণত সেটাই তার চিন্তার বাহক হয়। বিদ্বজ্জনেরা তাই মাতৃভাষার মাধ্যমেই শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। প্রশ্ন হল, ভারতের সংবিধানে উল্লিখিত প্রধান বাইশটি ভাষা কি উচ্চশিক্ষার বাহক হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করতে পেরেছে?
না, অনেকটাই পারেনি। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর স্তর পর্যন্ত কলা এবং সমাজবিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে বাংলায় কিছু মৌলিক ভাল বই পাওয়া গেলেও বিজ্ঞান এবং আইন, ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং প্রভৃতি পেশাদারি শিক্ষায় উপযুক্ত বইয়ের অভাবে ছাত্রছাত্রীরা বাংলায় পড়ার সুযোগ পায় না। হিন্দি এবং অন্যান্য ভারতীয় ভাষার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা প্রায় এক। তাই অনুবাদের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু দায়িত্ব নেবেন কে? এই উদ্যোগে প্রাথমিক ভাবে রাজ্য সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। আসলে শিক্ষা দানের মাধ্যম হিসেবে ইংরেজির পাশাপাশি মাতৃভাষাকেও যে রাখা দরকার, এই বোধটাই আমাদের মধ্যে আসেনি।
সম্প্রতি দেখলাম, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন রাজভাষা সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি তাদের ১১তম রিপোর্টে রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দিয়েছেন, হিন্দিভাষী রাজ্যগুলিতে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেন লেখাপড়া হিন্দিতেই হয় এবং অ-হিন্দিভাষী রাজ্যগুলোতে যেন সেই রাজ্যের ভাষাতে হয়। কী সাংঘাতিক পরামর্শ! দেশীয় ভাষায় শিক্ষার সুযোগ রাখা মানে তো এই নয় যে, স্থানীয় ভাষায় বিভিন্ন প্রদেশের ছাত্রছাত্রীদের পড়তে বাধ্য করে একটা সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠানের চরিত্র নষ্ট করে দেওয়া! ভারতের মতো বহু-ভাষাভাষীর দেশে ইংরেজির বিরুদ্ধে এমন জেহাদ বিস্মিত করে! এই ধরনের সুপারিশ যখন সংসদের সংখ্যাগুরু প্রতিনিধিদের চিন্তাভাবনার প্রতিফলন করে, সেটা চিন্তার! আরও আশ্চর্যের, সংসদীয় কমিটির সুপারিশ নিয়ে চর্চা, প্রতিবাদ, সবই দক্ষিণ ভারত থেকে। বাংলা বা অন্যান্য পূর্ব ভারতীয় রাজ্যের চুপ থাকাটা কি সেই বোধ থেকে, যে বোধে আমরা বাঙালি ছেলেমেয়েদের বাংলা শেখার অনীহাকে অগ্রাহ্য করি?
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, গত পঁচাত্তর বছরে জাতির গঠনে বিভিন্ন ভাষার কী ভূমিকা হবে, তা নিয়ে অনেক চর্চা হয়েছে। আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ভাষা হিসেবে, এবং উচ্চতম শিক্ষার দ্বারে পৌঁছতে ইংরেজি ভাল করে শিখতেই হবে। সেই সঙ্গে রাষ্ট্রকেও চেষ্টা করতে হবে স্থানীয় ভাষাকে সেই স্তরে নিয়ে যেতে, যাতে ছাত্রছাত্রীরা নিদেনপক্ষে স্নাতকোত্তর স্তর পর্যন্ত নিজের ভাষায় পড়ার সুযোগ পায়। এ ছাড়া হিন্দিও সমস্ত অ-হিন্দিভাষী মানুষের জানা প্রয়োজন। এখানেই ত্রি-ভাষা সূত্রের সার্থকতা। আজ যদি একটি বাঙালি ছেলে বা মেয়ে পারিবারিক কারণে তামিলনাড়ুতে অবস্থান করে, সেখানকার স্কুলে বাংলা শেখার তার কোনও সুযোগ নেই। তাকে ইংরেজি, হিন্দির পাশাপাশি তামিলও শিখতে হবে, সেটাই বাঞ্ছনীয়। ত্রি-ভাষা সূত্র মানতে অ-হিন্দিভাষী রাজ্যগুলো যতটা আন্তরিক, হিন্দিভাষী রাজ্যগুলো ততটা নয়। জাত্যভিমানই হিন্দিভাষী রাজ্যে ত্রি-ভাষা সূত্র ঠিক ভাবে প্রয়োগ হতে দেয়নি।
রাজ্যগুলোর দায়িত্ব যে শুধু বাইশটি প্রধান ভারতীয় ভাষাকেই বিকশিত হতে সাহায্য করা, তা কিন্তু নয়। বাংলার কালিম্পং বা দার্জিলিং জেলার পর্বতাঞ্চলে সংখ্যাগুরু নেপালি ভাষাভাষী মানুষ যেন নিজের ভাষাতেই শিক্ষালাভ করতে পারে, সেটা বাংলার সরকার দেখে। প্রয়োজন হলে স্কুলের উচ্চ-প্রাথমিক স্তরে হিন্দির (তৃতীয় ভাষা) পাশাপাশি বাংলার সঙ্গেও একটু পরিচয় করিয়ে দেওয়া যেতে পারে। একই কথা পশ্চিমাঞ্চলের সাঁওতালিভাষীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কেন্দ্রীয় সরকারেও কোনও কোনও বিভাগে নিম্নবর্গের কর্মী নিয়োগে স্থানীয় ভাষা জানা আবশ্যক। অবশ্য, পশ্চিমবঙ্গ সরকার বাংলা ছাড়াও আরও এগারোটি ভাষাকে ‘অতিরিক্ত সরকারি ভাষা’ হিসেবে চিহ্নিত করে রেখেছে। যদি কালিম্পং বা দার্জিলিঙের পর্বতাঞ্চলে নেপালির বদলে বাংলা জানা আবশ্যক করা হয়, তবে অসন্তোষের কারণ হতে পারে। অসমের মতো রাজ্যে সেই অসন্তোষ বড় রকমের আইন-শৃঙ্খলার সমস্যাও তৈরি করতে পারে। কেন্দ্রীয় সরকারকেও তাই অনেক সংবেদনশীল হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
পশ্চিমবঙ্গে কোচ-রাজবংশী জনগোষ্ঠীর কামতাপুরি বা রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলে কুড়মালিভাষী বহু মানুষ বসবাস করেন। এই ভাষাতেও বিভিন্ন স্তরের পাঠ্যবই প্রস্তুত বা অনুবাদের দায়িত্ব রাজ্যের উপর বর্তায়। বর্তমান সরকার সেই দিশায় কিছু প্রাথমিক পদক্ষেপ করলেও আরও কিছু করা দরকার। বিবিধের মাঝে মিলন খোঁজার প্রয়াস নিরলস না থাকলে জাতির অস্তিত্বই এক সময় প্রশ্নের মুখে পড়বে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy