Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪
পিঠে-পায়েসের স্বাদে লেগে আছে স্বীকৃতিহীন শ্রম
Women

স্মৃতি সততই রাজনৈতিক

লিঙ্গনির্বিশেষে ‘ছোটবেলা’-র নাম যেমন ‘ছেলেবেলা’ হয়ে যায়, তেমন নস্ট্যালজিয়ার ন্যারেটিভও রোলার চালিয়ে সমসত্ত্ব করে নেওয়া গিয়েছে।

রীতি: পৌষপার্বণ উপলক্ষে পিঠে ও আলপনা। নদিয়ার চাঁদপুরে। ১৪ জানুয়ারি ২০২৪। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।

রীতি: পৌষপার্বণ উপলক্ষে পিঠে ও আলপনা। নদিয়ার চাঁদপুরে। ১৪ জানুয়ারি ২০২৪। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।

শতাব্দী দাশ
শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০২৪ ০৮:৪৭
Share: Save:

বড় স্মৃতির তুলো ওড়ে শীতে, কোন অদৃশ্য ধুনুরির ছিলার টানে কে জানে। ‘নস্ট্যালজিয়া’ বিষয়টি ইন্দ্রিয়জাত হয়েও ইন্দ্রিয়াতীত, তন্ময়তার ক্ষণে অমানুষী, ধ্রুব। গ্রিক ভাষায় ‘নস্তস’ মানে ঘরে ফেরার টান। কিন্তু সবার কি ঘর থাকে? কিংবা ঘরে সমান অধিকার?

যা ধ্রুব, তা অ-প্রশ্নযোগ্য, অ-পরিবর্তনীয়। কিন্তু গরিবের আর ধনীর নস্ট্যালজিয়া কি এক? এঁরা কি একে অপরের চিতোই পিঠে চেনেন? পথের পাঁচালী-তে মহাজনের বাড়িতে মোহনভোগ খেয়ে অপু ভেবেছিল, কিশমিশ-ঠাসা, ঘি-গড়ানো এই পদ আর মায়ের সুজি-গুড়ের মিশ্রণ— দুই-ই ‘মোহনভোগ’ হতে পারে না। পুং ব্রাহ্মণসন্তান অপু তবু যজমান বাড়িতে সে সোয়াদ পেল। ব্রাহ্মণী হয়েও সর্বজয়া বা দুর্গা পেল না। নারী আর পুরুষের নস্ট্যালজিয়া কি এক? দুর্গা যে উঠোন ঝাঁট দেয়, অপু তা মাড়িয়ে পাঠশালায় যায়। এ দিকে, অভাবী সর্বজয়া বিধবা ননদের দিকে পিঠ ফিরিয়ে বেঁচে-থাকা দুধটুকুতে চুমুক দেয়। বৃদ্ধার ফোকলা হাসি মিলিয়ে যায়। হরিহর, সর্বজয়া, অপুর সঙ্গে ইন্দির ঠাকরুন, দুর্গাও যদি কাশীবাসী হত, আর পাঁচ জনেই ঘাটে বসে উদাস হত কোনও দিন, তবে পাঁচ জনের নস্ট্যালজিয়া হত না কি আলাদা?

অথচ, লিঙ্গনির্বিশেষে ‘ছোটবেলা’-র নাম যেমন ‘ছেলেবেলা’ হয়ে যায়, তেমন নস্ট্যালজিয়ার ন্যারেটিভও রোলার চালিয়ে সমসত্ত্ব করে নেওয়া গিয়েছে। শীতকালীন নস্ট্যালজিয়ার যে মূলধারার সন্দর্ভ হাতে-বোনা সোয়েটার, পিঠে-পুলি নাড়ু-মোয়াকে ঘিরে, সেখানে স্পর্শ বা স্বাদের স্মৃতি ইন্দ্রিয়লব্ধ, কিন্তু ‘কল্যাণী হাতের ছোঁয়া’-টি পৌঁছেছে ইন্দ্রিয়াতীতে। ঔপনিবেশিকের দেশে যখন ভিক্টোরিয়ান যুগ আর ‘অ্যাঞ্জেল ইন দ্য হাউস’-এর স্তুতি, তখন উপনিবেশে বসে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘হে কল্যাণী নিত্য আছ আপন গৃহকাজে’। সে নারীর পুরস্কার (না কি পারিশ্রমিক?) হিসাবে ‘সর্বশেষের গান’টি কবি নাকি রেখে যাবেন। কিন্তু বাস্তবে কল্যাণীর নিত্যশ্রম অদৃশ্য। সিসিফাসের পাথর ঠেলার মতো প্রাত্যহিক গৃহকাজ— ফলাফল ক্ষণস্থায়ী জেনেই। রাঁধা খাবার খেয়ে ফেলা হবে, কাপড় নোংরা হবে, বাসন হবে এঁটো। শ্রম অদৃশ্য হবে। কল্যাণীর বাড়তি দায় তাই আরও সৃষ্টিশীলতা, নৈপুণ্য, শৈলী রপ্ত করার। পিঠে, আচারে নাম কিনেছেন যে নারী, তিনিই অতএব লক্ষ্মীশ্রী।

নিত্যশ্রমের পর এ সব ঝক্কি কি ভাল লাগত? তাঁরা অবিশ্যি অনেকেই বলেন, লাগত। ভাল লাগার মূলে দু’টি কারণ। এক: ভগিনীত্ব। সোয়েটারের নকশা দেওয়া-নেওয়ার সময় প্রাণের কথাটুকু, ত্রিশ বছর পিছোলে ঢেঁকিতে পাড় দেওয়ার সময়ের নারীসমাগম, পাঁচ জনের শিলে একই ডাল বার বার বেটে বড়ি দেওয়ার প্রণালীতে যে সমষ্টিচেতনা, তার প্রতি মুগ্ধতা স্বাভাবিক নাগরিক, উদার-অর্থনৈতিক একলা ঘরে। দ্বিতীয় কারণ, ‘সফট-স্কিল’ বাড়িয়ে ‘লক্ষ্মীমন্ত’ তকমা অর্জনের আকর্ষণ— যেমন কোনও চাকরিজীবীর বা চাকরিপ্রার্থীর থাকে। শুধু এই বেলা স্কিলের পারিশ্রমিক বা সাম্মানিক নেই। দুর্গোৎসব ও লক্ষ্মীপূজার পাশাপাশি, অঞ্চলভেদে কোথাও নীলষষ্ঠী, কোথাও বা পৌষ সংক্রান্তি, রান্নাপুজো যেন তাঁদের সার্টিফিকেট প্রাপ্তির দিন। নস্ট্যালজিয়া নাকি সতত সুখের! তবে কোনও লিঙ্গ, শ্রেণি, বর্ণের ক্ষেত্রে তা ইন্দ্রিয়সুখের স্মৃতি বয়ে আনে, অন্য কোনও লিঙ্গ, বর্ণ, শ্রেণির জন্য আনে আত্মত্যাগের মর্মসুখ। দুই সুখের মধ্যে শ্রম আর ভোগের ব্যবধান।

বাজারলব্ধ পিঠে-পুলি-নাড়ু-মোয়া অসিদ্ধ গণ্য হয়, তাতে ‘মায়ের হাতের ছোঁয়া’ নেই বলে। মাতৃবিষয়ক মিথ ও নস্ট্যালজিয়া ভাঙিয়ে রূপটানের নাম হয় ‘মামা’স আর্থ’ আর মশলার নাম ‘মমস্ রেসিপি’। আবার, মতান্তরে, বাজারজাত শীতোপচার গূঢ়তর কারণে অসিদ্ধ। মাটির খোল কাঠের আঁচে পুড়িয়ে যদি ব্রাহ্মণ ডেকে পুজোই না হয়, যদি না প্রথম পিঠে নিবেদন করা হয় পূর্বপুরুষকে, তবে কিসের পিঠে-পুলি? একে তো প্রাণের লোকাচারে কখন যেন ব্রাহ্মণ্যবাদী কলুষ সেঁধিয়েছে, তার উপরে প্রশ্ন জাগে— নিবেদনে পূর্বনারী কি পিঠের ভাগ পান? জীবৎকালে তিনি মূলত গড়েছেন রসনাতৃপ্তির সম্ভার; সবার খাওয়া হলে খান-কয় পেয়েছেন ভাগে। মৃত্যুর পর কি তাঁর খাওয়ার অখণ্ড অবসর? না কি, তাঁর প্রতি অর্ঘ্য নিবেদিতই হয় না?

নস্ট্যালজিয়ায় স্থান পাওয়ার অক্লান্ত সাধনা ছিল যাঁদের, অস্টিয়োপোরোসিসে গুঁড়িয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত সেই পূর্বজরা স্থির বসেননি কখনও। যেন তাঁদের কেউ কখনও বলেনি যে, নিজের প্রয়োজনীয়তা প্রতিনিয়ত প্রমাণ না করলেও ভালবাসা পাবেন তাঁরা; অন্তত পাবেন দৈনিক খোরাকি, সম্মান। বস্তুত, বিনাশ্রমে তাঁরা তা আদৌ পেতেন কি? নস্ট্যালজিয়ার বিষয় যাঁরা, তাঁদের নিজস্ব সমাজনির্মাণ-বহির্ভূত নস্ট্যালজিয়া নেই? সুলেখা সান্যাল নবাঙ্কুর-এ লিখেছিলেন: “মাকে দেখত রান্নাঘর থেকে ক্লান্ত মুখে বেরিয়ে এসে উনুনে হাওয়া দেবার ভাঙা পাখাখানা নিয়ে হাওয়া খেতে, কাছে দাঁড়ালেই বলতো, সরে যা ছবু, হাওয়া ছাড়।— নয়তো বলতো, কটা ঘামাচি মেরে দিবি? সে মা’র ঘামাচি ভরা পিঠ দেখে শিউরে উঠলে মমতা বলতেন, কী করবো? সারাদিন রান্নাঘরে আগুনের আঁচে থাকি— দেখিসনে?”

সুলেখা সান্যালের আখ্যানের নায়িকা ছবির এই স্মৃতিচারণ মূলধারার নস্ট্যালজিয়া থেকে হাড়েমাসে আলাদা। আমাদের স্মৃতি জুড়ে এমনই হন্যে মায়েদের দম-না-ফেলা দুপুর। আমাদের অতীত ও বর্তমান জুড়ে আরও আছে লেডিজ়-কামরার জানলায় ঘটাং শব্দে আংটাদের ক্ষিপ্র ঝুলে পড়া— যে আংটায় আটকে থাকে নোংরা কাঠকুটোর স্তূপ। আনাজওয়ালি, কর্মসহায়িকা, আয়ারা ফিরতি পথে শহরের খালপাড়, করাত-কলের ধার, কিংবা নব-নগরায়িত অঞ্চলের কর্তিত গাছ থেকে সংগ্রহ করেন কাঠকুটো। গাঁয়ে স্ব-মালিকানার গাছপালা নেই যাঁদের, শহরের উদ্বৃত্ত কাঠেই তাঁদের রান্না চড়ে। নেচার পত্রিকায় ২০২০ সালে প্রকাশিত পুষ্পেন্দু সিংহ আর ফাল্গুনী পট্টনায়কের গবেষণাপত্র বলে, শুধু জ্বালানি সংগ্রহেই এ দেশের দারিদ্রসীমার নীচের মেয়েদের দৈনিক গড়ে দু’চার ঘণ্টা যায়। তার পর রান্না। পরিচর্যা। প্রতিপালন। এবং লোকাচার। ট্রেনতুতো ‘মাসিরা’ বলেন, শীতের পিঠে-পুলি এটা-সেটা... উজ্জ্বলার গ্যাসের সাধ্য কী যে কুলোয়? যে ‘ঘটাং’ শব্দ আকৈশোর চিনি, তা ধ্রুপদী নস্ট্যালজিয়ার অন্তর্ভুক্ত নয়।

শীতকাল বস্তুত মেয়েদের পরীক্ষার মাস। কৃষিভিত্তিক সমাজে অগ্রহায়ণে ফসল উঠত। পৌষে উদ্‌যাপন। নতুন চাল থেকে পিঠে, নতুন ডাল দিয়ে বড়ি। নতুন শীতপোশাক তৈরি। নতুন আচারে পাক। পুরনো আচার, শীতপোশাক, লেপ-তোশকে রোদ খেলানোও আছে। অন্দরমহলে পরীক্ষা চিরন্তন। আর চাকরিরতারা? এক অশীতিপর নারীর নস্ট্যালজিয়ায় শীতের সকালে তোলা উনুনে শাশুড়ির নিরামিষ পদ রেঁধে যেতে পারার, এবং কাজ থেকে ফিরে পাটিসাপটা বানিয়ে আত্মজনের মুখে হাসি ফোটানোর অহঙ্কার। কেড়ে নেওয়া নিষ্ঠুর হবে, এমনই জীবনরসদ সে অহমিকা।

এ দিকে, ২০২০ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষা বলে, এ দেশের ৬০% নারী পূর্ণসময়ের অবৈতনিক গৃহশ্রমিক। ২০১৯ সালের ‘টাইম ইউজ় সার্ভে’ বলে, ৮৪% ভারতীয় নারীর মূল্যবান কর্মঘণ্টা অবৈতনিক শ্রমে ব্যয় হয়, কিন্তু ৮০% পুরুষই শ্রমের জন্য পারিশ্রমিক পায়; ভারতীয় নারী গড়ে দৈনিক ২৯৯ মিনিট গৃহকাজে আর ১৩৪ মিনিট পরিচর্যা-শ্রমে ব্যয় করে।

‘গুরুতর’ সব মেয়েলি পরীক্ষা বাদে, ‘গৌণ’ কিছু স্কুল-কলেজের পরীক্ষা ছিল আমার মায়ের। পিসতুতো দাদাদের উচ্চতর বোর্ড-পরীক্ষার সিট পড়েছিল মায়ের গাঁয়ে, তাই নিজের মাধ্যমিকের পনেরো দিন আগে সেই পরীক্ষার্থীদের রেঁধেবেড়ে দিতে হত— শুধু এইটুকু বলার সময়, এমনিতে নস্ট্যালজিয়ার আবেশ মাখা স্বর কেঁপে যায়। যে কান্নাকে ব্যক্তি নিজেও চেনে না, ক্ষণিকের স্বরকম্পে যা ধরা পড়ে, তারও নস্ট্যালজিয়ায় জায়গা নেই।

মোহসৃষ্টির আগে ‘নিখুঁত’-কে গড়তে হয় মানসপটে। নিখুঁতকেই ‘আদর্শ’ নামে ডাকি। এ ক্ষেত্রে তা পিতৃতান্ত্রিক আদর্শ। স্থান-কাল-ভেদে তা জাতীয়তাবাদী আদর্শও হতে পারে। এক-এক ‘আদর্শবাদ’ গড়ার এক-এক রাজনীতি। নস্ট্যালজিয়া আদ্যন্ত রাজনৈতিক।

অন্যতর স্মৃতিতে অন্তত জেগে থাকুক নস্ট্যালজিয়া-বহির্ভূত সেই অসহায়তা, সেই নিরাপত্তাহীনতা, যা এঁটো হাত ধুয়েমুছে শ্রান্ত দুপুরে ফিকে কাপড়ের পটে উজ্জ্বল সুতোয় লিখতে বসেছে: ‘সংসার সুখের হয়...’। তবে যদি কারও চোখে পড়ে, মনে থাকে!

অন্য বিষয়গুলি:

Women Society Food
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy