—প্রতীকী চিত্র।
এক বাল্যসহপাঠী এখন কলকাতার একটি নামী বেসরকারি হাসপাতালে ডাক্তার, প্রসূতিবিশারদ। সে জানাল, ৬ সেপ্টেম্বর যে জন্মাষ্টমী, তা নাকি এখনই তার রাতের ঘুম কেড়েছে! এই মুহূর্তে যত জন সন্তানসম্ভবা আসন্নপ্রসবা মহিলা তার চিকিৎসাধীন, তাঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠই চাইছেন, তাঁদের সন্তানটি যেন জন্মাষ্টমীর দিনই ভূমিষ্ঠ হয়! এই ধারাটি নাকি বিগত কয়েক বছর ধরেই জনপ্রিয়, এবং সেই প্রবণতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যাপারটা সহজে সম্ভবপরও হচ্ছে, কারণ আজকাল কলকাতা-সহ বিভিন্ন জেলাতেও মূলত সিজ়ারিয়ান পদ্ধতিতেই ‘ডেলিভারি’ হচ্ছে— ফলে, সব কিছু মোটের উপর ঠিক থাকলে, সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময়টিকে খানিক আগুপিছু করাই যায়। নেহাত শুভদিনের কারণে নয়, অভিভাবকদের বিশ্বাস, জন্মাষ্টমীর দিন সন্তান জন্মালে কোল জুড়ে পুত্রসন্তানই আসবে। পুত্রসন্তান-আকাঙ্ক্ষার এ এক নতুন চেহারা।
পঞ্চম জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা (২০১৯-২০২১) দেখাচ্ছে যে, ভারতে প্রতি ১০০০ পুত্রসন্তানপিছু কন্যাসন্তান জন্মের সংখ্যা ৯২৯। স্বাভাবিকের তুলনায় যা অনেকটাই কম। পাশাপাশি এও দেখতে পাচ্ছি যে, প্রায় আশি শতাংশ ভারতীয়ই মনে করছেন, সংসারে একটি অন্তত পুত্রসন্তান নিতান্ত প্রয়োজনীয়। একমাত্র মেঘালয় রাজ্যটিকে বাদ দিলে দেশের বাকি সব রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের জন্যেই এ কথা সত্য। আরও দেখা যাচ্ছে যে সংসারে প্রথম সন্তানটি পুত্র হলে দ্বিতীয় সন্তান জন্ম দেওয়ার প্রবণতা বা দ্বিতীয় সন্তানটি পুত্র হলে, তৃতীয় বার মা হওয়ার প্রবণতা এ দেশে কমে যায়।
অন্য দিকে, ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে যে, ২০১৬ থেকে ২০১৮, শুধুমাত্র এই তিন বছরেই দেশের ‘মিসিং উয়োম্যান’-এর (অর্থাৎ হিসাবমতো যে মেয়েদের বেঁচে থাকার কথা ছিল, কিন্তু কন্যাভ্রূণহত্যা, অপুষ্টি, অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যপরিষেবা বা চিকিৎসাহীনতায় যারা মারা গিয়েছে) সংখ্যা ৫,৮৬,০২৪। উপরন্তু, এই তিন বছরের প্রতি বছরই তা উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধিও পেয়েছে। বিশ্বের মোট ‘মিসিং উয়োম্যান’-এর চল্লিশ শতাংশই ভারতে। এবং, এই মাপকাঠিতে পশ্চিমবঙ্গ দেশের মধ্যে দ্বিতীয়, মহারাষ্ট্রের ঠিক পরেই।
পুত্রসন্তানের জন্য এমন আকুলতা কেন? এর উত্তর খুঁজেছে আমেরিকার পিউ রিসার্চ সেন্টার। পঞ্চম জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষার ভিত্তিতে ভারত সরকার কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদনটির বিশ্লেষণ করে এই গবেষণাকেন্দ্র মূলত দু’টি কারণ দেখিয়েছে। প্রথমত, এ দেশে যে-হেতু বিয়ের পর কন্যাসন্তানের শ্বশুরবাড়িতে চলে যাওয়াই এখনও দস্তুর, এবং পুত্রসন্তান যে-হেতু আজীবন তার পিতামাতার কাছেই থাকে, তাই আজীবন সন্তান ও নাতিনাতনির সঙ্গ পাওয়ার ইচ্ছা এবং বৃদ্ধ বয়সে পুত্রসন্তান-ই দেখভাল করবে ও দায়িত্ব নেবে, এমন ধারণা পুত্রসন্তান বাসনার একটি প্রধান কারণ। দ্বিতীয়ত, এ দেশের নানান ধর্মীয়, সামাজিক ও পারিবারিক রীতিনীতি পরিবারের পুত্রের হাতেই সম্পন্ন হওয়ার রেওয়াজ। সমীক্ষা বলছে, এ সব রীতিনীতি যথাযথ পদ্ধতিতে সুসম্পন্ন করার মাধ্যমে স্বীয় পুণ্য অর্জনের তাগিদও এ দেশে পুত্রসন্তান কামনার এক প্রধান কারণ।
পুত্রসন্তান কামনা কিন্তু বিংশ শতকের সূচনা অবধিও বিশ্বের প্রায় সকল উন্নত দেশেই ছিল। সেই কামনার ধরন স্থানভেদে খানিক ভিন্ন হলেও, পুত্রসন্তানাকাঙ্ক্ষার অস্তিত্ব ছিল সুস্পষ্ট। কিন্তু মূল তফাত হল বাকি দেশগুলি যেখানে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের ভাবনাচিন্তা, সামাজিক ও নৈতিক কাঠামো, আইনি পদ্ধতি এমনকি রাজনৈতিক বিষয়সূচিতেও মেয়েদের অস্তিত্ব সঙ্কট দূরীকরণ থেকে শুরু করে নারীক্ষমতায়নের মতো বিষয়গুলিকে প্রাথমিক প্রয়োজনীয় করে তুলে তার সংস্কার ঘটিয়েছে, এ দেশে তা হয়নি।
সাম্প্রতিক কালে এ ক্ষেত্রে যে দেশ ব্যতিক্রমী সাফল্য পেয়েছে, সেটি দক্ষিণ কোরিয়া। বাকি এশীয় দেশগুলির মতো দক্ষিণ কোরিয়াতেও পুত্রসন্তান প্রীতির আতিশয্য ছিল বরাবর। তদুপরি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ১৯৭০ সালে সে দেশে অনধিক দুই-সন্তান নীতি গৃহীত হলে ফল হল ভয়াবহ। কুড়ি বছরের মধ্যে দেখা গেল, দেশে প্রতি ১০০ জন মেয়ে পিছু ছেলের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১১৭ জন। সমস্যার সমাধানে সে দেশের সরকার আইনি সংস্কারের পথে হাঁটল। চারটি মূল নীতি নেওয়া হল— এক, উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে মহিলাদের পূর্ণ অধিকার স্থাপন করা হল ও পারিবারিক ‘হোজু’ রীতিকে অসাংবিধানিক তকমা দিয়ে মহিলাদেরও পরিবারের প্রধান হিসাবে গণ্য করার পথটি উন্মুক্ত হল; দুই, আইনে বলা হল যে, নববিবাহিত যুগলের বাসস্থান ঠিক হবে তাদের উভয়ের ইচ্ছার ভিত্তিতে, ফলে বিয়ের পরেই মেয়েদের শ্বশুরবাড়ি যাত্রার ব্যবস্থাটি পরিবর্তিত হল; তিন, গর্ভস্থ ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ণায়ক পরীক্ষা নিষিদ্ধ ও শাস্তিমূলক করা হল; এবং চার, বয়স্কদের জন্য বিশেষ পেনশন বা ভাতার ব্যবস্থা করা হল, যাতে পুত্র-কন্যানির্বিশেষে সন্তানের মুখাপেক্ষী না হয়েই তাঁরা বাঁচতে পারেন। এর ফলও মিলল হাতেনাতে। আজ দক্ষিণ কোরিয়ায় নারী ও পুরুষের অনুপাত প্রাকৃতিক গড় অনুযায়ীই।
জন্মাষ্টমীতে পুত্রসন্তান কামনায় উদ্গ্রীব মা-বাবাদের দিকে রাষ্ট্র কবে এই দৃঢ় অথচ সহায়ক হাতটি প্রসারিত করবে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy