সহধর্মী? রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও প্রতিমা দেবী। ছবি সৌজন্য: বিশ্বভারতী।
দাম্পত্য অসাড় হয়ে গেলে, লোকদেখানো ফুলদানিতে তাকে আর সাজিয়ে রাখা যে নিষ্প্রয়োজন, নিজের জীবনের সাহসী দৃষ্টান্ত দিয়ে তা বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ২৭ নভেম্বর সেই প্রতিভাধর, সৃজন-উন্মুখ, সংবেদনশীল নন্দনবেত্তার জন্মদিন যেন তাঁর বহুপ্রত্যাশিত ব্যক্তি-স্বাধীনতারই উদ্যাপন। বিয়ের বছর দুয়েক পরই, বিলেতে তাঁকে ছেড়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে অন্যত্র চলে যাওয়া প্রতিমাকে রথীন্দ্রনাথ লিখছেন, “আমি যে আদর্শ নিয়ে তোমাকে বিয়ে করেছিলুম তা ক্রমশই ভুলে গেছি বা হারিয়ে ফেলেছি।” এও লিখেছেন, “…এবার এত ইচ্ছে করছে যে তোমাকে নিয়ে এমন কোথাও গিয়ে বসি যেখানে তোমারও পড়াশোনা হতে পারে আমিও আমার জীবনকে একটা কোনও উদ্দেশ্যে প্রস্তুত করে তুলতে পারি। এ না হলে আমি আর পারছি না।” এই চিঠি সম্ভাব্য এক ভাঙনের যে বুদ্বুদ বহন করে, রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর তা-ই প্রবল ঢেউ হয়ে রথী-প্রতিমার চল্লিশ বছরের বৈবাহিক সম্পর্ক তছনছ করে দেয়। এক চিঠিতে প্রতিমাকে রথীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, এক সময় ভালবাসার ঘোরে চাপা পড়ে থাকা তাঁদের দু’জনের মনের অমিলগুলো ক্রমে প্রকট হওয়ার কথা। আর এক চিঠিতে লিখেছিলেন, “তোমার মনে ‘আইডিয়াল লাভ’-এর যে আদর্শ আছে তার কাছেও পৌঁছতে পারিনা বোধ হয়।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মৃণালিনী দেবীর সন্তান-সন্ততিদের এক জনের বিয়েও সুখের হয়নি। এঁদের মধ্যে বড় মেয়ে মাধুরীলতা আর মধ্যম কন্যা রেণুকার অকালমৃত্যু তাঁদের দাম্পত্যের বিষাদ থেকে মুক্তি দিয়েছিল। মূলত শ্বশুরের টাকায় বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগের টানে রবীন্দ্রনাথের ছোট মেয়ে মীরাকে বিয়ে করে, স্ত্রীকে প্রায় গোটা বৈবাহিক জীবনেই যারপরনাই পীড়া দিয়েছিলেন নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। মীরার উপর তাঁর জুলুম সহজ হয়েছিল, কারণ মীরা ছিলেন নগেন্দ্রনাথের পুত্র নীতীন্দ্রনাথ আর কন্যা নন্দিতার মা। অর্থ, সুবিধা ও ক্ষমতাপিয়াসি; দাম্ভিক ও হঠকারী, অন্যকে কষ্ট দিয়ে তৃপ্তি পাওয়া জামাতাকে অনেক চেষ্টা করেও রবীন্দ্রনাথ মীরার প্রতি অনুরক্ত করে তুলতে পারেননি। অসুখী, বিরক্ত মীরা নগেনের থেকে আলাদা হতে চাইলে পুত্র-কন্যার উপর নিজের অধিকার আর বিচ্ছেদে লোকলজ্জার জুজু দেখিয়ে ছকে-বাঁধা ‘পৌরুষে’ মীরার জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিলেন নগেন্দ্রনাথ। এতটাই যে, ১৯১৯-এ রথীন্দ্রনাথকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, বিয়ের রাতে মীরাকে দেখে স্নানের ঘরে যে গোখরো সাপটা ফণা তুলেছিল, তার দংশনে সে দিন মৃত্যু হলেই যেন মীরা পরিত্রাণ পেত। নগেন্দ্রনাথের ‘দুর্দ্দাম বর্ব্বরতা’র কথা উল্লেখ করে এই চিঠিতেই রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “সেইটেতেই মীরা ওকে কেবল ভয় করেছে, ভালবাসতে পারেনি।” লিখছেন, “ভালবাসা না থাকা সত্ত্বেও যদি ওরা কোনোরকমে মিলেমিশে থাক্তে পারত তাহলে ভালই হত। কিন্তু তার কোনো সম্ভাবনা নেই কারণ মীরাও ছলনা করতে পারেনা, নগেনও ক্রোধ সংযম করতে জানেনা… সেই অপমান নিষ্ঠুরতা রাগারাগির মধ্যে ছেলেপুলে নিয়ে সমস্ত জীবন মীরা কাটাবে কী করে?” ১৯২৩-এ নগেন্দ্রনাথকে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “মীরা তোমার কাছ থেকে দূরে থাকলে তোমার সম্বন্ধে লোকনিন্দার আশঙ্কা আছে বলে তুমি কল্পনা করচ। মীরা নিজের সম্বন্ধে লোকনিন্দাকে গ্রাহ্য করেনা তোমাকে লিখেচে শুনে আমি খুসি হলুম। জীবনে সব মানুষের ভাগ্যে সুখ থাকে না—তা নাই বা থাকল—কিন্তু স্বাধীনতা যদি না থাকে তবে তার চেয়ে দুর্গতি কিছু হতে পারে না।”
মীরা-নগেনের বিয়ের একুশ বছর পর ১৯২৮-এর ৫ অক্টোবর প্রশান্ত মহলানবীশকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠি থেকে ধারণা হয়, সম্ভবত দাম্পত্য বিষয়ক কোনও মামলায় আদালতে মীরার শুনানির দিন পিছিয়ে গিয়েছে। অসুখী দাম্পত্য থেকে মেয়ের মুক্তি প্রত্যাশী রবীন্দ্রনাথ প্রবল বিরক্ত হয়ে লিখছেন, “এটা ইচ্ছা করে ঘটিয়েচেন সুধাকান্তে তারকবাবুতে মিলে। তাঁদের ইচ্ছা কোনোমতে মিটমাট হয়ে যায়।”
তিন সহোদরার দাম্পত্যের দুর্গতি রথীন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষ করেছিলেন। বাবার পছন্দে বাল্য-বিধবা প্রতিমাকে বিয়ে করে তিনি তাঁকে নিয়ে প্রথমে মুগ্ধই ছিলেন। বিয়ের পর দু’জনে যখন পূর্ববঙ্গে নিভৃত সংসার রচনায় মন দিয়েছেন, হঠাৎ তাঁর বিদ্যালয়ের কাজে রবীন্দ্রনাথ তাঁদের শান্তিনিকেতনে ডেকে নিয়ে এলেন। রথীন্দ্রনাথের মতোই রবীন্দ্রনাথের সেবায় মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছিলেন প্রতিমা। কিরণবালা সেন লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁকে এক দিন বলেছিলেন, “বউমা কাছে না থাকলে বড়ো খালি খালি লাগে। দেখেছি জীবনের আরম্ভে যেমন একটি মেয়ের দরকার, জীবনের শেষ দিকেও তেমনি একটু মেয়ের দরকার।… একটি নির্ভর করে থাকবার লোক চাই।” ব্যস্ত ও বিখ্যাত বাবার ছায়ায় থাকতে থাকতে রথীন্দ্রনাথ আর প্রতিমার ভিতর কখন যেন এক অনতিক্রম্য ব্যবধান গড়ে উঠেছিল। রবীন্দ্রনাথ তাঁর পুত্র আর পুত্রবধূকে আঁকড়ে ধরেছিলেন। আর পিতার মৃত্যুর প্রায় এক দশক পর রথীন্দ্রনাথ আঁকড়ে ধরেছিলেন শান্তিনিকেতন আশ্রমের শিক্ষক নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রূপে অনন্যা স্ত্রী মীরাকে। বিশ্বভারতীর অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিধ্বস্ত রথীন্দ্রনাথ একটু নিরালা অবকাশ, একটু কোমলতার স্পর্শ খুঁজছিলেন। বিশ্বভারতীর উপাচার্যের পদে ইস্তফা দিয়ে লোকনিন্দার ভয় না পেয়ে নির্মলচন্দ্রের সম্মতিতেই তাঁর স্ত্রী মীরাকে নিয়ে রথীন্দ্রনাথ বাকি জীবন কাটিয়ে দিলেন দেহরাদূনে। মীরার সঙ্গে তাঁর সখ্য আড়াল করার চেষ্টা করেননি রথীন্দ্রনাথ। দেহরাদূনে যাওয়ার আগে প্রতিমাকে লিখলেন, “আমার পক্ষে একলা থাকা এখন আর সম্ভব নয়, মীরাকে নিয়ে যাচ্ছি। তোমার ভাল না লাগলেও আমি আশা করছি তুমি আপত্তি করবেনা।” পালিতা কন্যা নন্দিনীর কথা ভেবেও প্রতিমা আপত্তি করেননি, শুধু নন্দিতা কৃপালনীকে চিঠিতে লিখেছিলেন “ওনার সমস্ত ব্যক্তিত্ব ওই মেয়ে গ্রাস করে নেবে।” কিছুটা বিবেকদংশনে মীরাকে এক চিঠিতে রথী লিখেছিলেন, “যা চাচ্ছিলুম, যার অভাবে মন অসাড় হয়ে গিয়েছিল তোমার মধ্যে তা দেখতে পেয়ে অন্তরাত্মা উল্লসিত হয়ে উঠল।… আমি তৃপ্ত হলুম, নিঃসঙ্গ জীবন সঙ্গী পেল… বাইরের জগৎ অদৃশ্য হয়ে গেল— তোমার মধ্যেই আমার সমস্ত জগৎ পেয়ে গেলুম। কিন্তু একটি প্রশ্ন রয়ে গেল—আমি কি ভালো করলুম?” রথীন্দ্রনাথের আবেগের কাছে যদিও কখনও হার মানেনি তাঁর নিজেকে আবিষ্কার করে ভাল থাকার যুক্তি।
রথীন্দ্রনাথকে লেখা প্রতিমার চিঠিপত্র হাতে পাওয়া দুষ্কর। বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রভবনের সংগ্রহে প্রতিমা দেবীকে লেখা রথীন্দ্রনাথের কিছু চিঠি সংরক্ষিত হয়েছে। এই চিঠিগুলোর কয়েকটা রথীন্দ্রনাথ আর প্রতিমার সম্পর্কের টানাপড়েনের কথা বলে। রথীন্দ্রনাথের চিঠিগুলোর বেশির ভাগই সাল-তারিখহীন। প্রতিমাকে শিলাইদহ থেকে এক চিঠিতে লিখেছেন, শৈশবে মায়ের স্নেহ-ভালবাসা অনেক পেয়েছিলেন কিন্তু মায়ের মৃত্যুর পর তাঁর মনটা ‘মরুভুমি’ হয়ে যায়। কাজের সূত্রে সেই সময় একা থাকা রথীন্দ্রনাথ প্রতিমাকে লিখছেন, “আমি তোমার প্রতি এত একান্তভাবে আকৃষ্ট হয়েছি— সে আগেই বলেছি কেবল মোহবশত নয়— আমি তোমাকে পেয়ে তোমার মধ্যে আমার জীবনের আদর্শ লাভ করেছিলুম, সেটা কি একটা কম কথা? সেই জন্যই প্রথম থেকে আমার প্রাণমন তোমার কাছে শঁপে [য] দিতে পেরেছিলুম।” আর এক চিঠিতে শান্তিনিকেতনের ছাতিমতলায় তোলা প্রতিমার ছবি দেখে লিখছেন, “তুমিই আমার প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ, আত্মার শান্তি।” শিলাইদহ থেকে লেখা এক চিঠিতে রথীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন প্রতিমাকে তিনি মন খুলে সব কথা বলতে পারতেন। প্রতিমা রথীর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, তাঁর কাছে রথী কিছু পেয়েছেন কি না! রথীর উত্তর: “আমি যে তোমার মধ্যে অনন্ত স্বর্গ দেখেছি, তুমি যে আমাকে অনন্ত সুখ, আনন্দ দিয়েছ তা কি জান না? তোমাকে ভালবেসেই আমি তৃপ্ত ছিলাম— কিন্তু তুমি তাতে সন্তুষ্ট নও— আমি সেই তোমাকে প্রাণমন দিয়ে ভালবাসলুম, তুমি বলছ আরও উচ্চে উঠতে হবে— তোমার ভালবাসাকে নিষ্কাম করতে হবে।” পড়তে পড়তে মনে হয়, প্রতিমার প্রতি রথীর ভালবাসায় একটা উদ্দামতা থাকলেও প্রতিমা ছিলেন তুলনায় সংযত, হয়তো বা কিছুটা শীতল।
রথীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে তাঁকে রেখে পাকাপাকি ভাবে চলে গেলে, কখনও প্রদর্শনীতে রথীর পাশে মীরার চিত্রকলা দেখে কষ্ট পেয়েছেন প্রতিমা। চিঠিপত্রে তবু বন্ধুত্বপূর্ণ যোগাযোগে ছেদ পড়েনি, হয়েছে দেখাও, রিক্ততাকে তিক্ততা বিষিয়ে দেয়নি। তাঁর কোনও এক চিঠি প্রতিমাকে অসুস্থ করে তুলেছিল জেনে তাঁকেই রথী নির্বিকল্প সৌজন্যে লিখছেন, “আমার জীবনের এই পরিবর্তন অনিবার্য ছিল, তোমাকে যে আঘাত দিচ্ছি এইটাই আমার সবচেয়ে দুঃখ। যদি ক্ষমা করতে পারো তবেই শান্তি পাব।” মৃত্যুর এক বছর আগে নববর্ষে এক মর্মস্পর্শী চিঠিতে রথী প্রতিমাকে লিখলেন, “আমরা দুজনেই এখন জীবনের সীমান্তে এসে পড়েছি।… আমাদের মধ্যে প্রীতি সম্বন্ধ অক্ষুণ্ণ থাকে এই নতুন বছরে তাই কামনা করি। তুমিও আমার ভালোবাসা নিও।”
পারস্পরিক শ্রদ্ধা অটুট রেখে, রথীন্দ্রনাথ আর প্রতিমার গভীরতায়, বিচ্ছেদেও আমরা ভালবাসার পরশ পেলাম কই!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy