ভবিষ্যৎ: সমস্ত শিশুকে যথার্থ শিক্ষার সুযোগ দেওয়া একটি সামাজিক দায়িত্ব। —ফাইল চিত্র।
শনিবারের দুপুরে ছ’তলা অফিস বাড়ির একতলার গাড়ি রাখার জায়গাটা হয়ে ওঠে কচিকাঁচাদের কলস্বর-মুখরিত। প্রতি সপ্তাহেই। তিনটে বাজতেই স্কুলব্যাগ নিয়ে ওরা হাজির। “ও স্যর, ইস্কুল কখন হবে?” অতিষ্ঠ করে তোলে ‘ম্যাম’ আর ‘স্যর’দের। আশপাশের তিনটি সাময়িক ‘আবাসন’-এর ঘুপচি দশ ফুট-বাই-দশ ফুট ঘরগুলি থেকে আসে ওরা, বিভিন্ন বয়সের গোটা পঞ্চাশেক ছেলেমেয়ে, যদিও এটি কোনও স্কুল নয়। এসেই তারা দাবি করতে থাকে, আজ কী পড়তে চায়। কেউ লিখতে চায়, কেউ চায় অঙ্ক করতে। কেউ ছোট্ট শরীরের সমস্ত জোর দিয়ে ‘ম্যাম’-এর হাত ধরে টেনে যাচ্ছে মনোযোগ আকর্ষণের জন্যে। এরা সবাই কাছের সরকারি স্কুলে যায়। পড়াশোনা শিখছে কি না, তার মূল্যায়ন করার ক্ষমতা এদের মা-বাবাদের নেই। স্কুলশিক্ষা বিভাগ-নির্ধারিত ‘কাঙ্ক্ষিত সামর্থ্য’ অর্জনের লক্ষ্য থেকে এরা যে অনেকটা দূরেই রয়েছে, তা এক নজরেই বোঝা যায়। ফলে স্কুলেও যে তারা খুব আনন্দে কাল কাটায় তা নয়। তবু যায়। পশ্চিমবঙ্গের যে ৮৫ শতাংশ ছাত্রছাত্রী প্রাইভেট টিউশন নেয়, এরা তাদের মধ্যে পড়ে না। কয়েকটি শ্রেণি অতিক্রম করে এদের অনেকেই রণে ভঙ্গ দেয়, বিশেষত ছেলেগুলি।
টুম্পা একটা খালি স্কুলব্যাগ পিঠ থেমে নামাল। বই কোথায় রে? ‘ফোর পাশ করে বই ফেরত দিয়ে দিয়েছি, আর ফাইভে ভর্তি নেয়নি, তাই বই পাইনি’। ফাইভে ভর্তি নেয়নি কেন? ‘ইস্কুলে বলল বয়েস হয়নি’। সে কী! ফোর পর্যন্ত পড়ল, ফাইভে উঠে যাবে পরের বছর, বয়েস তো নিজস্ব নিয়মেই বেড়ে চলবে, কমে যাওয়ার তো কথা নয়! ডাকা হল টুম্পার মা-কে। তিনি টুম্পার একটি জন্ম সার্টিফিকেট দেখালেন, যা তিনি দু’হাজার টাকায় সংগ্রহ করেছেন জনৈক শঙ্করের মাধ্যমে। শঙ্কর ভারী বুঝদার ব্যক্তি। টুম্পার জন্মসালটি তিনি নিজ দায়িত্বে ২০১৪ করে রেখেছেন সার্টিফিকেটে, ভবিষ্যতে মেয়ের সুবিধা হবে ভেবে— যদিও টুম্পার মা জানতেন, তাঁর কন্যার জন্ম ২০১২ সালে। তবে টুম্পার মা কোনটিকে সঠিক বলে জানেন, তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হল, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে টুম্পাকে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির সময়ে তথ্যভান্ডারে ২০১২-ই প্রবিষ্ট হয়েছিল।
হাই স্কুলে ভর্তির সময়ে জন্ম সার্টিফিকেট দেখতে চাইলে টুম্পার মা দু’হাজার টাকার বিনিময়ে প্রাপ্ত সেই মূল্যবান কাগজটি দেখালেন। হাতে সরকারি কাগজ থাকলে মনের জোর আসে। স্কুল জানাল, ওর বয়স এখন ন’বছর, ফাইভে ভর্তি হতে ওকে দু’বছর অপেক্ষা করতে হবে। সে কী! এখন দু’বছর সে করবে কী? বিগত চার বছরে যেটুকু শিখেছিল, ভুলে যাবে না? হাই স্কুল কর্তৃপক্ষের এক বারও মনে হল না যে, রাস্তার ও পারেই যে প্রাথমিক স্কুলে সে চার বছর পড়ল, সেখান থেকে ট্রান্সফার সার্টিফিকেটটি নিয়ে আসতে বলা যেত, যেখানে জন্মসাল থাকবে ২০১২, যার ভিত্তিতে ফাইভে ভর্তি নিতে কোনও অসুবিধা নেই। স্কুলের দোষ নেই। এখন সব কিছু হয় পোর্টালে। স্কুলশিক্ষা বিভাগের পোর্টালে প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর জন্যে নির্দিষ্ট চুরাশিটি ঘর ভরতে গিয়ে কোথায় কখন ঠেকে যান, সেই ভাবনায় তাঁদের উদয়াস্ত কেটেযায়, অন্য ভাবনার সময় কই! আর টুম্পার মা-কেই বা কী ভাবে বোঝানো যায় এই মহামান্য পোর্টালের কথা! টুম্পা খুব চায় ওর বন্ধুদের মতো স্কুলে যেতে। কিন্তু পুরসভার সিলমোহরসম্বলিত একটি কাগজ যে তার সামনে এমন দুর্লঙ্ঘ্য দেওয়াল তুলে দেবে কে-ই বা জানত!
শনিবারের ইস্কুলের ম্যাম-স্যররা গেলেন হাই স্কুলের ম্যামের কাছে। তাঁর এক কথা— জন্ম সার্টিফিকেট লাগবেই। যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা হল, শিক্ষার অধিকার আইনে পরিষ্কার বলা আছে, সার্টিফিকেট না-থাকার কারণে কাউকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা যায় না। অতঃপর রাজি হলেন ট্রান্সফার সার্টিফিকেটের ভিত্তিতে ভর্তি নিতে। কিন্তু বার বার মনে করিয়ে দিলেন যে, জন্ম সার্টিফিকেট লাগবেই। কারণ, মহামান্য পোর্টাল জন্ম সার্টিফিকেট ছাড়া বেশি দূর এগোতে দেবে না। যেমন, টুম্পা যখন অষ্টম শ্রেণিতে উঠবে, তখন কন্যাশ্রীর টাকা পেতে তো সার্টিফিকেট লাগবেই। তাই মকদ্দমাকে একটু সরল করে নিতে তাঁরা ঠিক করেছেন, জন্ম সার্টিফিকেট না থাকলে ফাইভেই ভর্তি নেবেন না।
কন্যাশ্রী একটি বেজায় উপকারী প্রকল্প, সন্দেহ নেই। কিন্তু কন্যাশ্রীর নিয়মের বজ্র আঁটুনি যে এমন ফস্কা গেরো সৃষ্টি করবে যার ফাঁক দিয়ে টুম্পাদের শিক্ষাই গলে যাবে, এমন সম্ভাবনার কথা বোধ হয় কারও মাথায়ই আসেনি। সার্টিফিকেট নেই কিংবা ভুল জন্ম বছর খোদিত সার্টিফিকেটের কারণে কত জন টুম্পার মা’কে স্কুলের দরজা থেকে ফিরে আসতে হয়েছে বা হচ্ছে, সে খবর বিকাশ ভবনের কর্তাদের কাছে থাকার কথা নয়। সত্যিই তো, শতাংশের হিসাবে তা আর কতটুকু!
অবশেষে বরফ গলল। মধুরেণ সমাপয়েৎ। টুম্পা সে দিনই ভর্তি হল হাই স্কুলে। হাতে হাতেই পেয়ে গেল সরকারি লোগোসম্বলিত ব্যাগ-সহ বই। কিন্তু খচখচানি একটু থেকে গেল। টুম্পার ভর্তির জন্যে ফর্ম বাবদে লাগল একশো টাকা, ভর্তির জন্যে চালান ভরে ব্যাঙ্কে জমা করতে হল ১৫৫০ টাকা, যা টুম্পার মায়ের এক সপ্তাহের রোজগার। শুনেছিলাম সরকারি এক আদেশনামা অনুসারে কোনও ছাত্র বা ছাত্রীর থেকে বছরে ২৪০ টাকার বেশি নেওয়া যায় না। অন্য কয়েকটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক-শিক্ষিকাদের থেকেও জানা গেল তাই। তাঁদের এক জন এই আদেশনামার প্রতিলিপিও পাঠিয়ে দিলেন তৎক্ষণাৎ। আদেশনামা সঙ্গে থাকলেও শনিবারের স্কুলের ম্যাম স্বাভাবিক ভদ্রতার কারণে বড় ম্যামকে বলতেই পারলেন না যে, আদেশনামায় লেখা আছে ২৪০ টাকার থেকে এক পয়সা বেশি নেওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কারণ বড় ম্যাম আগেই বলেছিলেন তিনি এসআই (স্কুল পরিদর্শক)-এর নির্দেশমতো চলেন— “আপনারা কি এসআই-এর থেকে বেশি জানেন?” যুক্তিবিদ্যার পরিভাষায় একে বলে ‘অ্যাপিল টু অথরিটি’— যুক্তিতে না শানালে বলতে হয় এ আমার কথা নয়, অমুক বা তমুক মহামান্যর কথা। অন্যের কথা ও যুক্তি শোনার ইচ্ছার অভাব যে শুধু আমাদের মহান মন্ত্রীসান্ত্রিদেরই একচেটিয়া, এমনটি ভাবলে ভুল হবে।
শিক্ষা বিষয়ে তর্কবিতর্কের প্রায় সবটাই ইদানীং নিয়োগ দুর্নীতি এবং যোগ্য প্রার্থীদের বঞ্চনা ঘিরে উত্তেজনার আগুনে উত্তপ্ত। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উচ্চশিক্ষায় উপাচার্য নিয়োগ ঘিরে হতাশজনক প্রশাসনিক জটিলতা। দুর্নীতি হয়, হইচই হয়, সরকার বদল হয়, আবার দুর্নীতি হয়, টুম্পাদের গল্পগুলো বদলায় না। আবার বদলায়ও। এই যেমন হল। টুম্পা এখন স্কুলে। অতিমারির কারণে সারা দেশেই শিক্ষার অভূতপূর্ব ক্ষতি হয়েছে। এমতাবস্থায় পঠনপাঠনকে কোভিড-পূর্ব অবস্থায় ফিরিয়ে আনা এবং তাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এই মুহূর্তে সবচেয়ে কঠিন কাজ। ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিংবা সাংগঠনিক প্রচেষ্টায় অনেক শিক্ষক ও সমাজমনস্ক মানুষ সীমিত পরিসরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন শিশুকিশোরদের মধ্যে শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে রাখতে, যা অবশ্যই অভিনন্দনযোগ্য। এসআই-এর চেয়ে বা বড় ম্যামের চেয়ে বেশি জানেন, সে দাবি তাঁরা করতে চান না। একটি একাদশবর্ষীয় বালিকার স্কুল যাওয়ার ইচ্ছাকে এই উদাসীন ব্যবস্থায় মরে যেতে দেখে তাঁরা চুপ করে বসে থাকতে পারেননি। বড় ম্যাম বিরক্ত হয়ে বললেন, “তোমরা এনজিও করো?” ওঁরাও থতমত খেয়ে বললেন, “না না।” সত্যিই তো, ‘এনজিও করা’ ঠিক কোন গোত্রের ক্রিয়াপদ তাঁদের জানা নেই। ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে সরকারি উদ্যোগের সঙ্গে সামাজিক উদ্যোগ মিলেজুলে স্কুল শিক্ষায় বড় পরিবর্তন ঘটে চলেছে। যার প্রতিফলন বিভিন্ন সূচকেও দেখা যাচ্ছে। এর পিছনে কিছু জনকল্যাণমূলক ফাউন্ডেশনেরও ভূমিকা আছে। এমন চেষ্টা এ রাজ্যে কম হলেও হচ্ছে। একে তাচ্ছিল্য ভরে ‘এনজিও করা’ বলে টুম্পাদের কোন সুবিধাটি হবে জানা নেই।
বলতে ইচ্ছে হয়, বড় দেরি হয়ে যাচ্ছে, একটু পা চালিয়ে ভাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy