আমরা চিনলাম আমাদের ভবিষ্যতের ভারতকে।
রাজস্থানের সুরানা গ্রামে থাকত ন’বছর বয়সি ইন্দ্র মেঘওয়াল, গ্রামের সরস্বতী বিদ্যামন্দির স্কুলের ছাত্র। এই কোনও কিছুই আমাদের জানা হত না, যদি না দলিত পরিবারের সন্তান হয়ে ইন্দ্র এক দিন স্কুলে গিয়ে উচ্চবর্ণের জন্য রাখা পানীয় জল পান করে ফেলত, ওই জল পানের শাস্তি হিসেবে শিক্ষক তাকে প্রহার করতেন, এবং তার ফলে কানের শিরা ছিঁড়ে যাওয়ায় বেশ কিছু দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে অবশেষে তার মৃত্যু হত। এ সব কিছু না হলে আমরা কেউ ইন্দ্র মেঘওয়ালকে চিনতাম না।
এ ঘটনা ঘটে ২০ জুলাই। ১৪ অগস্ট মারা যায় ইন্দ্র। রাষ্ট্র পদক্ষেপ করেছে। মুখ্যমন্ত্রী অশোক গহলৌত ঘোষণা করেছেন আর্থিক ক্ষতিপূরণ। স্বাধীনতা দিবসে প্রথম পাতায় খবর হল, জল খেতে গিয়ে জীবন গেল দলিত ছেলেটার। খবর নয়, মনে হল যেন এক বিশাল শাণিত ব্লেড শোয়ানো আছে। তার তীক্ষ্ণতায় ফালাফালা হয়ে যাচ্ছে আমাদের সভ্য, সফেদ, সুন্দর পোশাক।
১৬ অগস্টের পর আমরা চিনলাম উত্তরপ্রদেশের পণ্ডিত ব্রহ্মদূত উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র, তেরো বছর বয়সি ব্রিজেশ কুমারকে। স্কুলের এক মাসের বেতন আড়াইশো টাকা সময়মতো নিয়ে আসতে না পারায় শিক্ষকের প্রহারে তার মৃত্যু হল। আর তার পরেই ‘আবারও উচ্চবর্ণের শিক্ষকের প্রহারে দলিত ছাত্রের মৃত্যু’ শিরোনাম থেকে আমরা চিনলাম আমাদের ভবিষ্যতের ভারতকে।
ইন্দ্র, ব্রিজেশ সবাই হারিয়ে যাবে স্মৃতির অতলে। ঠিক যে ভাবে হারিয়ে গিয়েছে আত্মহত্যা করা মেধাবী ছাত্রের মুখ। হারিয়ে গিয়েছে সেই দলিত মেয়েটি, যাকে অত্যাচার করে হত্যার পরে তার নগ্ন মৃতদেহের উপরে একটি করে পা তুলে দিয়ে ছবি তুলেছিল উচ্চবর্ণের তিন যুবক। লজ্জায় যে ছবি ঢেকে দিয়েছিল সমাজমাধ্যম। ঠিক সেই ভাবেই হারিয়ে যাবে, যে ভাবে হারিয়ে গিয়েছে ওরাও— ‘জয় শ্রীরাম’ বলতে না চাওয়ার অপরাধে বা গোমাংস বিক্রি বা মজুত করেছে এই সন্দেহে যাঁদের হেনস্থা বা হত্যা করা হয়েছে। হারিয়ে যাবে সেই সব মুখের মতোই, পথ চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে রেললাইনেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন যাঁরা। শুধু স্মরণে থাকবে রক্তাক্ত সেই রুটির গোছা, আবছায়া শরীর। অথবা তা-ও থাকবে না।
আমরা এঁদের ভুলে যাব, কারণ আমাদের দেশভক্তি নেই। মনের ভিতর ‘দেশ’টাই আর নেই। দেশ’ বললে ‘দায়’ নিতে হয়: প্রতিবেশীকে আগলে রাখার দায়, ভিন্ন সুর সঙ্গে নিয়েও সমষ্টিবদ্ধ থাকার দায়। দেশভক্তি থাকলে আর্ত দেশবাসীর প্রতি দায়িত্ব কর্তব্য সহমর্মিতা আসে অন্তর থেকে। দেশভক্তি কি নেই? এই যে এত এত মানুষ স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবে যোগ দিলেন, তাঁরা তবে কী উদ্যাপন করলেন? রাষ্ট্রের আহ্বানে তাঁরা উদ্যাপন করলেন জাতীয়তা। ‘দেশ’, রাষ্ট্রের চেয়ে বেশি প্রাচীন। তাই দেশপ্রেমের ধারণাও জাতীয়তাবাদের ধারণার চেয়ে অনেক বেশি প্রাচীন। দেশের মধ্যে ‘অপর’ নির্মাণের প্রচেষ্টা নেই, আছে একাত্মতা, ভ্রাতৃত্বের ধারণা।
দেশ শুধু কাঁটাতারে ঘেরা এক ভৌগোলিক ভূখণ্ড নয়। পাশ্চাত্যে শিল্প বিপ্লবের পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতির দাবি মেনে যে জাতীয়তাবাদের উদ্ভব হয়েছিল, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে তার উপস্থিতি কতটুকু ছিল তা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও, যা প্রশ্নাতীত তা হল দেশভক্তি, স্বাধীনতা সংগ্রামের চালিকাশক্তি ছিল। সেই দেশভক্তি— আশিস নন্দীর ভাষায়— ‘ওল্ড ফ্যাশন পেট্রিয়টিজ়ম’— নিয়ে দীর্ঘ কাল সুস্থির সমাজজীবন যাপন করছিল ভারত। এই দেশভক্তি প্রতিবেশীর দিকে সন্দিহান হয়ে তাকাতে নয়, সহমর্মী হতে শেখায়। অতীতের সব ক্ষয়ক্ষতির হিসাব বুঝে নিতে নয়, নিজেকে উজাড় করে দিতে শেখায়। ভিন্নতাকে স্বীকার করে নিয়েও তাকে নিজের একটা অংশ হিসেবে দেখা সহজ নয়। যে ধারণা এই কাজটাকে সহজ করতে পারে, তা-ই হল ‘দেশ’।
দেশের ধারণা ভারতের নানা প্রদেশে ছিল নানা রকম। বাংলায় দেশ ছিল ‘ভারতমাতা’, ভূদেব মুখোপাধ্যায় বঙ্কিমচন্দ্র হয়ে অবনীন্দ্রনাথেও ফুটে উঠেছিল যা। পুষ্পাঞ্জলি গ্রন্থে ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের বেদব্যাস-বর্ণিত অপরূপা মাতৃমূর্তি “নিরন্তর অপত্যবর্গ লইয়া সকলকে মাতৃভাবে অন্ন... প্রদান করিতেছেন।” ‘গ্রন্থের আভাস’ অংশে লেখা: “দেবী মাতৃভূমির প্রতিরূপ স্বরূপ।” ‘হিন্দু’ শব্দটিকে ভূদেব মুখোপাধ্যায় যে উচ্চতায় স্থাপন করেছিলেন, সেখানে অপর বলে কিছু ছিল না। বঙ্কিমচন্দ্রের কমলাকান্ত সপ্তমী পূজার দিন দুর্গাপ্রতিমার মধ্যেই জননীকে প্রত্যক্ষ করেছিল, কমলাকান্তের সেই মাতৃমূর্তিও ‘অসংখ্যসন্তানকুল পালিকা’। সবুজ বসনের এই দেবীই দেশ, সন্তান পালনে ব্রতী। অবন ঠাকুরের ‘ভারতমাতা’ দেখতে দেখতেও এই ভাবটিই জাগ্রত হয় না কি?
‘দেশ’ একটি সমষ্টিবদ্ধ ধারণা। স্বাধীনতা এক সমষ্টিগত অর্জন। এই কথা মনে রেখে, চার পাশের আর্ত মানুষের সামান্যতম ক্লেশও দূর করার চেষ্টা না করে, জাত ধর্ম বর্ণ ইত্যাদি খণ্ডিত এককে বিভিন্ন ধরনের অপর তৈরি করে ভেদাভেদ ও বিদ্বেষে মেতে উঠলে এই ‘অমৃত মহোৎসব’-এর কোনও অর্থ হয় না। হাতের নাগালের মধ্যে যে দেশ, যে দেশ বুকের খুব কাছাকাছি— সব কিছু ভুলে, ভিন্নতাকে স্বীকার করেও তাকে আপন করে নিতে না পারলে, বুকে বিদ্বেষের বিষ চেপে ‘প্রতি ঘরে পতাকা’ তুলে আর তার ছবি পোস্ট করে স্বাধীনতার এই চিৎকৃত উদ্যাপন অর্থহীন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy