একুশ বছরের আর্যা রাজেন্দ্রন (ছবিতে) তিরুঅনন্তপুরমের মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হয়ে শিরোনামে উঠে এলেন কিছু দিন আগে। কেরলে আরও কিছু তরুণী নির্বাচিত হয়েছেন স্থানীয় সরকারের মুখ্য পদে, যেমন সারুতি, রেশমা মারিয়াম রয়, রাধিকা মাধবন, আনাস রোসনা স্টেফি। সকলেরই বয়স ২১ থেকে ২৩। কেরলের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বাম, কংগ্রেস, বিজেপি জোটগুলি চেষ্টা করছে তরুণীদের প্রার্থী করতে।
কেরলের বিকেন্দ্রীকরণ শুরু হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান প্রজন্মের পঞ্চায়েত শুরু হওয়ার ১৮ বছর পরে, ১৯৯৬ সালে। প্রথম থেকেই আইনি, আর্থিক ও প্রশাসনিক ভিত্তিটি খুবই শক্তিশালী ছিল বলে বিকেন্দ্রীকরণে ভারতের এক নম্বর স্থানে দ্রুত পৌঁছে যায় কেরল। পঞ্চায়েত ব্যবস্থার রূপরেখা নির্মাণে বড় ভূমিকা ছিল এক বাঙালির: সত্যব্রত সেন। রাজ্য বাজেটের প্রায় চল্লিশ শতাংশ বরাদ্দ করার কথা ছিল স্থানীয় সরকারকে। সেই বরাদ্দের ১০ শতাংশ বাধ্যতামূলক ভাবে নারী উন্নয়নের জন্য রাখতে হবে। এর পাশাপাশি রূপায়ণ করেছিলেন মহিলাদের স্বনির্ভর গোষ্ঠীভিত্তিক ক্ষমতায়নের কর্মসূচি, ‘কুডুম্বশ্রী’। পঞ্চায়েতের কাজের পরিকল্পনা থেকে রূপায়ণ, সব স্তরেই সক্রিয় ছিলেন কুডুম্বশ্রীর মহিলা সদস্যরা। ২০১৫-র স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এগারো হাজার বিজয়িনীর মধ্যে সাত হাজার জন কুডুম্বশ্রীর সদস্য ছিলেন। রাজনীতি এবং প্রশাসনে অভিজ্ঞ এবং দক্ষ মহিলারা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পাবেন, এবং নবীনারা আসবেন তাঁদের জায়গায়, এটাই প্রত্যাশিত। সেটাই কি হল?
না, সেটা ঘটেনি। কেরলের স্বাস্থ্য ও সামাজিক ন্যায় মন্ত্রী শ্রীমতী শৈলজার আক্ষেপ, ১৯৫৭-য় বিধানসভায় ১১৭ সদস্যের মধ্যে ছ’জন মহিলা ছিলেন, ২০১৭ সালে ১৭০জনের বিধানসভায় আছেন মাত্র সাত। রাজনীতির উচ্চস্তরে মেয়েরা পিছিয়েই গিয়েছে খানিকটা। কোচির মেয়র সৌমিনী জৈন বলেন, “সংরক্ষিত আসনে নির্বাচিত হয়েছি বলেই ধরে নেওয়া হয়, আমি অযোগ্য।”
দ্বিতীয় সন্দেহের জায়গা, ২০১৫ সালে কেরলের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন ৩৮,২৬৮ জন মহিলা, এ বারের তুলনায় প্রায় ২০০০ বেশি। উপরে ওঠার সিঁড়ি গিয়েছে কাচের ছাদে। নিরুৎসাহ হয়েই কি রাজনীতি থেকে সরে যাচ্ছেন অভিজ্ঞরা? তাই কি তরুণীদের প্রণোদিত করার চেষ্টা চলছে, স্থানীয় সরকারে তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ পদ দিয়ে?
মনে পড়ে পশ্চিমবঙ্গের অবিভক্ত মেদিনীপুরের সাঁকরাইল ব্লকের কুলটিকরি গ্রাম পঞ্চায়েতের কথা। ১৯৯৩ সালে, সংবিধান সংশোধন রূপায়িত হওয়ার আগেই এই পঞ্চায়েত নির্বাচিত করে শুধু মহিলা প্রতিনিধিদের। ১৩ সদস্যের মধ্যে ৯ জন ছিলেন ২৮ বছরের নীচে। সাত জন ছিলেন জনজাতিভুক্ত, দু’জন দলিত। বিবাহিত সাত জনের মধ্যে তিন জন ‘স্বামীপরিত্যক্তা’। এক ছাত্রী আর এক প্রাথমিক শিক্ষিকা বাদে বাকি সবাই শ্রমজীবী পরিবারভুক্ত। সমাজবিজ্ঞানীদের দৃষ্টি কেড়েছিল কুলটিকরি। কিন্তু ক্রমে সেই সদস্যারা হারিয়ে গেলেন রাজনীতি থেকে। এর আগেও কেবল মহিলা প্রতিনিধিদের পঞ্চায়েত হয়েছিল আশির দশকে, মহারাষ্ট্রের মাঞ্ঝেরাজ গ্রাম পঞ্চায়েতে, পুণের কাছে রালেগাঁও-সিদ্ধিতে। পরে হয়েছিল হরিয়ানার নিমখেডা গ্রামে, ২০০৫ সালে। সন্দেহ হয়, এর অনেকটাই ‘লোক দেখানো’; বাস্তবে মেয়েদের ক্ষমতার সমান ভাগ দিতে নারাজ পুরুষতান্ত্রিক রাজনীতি।
মেয়েদের নির্বাচিত পদ সামলানোর যোগ্যতার প্রশ্ন উঠলেই রাজস্থানের জোধপুর জেলার এক গ্রাম পঞ্চায়েতের কথা মনে পড়ে। ইন্টারভিউ নিতে গিয়েছি পঞ্চায়েত নেতৃত্ব ও গ্রামবাসীদের। এক গলা ঘোমটা টেনে প্রস্তরবৎ বসে আছেন সরপঞ্চ মহোদয়া। সামনে পাগড়ি-গোঁফে শোভিত অন্য সদস্যবৃন্দ। সরপঞ্চ ছাড়া সবাই প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন। এক সময়ে গ্রামবাসীদের এক জন উঠে গেলেন ফোনে কথা বলতে। সরপঞ্চ ঘোমটা খুললেন, ঝরঝরে ইংরেজি আর হিন্দিতে প্রশ্নের জবাব দিলেন। জানা গেল তিনি এমএ পাশ। কিন্তু যিনি উঠে গেলেন তিনি শ্বশুরমশাই। তাই ঘোমটা এবং মৌন।
প??ঞ্চায়েতে মহিলাদের আসন সংরক্ষণ ঘুরে ঘুরে হয়। এ বছর যে পঞ্চায়েতে প্রধানের পদ মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত, পরের বছর সেটা আবার সাধারণ আসন হয়ে যায়। বহু পরিশ্রমে, নানা প্রশিক্ষণে নির্বাচিত মহিলা প্রতিনিধিরা যে প্রশাসনিক দক্ষতা আয়ত্ত করেন, পরে আর তা কাজে লাগে না। কারণ প্রায় সব আসন পুরুষের জন্য ‘সংরক্ষিত’।
কেরলে তরুণীরা বসলেন গুরুত্বপূর্ণ পদে, সুসংবাদ। প্রশ্ন হল, উপরের পদগুলোও কি এ ভাবে ছাড়া হবে মেয়েদের জন্য? অন্য রাজ্যের রাজনৈতিক দল কি এমন করবে? মনে হয় না।
অবসরপ্রাপ্ত আইএএস
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy