Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
Religion

শাসকের চোখে সব ধর্মই সমান

কথাগুলি আজকের নয়। যিনি কথাগুলি বলেছিলেন— বা বলা ভাল যে, এই নির্দেশ দিয়েছিলেন— তিনি কোনও দার্শনিক বা ধর্মগুরু নন, রাজনৈতিক নেতাও নন।

Religion

—ফাইল চিত্র।

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৮:৩৩
Share: Save:

অন্য ধর্মকে ছোট করে নিজের ধর্মের গৌরব বৃদ্ধি সম্ভব নয়। বরং তাতে নিজের ধর্মেরই অবমাননা হয়। তাই নিজের এবং অন্য, সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। একে অন্যের ধর্মের কথা শুনতে হবে এবং তা থেকে শিখতে হবে। সেই শিক্ষার মধ্য দিয়েই আরও মহৎ হয়ে ওঠা যাবে।”

কথাগুলি আজকের নয়। যিনি কথাগুলি বলেছিলেন— বা বলা ভাল যে, এই নির্দেশ দিয়েছিলেন— তিনি কোনও দার্শনিক বা ধর্মগুরু নন, রাজনৈতিক নেতাও নন। তিনি ছিলেন প্রায় ২৩০০ বছর আগে এই উপমহাদেশের শক্তিশালী সম্রাট। সম্রাট অশোক। নিজের দ্বাদশ শিলালেখতে তিনি যা বলেছিলেন, তার সারকথা ওই কয়েকটি লাইন। আধুনিক জাতিরাষ্ট্র, সংবিধান, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ধারণা তখন ছিল না। তবুও রাজা প্রিয়দর্শী অশোকের শিলালেখতে উচ্চারিত এই কথাগুলি রাজধর্মকেই চিহ্নিত করে। ব্যক্তি শাসকের ধর্মের থেকে যা পৃথক। বর্তমানে ভারতে অতীতের গৌরব পুনরুদ্ধারের অপরিসীম প্রয়াস লক্ষ করা যায়। সেই প্রয়াসের বেশির ভাগই অবশ্য প্রাচীন ভারতকে এক কল্পরাজ্যের স্তরে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু এই উপমহাদেশেই কার্যত নিরঙ্কুশ ক্ষমতাধর সম্রাট যে রাজধর্মের দর্শনের পাঠ দিয়েছিলেন, সে দিকে বর্তমান শাসকেরা আদৌ দৃষ্টিপাত করেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে।

একবিংশ শতকে দাঁড়িয়েও ধর্মীয় গোষ্ঠীর পারস্পরিক ঘৃণার আবহ যে কোনও সুস্থ নাগরিককে আহত করে ঠিকই, কিন্তু এ কথাও ঠিক যে, উপমহাদেশে প্রাচীন কাল থেকেই যে ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলির মধ্যে পারস্পরিক বৈর বা সংঘাত ছিল, সে কথাও অশোকের লেখ থেকেই স্পষ্ট। কারণ, সংঘাত না থাকলে সংহতির বার্তা শাসককে দিতে হত না। সেই বার্তা দিতে গিয়েই ব্যক্তিসত্তা থেকে শাসককে পৃথক করেছিলেন অশোক। ব্যক্তি অশোক যে ধর্মেরই অনুসারী হোন না কেন, শাসক হিসাবে তিনি সমদর্শী। তাই তাঁর লেখতে ‘ব্রাহ্মণ’ এবং ‘শ্রমণ’, দুইয়েরই সমান উল্লেখ পাওয়া যায়। ধর্মযাত্রায় বেরিয়ে ব্রাহ্মণ এবং শ্রমণ, উভয় দলকেই তিনি দান করেন। রাজকীয় লেখতে সব ধর্মগোষ্ঠীর (লেখর ভাষায় পাষণ্ড) উদ্দেশেই তিনি সমান সম্মান প্রদর্শন করেন— প্রতি ধর্মগোষ্ঠীকে পারস্পরিক বিবাদ, কুৎসা, কুকথা বন্ধ করে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে বলেন। এ কথা যে শুধু সংসারত্যাগী ধর্মপ্রচারকদের জন্য নয়, গৃহস্থদের জন্যও প্রযোজ্য, তাও রাজকীয় লেখতে উল্লেখ করা হয়েছে। অশোক জানিয়ে দেন, তাঁর রাজত্বে সব ‘পাষণ্ড’রাই সব জায়গায় সমান ভাবে বসবাস করতে পারবেন। অর্থাৎ, একই জায়গায় ভিন্ন মতের সহাবস্থান থাকবে এবং এ ভাবেই ভেদকে স্বীকার করে সমবায়ের মাধ্যমে সমন্বয়ের পথ প্রশস্ত করে দেন মৌর্য সম্রাট।

এই বিষয়টিকেই প্যাট্রিক অলিভেল, তাঁর অশোক: পোর্ট্রেট অব আ ফিলসফার কিং বইয়ে বিস্তারিত ভাবে দেখেছেন। প্যাট্রিক এ ক্ষেত্রে ‘একুমেনিজ়ম’ শব্দটি ব্যবহার করলেও শব্দার্থে শুধু খ্রিস্টধর্মের বিশ্বভ্রাতৃত্ব বোধের আবর্তে আটকে থাকেননি। বরং শব্দটির লাতিন এবং গ্রিক উৎস ধরে সংস্কৃত ভাষার ‘বসুধৈব কুটুম্বকম্’-এ পৌঁছতে চেয়েছেন, যা কিনা সমাজের সকল স্তরকে নিয়েই শাসকের পরিবারের ধারণা বোঝায়। শুধু তা-ই নয়, ‘একুমেনিজ়ম’-এর ধারণা যে শুধু সহনশীলতা বা মিলেমিশে থাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং অপরের ধর্মের সঙ্গে নিরন্তর যোগাযোগ এবং পারস্পরিক আদানপ্রদানের মাধ্যমে ‘সমবায়’ তৈরি, সে কথাও তুলেছেন প্যাট্রিক।

এই পারস্পরিক আদানপ্রদানের ভাবনা থেকেই অশোকের ‘ধম্ম’-এর প্রসঙ্গ আলোচনায় আসতে পারে। যে ‘ধম্ম’ আদতে কোনও একটি ধর্মমত নয়, বরং সমাজের সকল নাগরিকের জন্য প্রযোজ্য একটি নৈতিক আদর্শ। বহুত্ববাদী এবং বিভিন্ন ধারায় ভাগ হওয়া প্রজাদের একটি নির্দিষ্ট পরিচয় তৈরি করতে চেয়েছিলেন অশোক। যার অর্থ, ব্যক্তি জীবনে পৃথক ধর্মীয় সত্তা থাকলেও সামাজিক জীবনে একটি পৃথক পরিচিতি গঠন। সেই ধম্ম পালনের মধ্য দিয়ে শাসক এবং শাসিতের মধ্যে যোগসূত্র তৈরিকেও অস্বীকার করা যায় না। রাজত্বের মধ্যে ধর্ম, জাতিগত বিভেদকে রেখেও অভিন্নতা তৈরির এই দূরদর্শী পদক্ষেপ যেমন শাসকের রাজনৈতিক স্থিতাবস্থার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ তেমনই এ-ও মেনে নিতে হয় যে, ব্যক্তি অশোক তাঁর নিজের পছন্দের ধর্মমতকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার বদলে শাসক হিসাবে নতুন দর্শনের প্রয়োগ করেছিলেন। যা আদর্শগত ভাবে তাঁর বিরোধীদেরও প্রভাবিত করেছিল। প্যাট্রিকের লেখাতেই উঠে এসেছে, কী ভাবে আপস্তম্ব ধর্মসূত্রও বর্ণজাতি বা লিঙ্গ ভেদের বাইরে সার্বিক নৈতিক আদর্শের কথা তুলে ধরছে, যাকে অশোকের ঐতিহ্যের অনুসারী হিসাবেই তিনি দেখেছেন।

সমাজের বহুত্বকে স্বীকৃতি দিয়েও পারস্পরিক সমঝোতার বিনিময়ে সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় সংহতি রক্ষা— এই নীতির কারণেই প্রায় আড়াই সহস্রাব্দ প্রাচীন অশোকের লেখটি আজকের সময়েও প্রাসঙ্গিক, গুরুত্বপূর্ণ। সমাজে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে বিভেদ এবং সংঘর্ষ মাথাচাড়া দিলে তা নাগরিক এবং রাষ্ট্র, উভয়ের পক্ষেই সঙ্কট ডেকে আনতে পারে। কল্যাণকর রাষ্ট্রের শাসক যে শুধু একটি ধর্ম বা সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হতে পারেন না, তা-ও ওই দর্শন থেকেই উঠে আসে।

অন্য বিষয়গুলি:

Religion Politics Society
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy