ভারতের ১৪০ কোটি জনসংখ্যাকে বলা হয়েছে ‘১৪০ কোটি সুযোগ’। —ফাইল চিত্র।
আমেরিকার স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির জীববিদ্যার অধ্যাপক পল এরল্যাখ দিল্লি আসেন ১৯৬৬-তে। দিল্লির অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েই শুরু তাঁর ১৯৬৮-র বই, দ্য পপুলেশন বম্ব। “মানুষ খাচ্ছে, মানুষ কাপড় কাচছে, মানুষ ঘুমোচ্ছে। মানুষ যাতায়াত করছে, তর্ক করছে, চিৎকার করছে।... ট্যাক্সির জানলা থেকে হাত বার করছে, ভিক্ষা করছে।... মানুষ বাসে ঝুলছে, মানুষ চলেছে পশু নিয়ে। মানুষ, মানুষ, মানুষ, মানুষ... আমি বুঝতে পারলাম বেশি জনসংখ্যা কাকে বলে।”
জনসংখ্যা বাড়তে বাড়তে ফেটে পড়বে বোমার মতো— জনবিস্ফোরণ-সংক্রান্ত এই ভূতটাই এরল্যাখ-এর বইয়ের প্রতিপাদ্য। এই ভূত তাড়িয়ে ফিরেছে দুনিয়াকেও। বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারিত হয়েছে এই নিয়ো-ম্যালথাসিয়ান তত্ত্বকে ঘিরেই। স্বস্তির কথা, আজকের দুনিয়া মোটের উপর বিশ্বাস করে না যে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি মানবিক এবং পরিবেশগত বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। রাষ্ট্রপুঞ্জের পপুলেশন ফান্ড-এর ‘স্টেট অব ওয়ার্ল্ড পপুলেশন’-এর সাম্প্রতিক রিপোর্টের শিরোনামই হল, ‘এইট বিলিয়ন লাইভ্স, ইনফাইনাইট পসিবিলিটিজ়’। ভারতের ১৪০ কোটি জনসংখ্যাকে বলা হয়েছে ‘১৪০ কোটি সুযোগ’।
ম্যালথাসের তত্ত্বের তাড়নায় ষাটের দশক থেকেই চিন কিংবা ভারতের উপরে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য আন্তর্জাতিক চাপ ছিল। ভারত অবশ্য পরিবার পরিকল্পনার প্রকল্প আনে ১৯৫২-তেই। ১৯৭৬-এ জাতীয় জনসংখ্যা নীতি। চিন ‘এক সন্তান নীতি’-র মতো অতি-আক্রমণাত্মক পদ্ধতির প্রচলন করে ১৯৮১-তে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে তা সাহায্য করেছে নিশ্চয়ই, কিন্তু এখন আবার জনসংখ্যা বাড়াতে হিমশিম খাচ্ছে তারা। ‘গণতন্ত্র’ কিন্তুবড্ড সাহায্য করেছে ভারতকে। জরুরি অবস্থার সময়কার ‘নসবন্দি’র রাজনৈতিক ফলাফল দেখে লোকজন চট করে বুঝে যায়, গণতন্ত্রে এ ধরনের জোর খাটানোর ফল হবে উল্টো। সে পথে আর হাঁটেনি ভারত।
তবে, জনসংখ্যাকে ‘অফুরান সম্ভাবনা’ হিসাবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিটাই ছিল না কয়েক দশক আগে। তাই আজ যখন মোট জনসংখ্যার নিরিখে চিনকে টপকে ভারত দুনিয়ার সবচেয়ে জনবহুল দেশ হয়ে উঠেছে, তখন এই তথ্যটি বিপদসঙ্কেত না জনসম্পদের স্ফুরণ, তা নিয়ে আলোচনার অবকাশ আছে। এ বুঝি স্কুলে লেখা ‘বিজ্ঞান’ নিয়ে রচনার মতো— আশীর্বাদ আর অভিশাপের সংমিশ্রণ। তবু, সর্বাধিক জনসংখ্যার দেশের তকমা ভারতে আসাটা দুনিয়ার ভারসাম্যের ক্ষেত্রেই এক মৌলিক পরিবর্তন। এর ফলে রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের স্থায়ী আসনের দাবি কি জোরদার হবে? ‘জনবিস্ফোরণ’-এর সঙ্গে ‘ব্রেন ড্রেন’ নিয়েও হইচই হয়েছে যথেষ্ট। ২০২১-এর বই দ্য পপুলেশন মিথ-এ প্রাক্তন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এস ওয়াই কুরেশি বলছেন, দুই ধারণাই সময়ের সঙ্গে বদলেছে। এ-ও যেন এক অর্থনৈতিক বিপ্লবের উৎস, বিদেশবাসী ভারতীয়রা যে বছরে ৯০ বিলিয়ন ডলার পাঠান এ দেশে।
ভারতের জনসংখ্যা এবং জনবিন্যাসের চরিত্রটা দেখা যাক। জনসংখ্যা বাড়া-কমার গুরুত্বপূর্ণ সূচক টোটাল ফার্টিলিটি রেট বা টিএফআর। সোজা কথায়, এক জন নারী তাঁর জীবনকালে গড়ে যত জন সন্তানের জন্ম দেন, তা-ই। মোটামুটি ধরা হয়, টিএফআর-এর মান ২.১ হল ‘প্রতিস্থাপনযোগ্য হার’— অর্থাৎ, প্রত্যেক নারীর সন্তানসংখ্যা যদি গড়ে ২.১ হয়, তবে পরবর্তী প্রজন্মেও দেশের জনসংখ্যা মোটামুটি অপরিবর্তিত থাকে। ১৯৫০ নাগাদ ভারতের টিএফআর ছিল ৫.৭, যা এখন ২.১৩৯— প্রায় প্রতিস্থাপনযোগ্য মান। এ এক ‘অর্জন’ বইকি। তবে দেশে তরুণ প্রজন্ম দলে ভারী, জনসংখ্যা নাকি তাই বাড়তেই থাকবে ২০৬৪ পর্যন্ত, তার পর কমবে। এ সব ভবিষ্যদ্বাণী অবশ্য এখনকার এবং অতীতের জনবৃদ্ধির তথ্য, ভবিষ্যৎ সম্পর্কিত অনেকখানি অনুমান এবং একটা মডেলের ভিত্তিতে করা। সাধারণত এ ধরনের দীর্ঘমেয়াদি অনুমান ভবিষ্যৎ অনুমানের তুলনায় চমক জাগায় বেশি। সময়ের সঙ্গে প্রযুক্তি, দেশের নীতি, মানুষের ধ্যানধারণা সবই তো পাল্টায়।
তারুণ্যে ভরা এ দেশ। জনগণের বয়সের মিডিয়ান বা মধ্যমা হল ২৮.২ বছর, অর্থাৎ ৫০% মানুষের বয়স ২৮.২-এর কম। চিনের ক্ষেত্রে মধ্যমা ৩৯, আর উত্তর আমেরিকায় ৩৮.৪। এক জন গড় চিনা বা আমেরিকানের চেয়ে এক জন গড় ভারতীয় তাই অন্তত ১০ বছরের ছোট। ভারতের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি মানুষ কর্মক্ষম বয়ঃসীমার মধ্যে। সেই তরুণরাই জোগাবে বিপুল শ্রমশক্তি, গড়বে উপভোক্তার মস্ত বাজার। দুনিয়ার জ্ঞান এবং নেটওয়ার্ক-পণ্যের অর্থনীতিও নিয়ন্ত্রণ করবে এরাই। ‘অ্যাপল’ হাতে টিম কুকের এ দেশে দৌড়ে আসা অকারণ নয়।
রাষ্ট্রপুঞ্জের অনুমান অনুসারে, এ বছরের ১ জুলাই ভারতের জনংখ্যা ১৪৩ কোটির কাছাকাছি হতে চলেছে। এই বিরাট জনসংখ্যার চ্যালেঞ্জও প্রভূত। তাদের খাওয়াতে-পরাতে হবে, দিতে হবে নানা সামাজিক পরিষেবা। বিপুল শ্রমশক্তি শুনতে বেশ, কিন্তু এদের কাজ জোগানো সহজ নয়। দেশের কর্মক্ষম জনসম্পদের মেরেকেটে ৪০ শতাংশ নাকি কর্মে নিযুক্ত বা কাজ পেতে সচেষ্ট। দেশের সাম্প্রতিক বেকারত্বের হার আবার ৭-৮ শতাংশের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছে। জলবায়ু এবং পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়টাও সেই সঙ্গে হয়ে পড়ে আরও কঠিন।
কোনও দেশের অর্থনৈতিক ভাবে অনুৎপাদনশীলদের, অর্থাৎ শিশু এবং বৃদ্ধের মোট সংখ্যাকে বাকিদের সংখ্যা দিয়ে ভাগ করে পাওয়া যায় ‘ডিপেনডেন্সি রেশিয়ো’ বা ‘নির্ভরতা অনুপাত’। এই অনুপাত যত কম, ততই অর্থনীতির পক্ষে ভাল। ভারতের জনসংখ্যার বিপুল অংশ কর্মক্ষম বয়ঃসীমায়, তাই এই অনুপাতটা আকর্ষণীয়। কিন্তু, আজকের বিপুল সংখ্যক তরুণ বুড়ো হয়ে পড়বে ২০-৩০ বছরেই। তাই শিশুর সংখ্যা বড় একটা না বাড়লেও লক্ষণীয় ভাবে বাড়বে ‘নির্ভরতা অনুপাত’, অর্থনীতিতে যা সমস্যা সৃষ্টি করবেই।
তাই সামগ্রিক জনসংখ্যার ছবি দেখে তার রূপ-বৈচিত্র, অর্ন্তনিহিত সম্ভাবনা এবং বিপদ কোনওটাই বোঝা যাবে না পুরোপুরি। ঠিক নীতি নির্ধারণের জন্য ছবিটার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের প্রয়োজন। নারী-পুরুষের অনুপাত, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় এবং ভৌগোলিক ক্ষেত্রের মধ্যে জনবিন্যাসের পরিবর্তনে তারতম্য ইত্যাদি বিষয় ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’-এর হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ। এ সবের তত্ত্বতালাশও বেশ কঠিন। জনসংখ্যা বেশি হলে অসাম্যের সম্ভাবনাও বেশি। বিশেষত ভারতের মতো বৈচিত্রপূর্ণ দেশে। আর যে কোনও ক্ষেত্রেই অনভিপ্রেত অসাম্য তৈরি হলে প্রভাবিত হতে পারে সামাজিক সুস্থিতি। প্রয়োজন তাই নিরন্তর তথ্য বিশ্লেষণ, ঠিক পরিকল্পনা ও তার রূপায়ণ।
যেমন, দেশের আয় বৃদ্ধির বেশিটাই মূলত শহুরে ধনীদের হাত ধরে হলেও, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সিংহভাগ ঘটছে গাঙ্গেয় অববাহিকার গ্রামীণ অনুন্নত এলাকায়। আবার উত্তরের অনেক রাজ্যেই ‘টিএফআর’ ২.১-এর চাইতে অনেক বেশি, আবার দক্ষিণের নানা রাজ্যে তা বেশ কম। ফলে উত্তরের রাজ্যগুলিতে জনসংখ্যা বাড়ছে হুহু করে, দক্ষিণে তা কমছে লক্ষণীয় ভাবে। এ সবের রাজনৈতিক উত্তাপ আমরা হয়তো বুঝব ভবিষ্যতে। তা ছাড়াও, পরবর্তী কয়েক দশকে দেশের উত্তর ভাগ থাকবে অনেক তরুণ, আর ক্রমেই বুড়ো হয়ে যাবে দক্ষিণ ভারত।
আর একটা কথা জরুরি। এই বৃদ্ধি এক রাতে ঘটেনি। জনসংখ্যার পরিবর্তন এক মসৃণ রেখচিত্র, যা বয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। তার সুবিধাগুলো যেমন নিংড়ে নেওয়া হয়েছে, তেমন দায়ভারটা বহনেরও চেষ্টা চলছে দীর্ঘ দিন। তাই প্রান্তিক ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ খুব বেশি না হওয়ারই কথা।
তবু, জনসংখ্যা বা জনবিন্যাসই হয়তো মুখ্য সূচক হতে পারে না। জনগণের জীবনশৈলীও গুরুত্বপূর্ণ। পল এরল্যাখ-এর বইয়ে দিল্লির অস্বস্তিকর বর্ণনার কথা ভাবা যাক। ১৯৬৬-তে দিল্লির জনসংখ্যা কিন্তু ৩০ লক্ষেরও কম। প্যারিসের জনসংখ্যা তখন ৮০ লক্ষ, লন্ডনের ৭৮ লক্ষ। প্যারিস কিন্তু ১৯৬৬-তেই পরিশীলন এবং লালিত্যের ছবি রূপে চিত্রিত হচ্ছে। স্পষ্টতই, সংখ্যার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ জীবনধারা। জীবন এবং জীবনশৈলীর গুণগত মানে উৎকর্ষ না থাকলে ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’-এর ষোলো আনাই মিছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy