শিক্ষা: উন্নত গণতন্ত্র থেকে সহিষ্ণুতার পাঠ নিতে কি ব্যর্থ নরেন্দ্র মোদী? আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে, নভেম্বর ২০২২। ফাইল চিত্র
তিনটি আলাদা ঘটনা। তিনটিই বুঝিয়ে দেয় আমাদের বর্তমান সরকারের অসহিষ্ণুতা কতখানি। সবচেয়ে সাম্প্রতিক ঘটনা— গুজরাত দাঙ্গায় প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা বিষয়ে বিবিসির তথ্যচিত্র দ্য মোদী কোয়েশ্চেন-এর বিরুদ্ধে বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্রের অগ্ন্যুদ্গার। এর থেকে স্পষ্ট হয়ে গেল, এই সরকার কতটাই আক্রমণাত্মক এবং, একই সঙ্গে, কতটাই রক্ষণাত্মক। তথ্যচিত্রে প্রধানমন্ত্রীর সম্পর্কে যে চরম অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে, তাতে মন্ত্রী এবং সরকারি কর্তাদের উদ্বেগের সীমা-পরিসীমা রইল না। সবাই মিলে ধেয়ে গেলেন বিবিসির দিকে, অপবাদের বন্যা বইয়ে দিলেন। এমনও দাবি করলেন যে, ভারত জি২০’র নেতা দেশ মনোনীত হওয়ার ফলেই নাকি রাজনৈতিক ফন্দি এঁটে ওই তথ্যচিত্রের মাধ্যমে ভারতের ভাবমূর্তি নষ্ট করা হচ্ছে। ভারতে সর্বত্র যাতে ওই তথ্যচিত্র দেখানো না হয়, তা আটকাতে কোমর বেঁধে নেমে পড়ল সরকার। সমাজমাধ্যমে ওই তথ্যচিত্রের ‘লিঙ্ক’টি যাতে আদানপ্রদান না করা যায়, তার ব্যবস্থা করা হল— ইউটিউবে যে কপিটি ‘আপলোড’ করা হয়ে গিয়েছিল, সেটা নামিয়ে নিতে বাধ্য করল। অর্থাৎ, প্রধানমন্ত্রীর বিদেশি সমালোচকদের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানানোর ব্যবস্থা হল সর্বশক্তি দিয়ে।
ব্যাপার দেখে আমার মনে পড়ছিল কয়েক মাস আগের আর একটি ঘটনা, যখন এক বিখ্যাত বিদেশি— ইজ়রায়েলি— চলচ্চিত্র পরিচালক নাদাভ লাপিদ দ্য কাশ্মীর ফাইলস ছবিটির তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। তত দিনে সকলেই জেনেছি, মোদী সরকার কী ভাবে এই ছবিটির প্রচার করেছে। এ দিকে ভারতের আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে জুরি-র প্রধান হিসেবে নাদাভ লাপিদ বিস্ময়-ক্ষোভ প্রকাশ করলেন, এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ফেস্টিভ্যালে কী ভাবে এই ‘অশালীন’ এবং ‘প্রচারধর্মী’ ছবি প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত হল! কোনও দিক দিয়েই তো এই ছবি প্রতিযোগিতার অন্যান্য ছবির ধারেকাছেও আসে না! লাপিদের এই বিবেচনা সম্পূর্ণত তাঁর শিল্পবোধ-সঞ্জাত, চলচ্চিত্রবোধ থেকে উদ্ভূত। এবং তাঁর অবস্থান থেকে এই বিবেচনার অধিকার নিশ্চয় তাঁর আছে। কিন্তু সরকারের চেলাচামুণ্ডারা তাঁর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল, তিনি নাকি কাশ্মীরি পণ্ডিত সমাজের নির্যাতনকে ছোট করার জন্যই এ সব বলছেন। এই অভিযোগের কোনও অর্থই থাকতে পারে না, কিন্তু এর পর ইজ়রায়েলি রাষ্ট্রদূতকে তাঁর দেশের নাগরিক লাপিদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করতে বাধ্য করা হল, এমনকি ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ডিরেক্টরেট-এর যে বেচারা কর্তা লাপিদকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন জুরি-প্রধান হওয়ার জন্য, তাঁকে বদলি করানো হল! সন্দেহ নেই, দুর্ভাগা লাপিদ এর পর ভারত থেকে আর কোনও আমন্ত্রণ বা ভিসা পাবেন না, অন্তত যত দিন বিজেপি সরকার এ দেশে ক্ষমতায় রয়েছে।
সরকারের এই মাথা-গরম আচরণের একটা তৃতীয় উদাহরণও দেওয়া যেতে পারে। গত বছর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞরা যখন হিসেব কষে বলেছিলেন যে, কোভিড অতিমারিতে ভারতে মৃত্যুর সংখ্যা অন্তত পাঁচ থেকে দশ গুণ কমিয়ে দেখানো হয়েছে, আসল সংখ্যাটা দাঁড়ায় ৩০ থেকে ৫০ লক্ষ— সেই সময়ও ভারতের সরকারি কর্তাদের মেজাজ ছিল দেখার মতো। ভয়ঙ্কর ঔদ্ধত্যের সঙ্গে তাঁরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এ বিষয়ে কথা বলার অধিকার, এমনকি তাদের পরিসংখ্যান সংগ্রহের পদ্ধতি, সব কিছুকেই চ্যালেঞ্জ করে বসলেন। এ দিকে আমরা সবাই জানি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোনও হেঁজিপেঁজি ব্যাপার নয়, রাষ্ট্রপুঞ্জের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান, কোভিড অতিমারির সময়ে যে প্রতিষ্ঠানের আন্তঃ-সরকারি ‘এগজ়িকিউটিভ কমিটি’র নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী স্বয়ং। আর এখন, ভারত সরকারের দাবি, সরকারি হিসেব একদম ঠিকঠাক— বাকি যাঁদের মৃত বলে ‘হু’ থেকে দাবি করা হচ্ছে, তাঁরা অতিমারির সময়ে মারা গিয়েছেন অন্যান্য কারণে।
তিনটি ঘটনার মধ্যে কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যেতে পারে। প্রথমত, সহনশীলতার অত্যাশ্চর্য অভাব— মাত্রাতিরিক্ত স্পর্শকাতরতা বা অপরিণত মানসিকতা— যেটা কোনও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানের পক্ষেই সাজে না, সরকারের কথা তো ছেড়েই দিলাম। সাজে না, কেননা তাতে তাদের নিজেদের মর্যাদারই হানি হয়। এত বড় রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন সরকার— গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত সরকার— এমন আচরণ করছে দেখলে অদ্ভুত লাগে, কেননা গণতন্ত্রে তো নানা রকম সমালোচনা চার দিকে উড়তে থাকারই কথা, সেটাই তো দস্তুর, নয় কি!
দ্বিতীয়ত, বর্তমান সরকার একটা বিষয় পুরোপুরি গুলিয়ে ফেলেছে। নিজের কাজের সমালোচনা এবং ভারতের জাতীয় সম্মানরক্ষার দায়িত্ব— এই দুটো জিনিস তাদের মাথায় একাকার হয়ে গিয়েছে। অবশ্যই, তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে বসেছে দ্বিতীয়টাই। জাতীয় সম্মান এক অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ, কিন্তু দেশ বিষয়ে যা কিছু বলা হয় তার সবটাই এ ভাবে জাতীয় সম্মানের সঙ্গে যুক্ত করা যায় না। এমন যুদ্ধং দেহি ভাব আসলে ‘জাতীয় সম্মান’ বিষয়টাকে ভঙ্গুর আর খেলো করে দেয়, যেন মনে হয় দেশের সরকারের বিরুদ্ধে যে কোনও সমালোচনাই দেশের সম্মান নষ্ট করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। ঠিক এই ভাবেই ভারতে দারিদ্র বিষয়ক সরকারি তথ্য-পরিসংখ্যান থেকে শুরু করে ভারতে চিনের আগ্রাসনের প্রকৃত খবরাখবর— সবই সরকার থেকে প্রবল ভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক এই প্রবণতা।
শেষত, এটা পরিষ্কার যে বিদেশে নিজের ইমেজ নিয়ে বর্তমান সরকারের মাথাব্যথা বড্ড বেশি। বাইরে কে কী বলল, তা নিয়ে মোদী সরকার অতিমাত্রায় স্পর্শকাতর, অন্যান্য সরকারের তুলনায় অনেক বেশি। তবে কিনা, সরকারি মুখপাত্রদের এত খোঁচা দেওয়া মন্তব্য ও অসহিষ্ণুতা এও বুঝিয়ে দেয় যে, বিদেশি সমালোচনাগুলি আসলে একেবারে চাঁদমারিতে গিয়েই লাগছে, এবং দেশের অভ্যন্তরীণ সমালোচনার মতো সেগুলিকে রাজনৈতিক বিরুদ্ধতার প্রকাশ বলে উড়িয়েও দেওয়া যাচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী মোদী ও মোদীর ভারতের চাকচিক্য অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই অধিকাংশ দেশের সরকার যে সব সমালোচনা গায়েও মাখত না, সেগুলো নিয়ে এই সরকারের প্রতিক্রিয়া এত প্রচণ্ড।
কথাটা হল, কোনও আত্মমর্যাদাপূর্ণ সভ্যতা, বিশেষত গণতন্ত্র, সাধারণত এমন আচরণ করে না। প্রতিবাদ বা সমালোচনা সেই সমাজের স্বাভাবিক আদানপ্রদানের মধ্যেই থাকার কথা। যে কোনও রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আসতেই পারে, এবং সেই প্রতিবাদের অধিকার যে অন্যদের আছে, এই সরল সত্য মেনে নেওয়ারই কথা। এমন সমালোচনা বা মতবিরোধকে জায়গা দেওয়া, সমালোচকদের কথা শোনা, শুনে মন দিয়ে বোঝার চেষ্টা করা, এবং বুঝে নিয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসা, এটাই প্রত্যাশিত। তার বদলে, কেবল একটিমাত্র দিক দিয়ে সরকারের যে কোনও কাজকে দেখা, আর অন্য যে কোনও দিক থেকে দেখাকে অনৈতিক বা অনুচিত বলে দাগিয়ে দেওয়া— এটা ‘বানানা রিপাবলিক’-এর চরিত্র— কোনও সুস্থ স্বাভাবিক গণতন্ত্রের চরিত্র নয়।
অনুসন্ধানের অভ্যাস, প্রতিবাদ ও তর্কবিতর্কের সংস্কৃতি ভারতীয় সভ্যতার দীর্ঘ ঐতিহ্য, সেই পুরাকাল থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত। অথচ এই ধরনের কাজকর্মের মধ্য দিয়ে এই সরকার এবং তার প্রতিনিধিরা ভারতের মুখ কালিমালিপ্ত করছেন, আমাদের দীর্ঘ ঐতিহ্যকে ধ্বংস করছেন। তার চেয়ে অনেক ভাল হত যদি উপরের এই সব কয়েকটি ক্ষেত্রে সরকারের হর্তাকর্তারা নিজেদের একটু উঁচুতে বসিয়ে বলতে পারতেন, হ্যাঁ, ঠিক আছে, সমালোচকরা সমালোচনা করতেই পারেন, তবে তার সঙ্গে সরকার একমত নয়। কিংবা, কিছু ক্ষেত্রে এও স্বীকার করা যেতে পারত যে হয়তো সমালোচকদের কাছে থেকে দু’-একটা কথা গ্রহণ করারও আছে। পরিবর্তে কেবল চেঁচামেচি আর অতিপ্রতিক্রিয়া দেখিয়ে একে তো বিদেশিদের অসম্মান করা হচ্ছে, তাঁদের বক্তব্যের অমর্যাদা হচ্ছে, এবং তার সঙ্গে নিজেদের দুর্বলতা আর ফাঁকগুলিকেও দ্বিগুণ ভাবে প্রকট করা হচ্ছে।
দেশের সরকার তো ঠিক সদ্য-যৌবনপ্রাপ্ত কিশোর নয়। তেমন আচরণও তার বন্ধ করা উচিত।
সাংসদ, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy