চোদ্দো বছরে আইপিএল-এর ভাবমূর্তি অনেকটাই বদলেছে— এতে ভাল খেললে এখন শুধু টাকা নয়, সাদা-বল তো বটেই, এমনকি টেস্ট দলেও জায়গা মিলতে পারে। আইপিএল থেকেই উঠে আসা ভারতের ‘নতুন’ খেলোয়াড়রা বছরের গোড়াতে অস্ট্রেলিয়াকে নাস্তানাবুদ করে এসেছিল; তার পর দেশের মাটিতে ইংল্যান্ডকেও ধরাশায়ী করেছে।
অস্ট্রেলিয়ার কোচ জাস্টিন ল্যাঙ্গার বলেছিলেন, “দেড়শো কোটির মধ্যে থেকে তো কয়েক জন ভাল খেলোয়াড় উঠে আসবেই।” আবার, ইমরান খান বললেন, “ভারত ভাল ‘সিস্টেম’ তৈরি করেছে, তারই সুফল মিলছে।” কার কথা ঠিক?
আমাদের দেশের একটা সমস্যাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় এই দুই বিপ্রতীপ অবস্থান। সাফল্যের গল্পে নিহিত আছে এক বৈপরীত্য, তারকা আর সাধারণের মধ্যে এক বিস্তর ব্যবধান। যে দেশের অধিকাংশ মানুষ নিরক্ষর, সেই দেশের শিক্ষাতেই সাহিত্য-বিজ্ঞান-অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার মেলে; যে দেশের বলিউডি নাচা-গানা দেখে হাসি পায়, সেই দেশেরই শিল্পী হিসেবে রবিশঙ্কর-সত্যজিৎ-রহমান বিশ্ব-সংস্কৃতির মঞ্চে সেরার শিরোপা পান; যে দেশের বিপুলাংশ গরিব, এমনকি দারিদ্রসীমারও নীচে, সেই দেশ থেকেই কিন্তু বেশ কয়েক জন বিশ্বের ধনকুবের তালিকায় স্থান পান, প্রতি বছর।
তর্কের খাতিরে যদি মেনেও নিই, এগুলোর কোনওটাই বরাতজোরে ঘটেনি, অথবা গাণিতিক পরিভাষায় যাকে ল’ অব লার্জ নাম্বার বলে, তার ফল নয়— এক উৎকৃষ্ট (শিক্ষা) ব্যবস্থার গুণে ঘটেছে— তবু আর একটা নীতিগত প্রশ্ন ওঠে। কোনও এক ‘সিস্টেম’-ই যদি এই ‘সুফল’-এর জন্ম দেয়, সেটাই কি তবে চালানো উচিত? প্রদীপের তলায় তো অন্ধকার থাকবেই, সে কথাটা মেনে নেব, না কি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতার মতো দাবি করব: ‘এই দারিদ্র্যই বঁাটা হোক, তার সঙ্গে অন্ধকারও হোক’?
আইপিএল-এর মতো ‘সিস্টেম’ সব খেলোয়াড়ের অবস্থানের উন্নতি না-ও চাইতে পারে। আধুনিক সমাজ ‘কস্ট বেনিফিট’-এর অঙ্ক কষে— সকলের জন্য ব্যবস্থা করার পরিবর্তে শুধুমাত্র পারদর্শীদের উৎসাহ দিলেই আমাদের লাভ অনেক বেশি। আইপিএল অবধিও যেতে হবে না— কোনও স্কুলের দলের কথাই ধরুন। স্কুলের কয়েক জন ভাল খেলতে পারলেই যথেষ্ট— তাদের নিয়েই স্কুল-টিম গড়া যায়। অতএব, সবাইকেই ভাল খেলতে হবে, গান গাইতে হবে, এমনকি পড়াশোনায় এগোতে হবে, তা নিশ্চিত করার দায় কারও নেই। গুরুসদয় দত্তের অনুপ্রেরণায় আমরা ব্রতচারী হতে শিখিনি। আবার, ‘লার্জ নাম্বার’-এর উপর পুরো ভরসা না রেখে, একটা কাজচলা-গোছের ‘সিস্টেম’ তৈরি করে দুটোরই ফল পাওয়ার বাসনা পোষণ করি।
বিশ্বসেরা হওয়ার তাগিদে, ক্রিকেট বোর্ডের কর্তা থেকে দেশের নেতা, সবাই ভুলে যান তাঁদের কর্তব্য। গঠনমূলক দায়িত্বে যাঁরাই আছেন, তাঁদের কাজ হল: এক, (খেলার) বিস্তার; এবং দুই, তার মাধ্যমে পেশাদার ব্যক্তি (খেলোয়াড়) গড়ে তোলা। আইপিএল চালালে খেলার প্রসার ও গঠন, কোনওটাই হয় না। আর এখানেই অস্ট্রেলিয়া, নিউ জ়িল্যান্ড, কানাডা, ইংল্যান্ডের মতো দেশের থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে। যেমন, ইংল্যান্ডে প্রিমিয়ার লিগের (ইপিএল) কুড়িটি দল পেশাদারি ফুটবলের কাঠামোর উপরের স্তরে থাকলেও, তাদের তলায় কয়েকশো দল মিলে একটা পিরামিড গড়ে তুলেছে— প্রতি বছর এক স্তর থেকে পরের স্তরে ওঠানামা চলে। আয়তন ও জনসংখ্যার তুল্যমূল্য বিচার করলে, আইপিএল-এ আট নয়, আমাদের হয়তো আটশোটা দল লাগবে।
দ্বিতীয় কাজ, ব্যক্তির পেশাদারি দক্ষতা গড়ে তোলা। তার জন্য প্রয়োজন ছোটবেলা থেকে সবাইকে খেলাতে ও সব কিছুতেই যোগদানে উৎসাহিত করা। বাছাই নয়, সবাইকে ‘দল’-এ নেওয়া। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে প্রতিটা গ্রামের, প্রতিটা ক্লাবের, প্রতিটা প্রাইমারি স্কুলের সব শিশু যাতে খেলার সুযোগ পায়, সেই পরিবেশ গড়ে তোলা হয়। একই ভাবে, বিলেতের স্কুলে, সবাইকে অন্তত একটা বাদ্যযন্ত্র বাজাতে শেখানো হয়। আর, যারা যে বিষয়ে পারদর্শী, তাদেরকে স্বচ্ছ এক পরিকাঠামোর মাধ্যমে শুরু থেকেই গড়ে তোলা হয়; সেখানেও পিরামিড ধাঁচের ব্যবস্থাপনা।
কাউন্টি ক্রিকেটের কথা বলি। ইংল্যান্ডের প্রতিটা কাউন্টি, প্রতি বছর, অনূর্ধ্ব দশ থেকে অনূর্ধ্ব সতেরো অবধি ছেলেদের ও মেয়েদের আলাদা দল গড়ে তাদের প্রশিক্ষণ দেয়। খেলোয়াড় বেছে নিতে কাউন্টিকে প্রথমে কয়েকটি জেলায় ভাগ করা হয়, জেলাকে ভাগ করা হয় অঞ্চলে; অঞ্চলের মধ্যে স্থানীয় ক্লাব ও স্কুল থেকেই ‘ট্রায়াল’ দিয়ে কাউন্টি স্তরে, এবং তার পর জাতীয় দলে উত্তরণ ঘটে। এ বারের আইপিএল-এ যে জনাদশেক ইংরেজ খেলছেন, তাঁরা সকলেই এহেন সিস্টেমেরই ফসল।
খেলাই হোক বা শিল্পকলা, পেশাদারি কাঠামো হিসেবে এহেন পিরামিডের কোনও বিকল্প নেই।
অর্থনীতি বিভাগ, কার্ডিফ ইউনিভার্সিটি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy