Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Prisoners

জামিনের অমানবিক শর্ত

কমিটির রিপোর্ট বলছে, তিনটি কারণের জন্য সরকার আদালতে জামিনের বিরোধিতা করে। এক, অভিযুক্ত পালিয়ে যেতে পারে।

—প্রতীকী ছবি।

রঞ্জিত শূর
শেষ আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০২৩ ০৬:০৪
Share: Save:

ভারতের জেলগুলিতে ধারণক্ষমতার চাইতে বেশি বন্দি, এবং বিচারাধীন বন্দিদের সংখ্যার আধিক্য— এ দু’টি বিষয় নিয়ে বহু দিন ধরেই সুপ্রিম কোর্ট উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। নানা ধরনের নির্দেশ ও পরামর্শ দিয়েছে। জামিন পাওয়াই নিয়ম, জেলে যাওয়া ব্যতিক্রম— এই নীতি সুপ্রিম কোর্টই ঘোষণা করেছিল। নির্দেশ দিয়েছিল, সাত বছরের নীচে সাজা হতে পারে, এমন অভিযোগে গ্রেফতার না করে, জেলে না ভরে বিচার প্রক্রিয়া চালাতে হবে। বয়স্ক, মহিলা ও অসুস্থদের জামিনের আবেদন নমনীয়তার সঙ্গে বিবেচনা করতেও বলেছিল। কোনও পরামর্শই কাজে লাগেনি। সাম্প্রতিক সরকারি রিপোর্ট (এনসিআরবি, ২০২২) দেখাচ্ছে, সাজাপ্রাপ্ত বন্দির অন্তত তিন গুণ বিচারাধীন বন্দি রয়েছে ভারতের জেলগুলিতে।

এর সমাধানে এক প্রস্তাব দিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সংসদীয় কমিটি। বিজেপি সাংসদ ব্রিজ লাল এই কমিটির চেয়ারম্যান, এ রাজ্য থেকে রয়েছেন কংগ্রেসের অধীর চৌধুরী, তৃণমূলের কাকলি ঘোষ দস্তিদার এবং বিজেপির দিলীপ ঘোষ। ২১ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত প্রস্তাবে বলা হচ্ছে, জামিন পাওয়া অভিযুক্তদের পায়ে বা বাহুতে এমন বলয় (অ্যাঙ্কলেট বা ব্রেসলেট) লাগানো হোক, যাতে জিপিএস ট্র‍্যাকিং সিস্টেম রয়েছে— যাতে জেল কর্তৃপক্ষ অভিযুক্তের গতিবিধির উপরে ২৪ ঘণ্টা নজর রাখতে পারে।

কমিটির রিপোর্ট বলছে, তিনটি কারণের জন্য সরকার আদালতে জামিনের বিরোধিতা করে। এক, অভিযুক্ত পালিয়ে যেতে পারে। দুই, ছাড়া পেয়ে অন্য কোনও অপরাধে যুক্ত হতে পারে। তিন, প্রমাণ বিলোপ করতে পারে বা সাক্ষীকে ভয় দেখাতে পারে। জিপিএস ট্র‍্যাকিং-এর নজরদারিতে থাকলে অভিযুক্ত ও সব কিছুই আর করতে পারবে না। ফলে সরকারও জামিনের বিরোধিতা করবে না। বন্দি কমবে, সরকারের খরচ কমবে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ যাতে না ওঠে, তাই বন্দিদের সম্মতি নিয়ে বলয় লাগাতে হবে। এই প্রস্তাবে কংগ্রেস বা তৃণমূলের প্রতিনিধিরা আপত্তি জানাননি।

রিপোর্টে বলা হয়েছে, এ দেশে ওড়িশা রাজ্য সরকার ইতিমধ্যেই এই ব্যবস্থা চালু করে দিয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ব্যবস্থা এখনও চালু হয়নি, তবে ওড়িশা জেল প্রশাসনের তরফে এমন প্রস্তাবে রাজ্য প্রশাসনের সর্বোচ্চ মহল থেকে ইতিবাচক বার্তা মিলেছে। যার ভিত্তিতে বিস্তারিত প্রস্তাব বানিয়ে সরকারের কাছে পেশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, বন্দিদের নিজের খরচেই জিপিএস ট্র‍্যাকিং সিস্টেম বসাতে হবে। দাম পড়বে অন্তত দশ হাজার টাকা। ব্যাটারি-চালিত এই জিপিএস ২৪ ঘণ্টা চালু রাখতে হবে। বন্দি কত দূর পর্যন্ত ঘোরাফেরা করতে পারবে, তা বেঁধে দেওয়া থাকবে। নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে গেলে জেলে খবর যাবে, এবং জামিন বাতিল হয়ে যাবে। নির্ধারিত সময়ে জেলে গিয়ে ট্র‍্যাকিং সিস্টেমের ব্যাটারি বদলে নিতে হবে। না গেলে জামিন লঙ্ঘন করা হয়েছে বলে ধরা হবে।

বিষয়টি আদালতও ইতিমধ্যে বিবেচনা করেছে। নিম্ন আদালতে জামিনের শর্ত হিসাবে এক অভিযুক্তকে ২৪ ঘণ্টা একটা স্মার্ট ফোন সঙ্গে রাখতে বলা হয়, যার মাধ্যমে তদন্তকারী অফিসার অভিযুক্তকে নজরে রাখবেন। এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দিল্লি হাই কোর্টে আবেদন করলে হাই কোর্টের বিচারপতি আশা মেনন এই ব্যবস্থার প্রশংসাই করেন। ৬ মে তাঁর রায়ে তিনি বলেন, পশ্চিমের দেশগুলিতে প্যারোলে মুক্তদের শরীরে জিপিএস ট্র্যাকিং-এর ব্যবস্থা রয়েছে, ভারতেও তা অনুসরণ করা যায়।

কিন্তু অন্য একটি মামলায় দিল্লি হাই কোর্টের এ ভাবে স্মার্ট ফোনে জিপিএস ট্র্যাকিং-এর মাধ্যমে জামিনপ্রাপ্ত বন্দির অবস্থান জানার নির্দেশ নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট প্রশ্ন তোলে। ৩ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি অভয় এস ওকা এবং বিচারপতি পঙ্কজ মিত্তল বলেন, হাই কোর্ট ও নিম্ন আদালতের ওই আদেশ সংবিধানের একুশ নম্বর ধারা লঙ্ঘন করছে। ওই ধারা অনুযায়ী, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নাগরিকের মৌলিক অধিকার। সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতি আরও বলেন, কাউকে যখন জামিন দেয় আদালত, তখন কিছু শর্তও দেয়। সে সব শর্ত পূরণ হচ্ছে কি না সেটাই প্রশাসনের দেখার কথা। জামিন দেওয়ার পরে অভিযুক্তের ব্যক্তিস্বাধীনতা বা ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার আবার কেড়ে নেওয়া যাবে কেমন করে?

এই আপত্তি কি জিপিএস ট্র‍্যাকিং-এর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য নয়? জামিনে মুক্ত বিচারাধীন বন্দিকে জিপিএস দিয়ে ২৪ ঘণ্টা ট্র‍্যাক করলে সংবিধানের ২১ নম্বর ধারা লঙ্ঘন হবে, সংসদীয় কমিটির সদস্যরা কি এটা জানতেন না? জানতেন। তাই তো মানবাধিকার লঙ্ঘন হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে আগে থেকে বন্দির সম্মতি আদায় করার কথা বলেছেন। তাঁরা ভুলে যাচ্ছেন, প্যারোলে মুক্ত সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীর অবস্থান যদি বা জানতে চাওয়া যেতে পারে, যে ব্যক্তি কেবলমাত্র অভিযুক্ত, আইন অনুসারে নিরপরাধ বলেই যাকে ধরে নিতে হবে, তার ব্যক্তিস্বাধীনতায় কী করে হস্তক্ষেপ করা যায়?

পুলিশি তদন্তের দীর্ঘসূত্রতা, বিচারকের অপ্রতুলতা, জেল পরিকাঠামোর খামতি, এ সব সমস্যার সমাধান না করে, সব ব্যর্থতার দায় চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে জেলবন্দিদের ঘাড়ে। তাদের সাংবিধানিক অধিকারকে নস্যাৎ করা হচ্ছে। অঙ্কুরেই এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে তীব্র জনমত গড়ে তোলা জরুরি। এটা মানবতার অপমান।

অন্য বিষয়গুলি:

Prisoners Jail
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy