সমাজমাধ্যম সমাজেরই দর্পণ।
সমাজমাধ্যম নিয়ে ইদানীং অনেক সমালোচনা চোখে পড়ে। এটা সত্যি যে, কোনও নির্বাচন বা গুণমান নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়া না থাকলে মুড়ি আর মিছরি আলাদা করা মুশকিল হতে পারে। সেই রকমই, সমাজমাধ্যমে যে রাজনৈতিক মতামত বা খবর প্রচারিত হয়— হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটি কথাটির সূত্রপাত যেখানে— তার মধ্যে সত্যতা কতটা, আর কতটা সম্পূর্ণ মতাদর্শগত পক্ষপাতদুষ্ট প্রচার, তা অনভিজ্ঞ প্রাপকের কাছে পরিষ্কার না হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি। শুধু তা-ই নয়, এর একটা আসক্তিমূলক দিক আছে, যার থেকে বিচ্ছিন্নতাবোধ, মানসিক অবসাদ হওয়া স্বাভাবিক, এবং অবাধ সামাজিক আদানপ্রদানের যে অবাঞ্ছিত ও অন্ধকার দিকগুলো (যেমন, ঈর্ষা, মনোমালিন্য, মানসিক হেনস্থা), সেগুলো সারাক্ষণ বৈদ্যুতিন জানলা দিয়ে আমাদের নিজস্ব জগতে টেনে আনলে নানা মানসিক সমস্যা গুরুতর আকার নিতে পারে।
এই অভিযোগগুলোকে ঠিক কতখানি গুরুত্ব দেওয়া বিধেয়? এখন অবধি যে গবেষণা হয়েছে, তার যে সমীক্ষা বা সরকারি রিপোর্ট (যেমন, ব্রিটেনের রয়্যাল সোসাইটি ফর পাবলিক হেলথ, ২০১৯), সেগুলো থেকে জানা যাচ্ছে যে, এই বিষয় নিয়ে সতর্ক থাকার এবং আরও গবেষণা করার প্রয়োজন আছে বটে, কিন্তু এই নির্দিষ্ট বিষয়টি মানসিক স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক (যেমন, আসক্তিমূলক অভ্যাস) এবং তাই তাকে সরকারি নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনা প্রয়োজন, এ কথা বলার মতো যে রকম জোরদার তথ্যপ্রমাণ প্রয়োজন, তা এখনও পাওয়া যায়নি।
রাজনীতির পরিসরে সমাজমাধ্যমের প্রভাব বিষয়ে গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে, রাজনৈতিক বা ব্যবসায়িক ক্ষমতার অলিন্দ থেকে খবরের প্রচার নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা আগের চেয়ে অনেক কমেছে, এবং ক্ষমতাসীন সরকারের পক্ষে অস্বস্তিকর খবর এখন চেপে রাখা কঠিনতর হয়েছে। এর প্রভাব গণতান্ত্রিক অধিকারের বিস্তারের দিক থেকে, বিশেষত যে সব জমানায় গণতন্ত্রের ভিতনড়বড়ে, অবশ্যই ভাল। আবার নানা চরমপন্থী মতামত, ভুয়ো খবর বা গুজব প্রচারেরও সহায়ক সমাজমাধ্যম। প্রথাগত মাধ্যমে এ ধরনের বিষয়গুলোতে যে সাবধানতা বা যত্ন নেওয়া হয়— না হলে তাদের ভাবমূর্তি এবং আয়ে টান পড়বে— আন্তর্জালের ‘আমরা সবাই রাজা’ দুনিয়ায় তা কাজ করে না।
গুজব বা ভুল খবর আগেও ছড়াত, তাই ভেবে দেখা দরকার যে, সমাজমাধ্যম কেন বিশেষ ভাবে আশঙ্কার কারণ দাঁড়িয়েছে। প্রথম সমস্যা হল, সমাজমাধ্যমে যা-ই দেখা যায়, তার একটা আপাতবিশ্বাসযোগ্যতা থাকে— ছাপা অক্ষরের এবং ছবির যে আপাতগুরুত্ব থাকে, উড়ো কথায় তা থাকে না। কোনটা সত্যি খবর আর কোনটা সম্পূর্ণ গুজব বা প্রচার, তা বিচার করার কাজটা সোজা নয়। দ্বিতীয়ত, মানুষের মনস্তত্ত্ব এমন যে, নেতিবাচক কথা যা রাগ, ঘৃণা বা ভয় এই ধরনের আবেগকে উস্কে দেয় তার বিস্তার সহজে হয়, সদর্থক চিন্তা বা আবেগের ক্ষেত্রে তা হয় না। তৃতীয়ত, যে কোনও বিষয় নিয়ে তথ্যপ্রমাণ যাচাই করার যে প্রবণতা, আমাদের মতাদর্শগত পক্ষপাতের কারণে এই ধরনের বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে সেটা খানিক কম কাজ করে। চতুর্থত, সমাজমাধ্যমের একটা বড় বৈশিষ্ট্য হল সমমনস্ক মানুষদের মধ্যেই মেলামেশা ও চর্চার প্রবণতা, ফলে তথ্য যাচাই করার সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যায়।
এই সম্ভাব্য প্রভাবগুলো নিয়ে যে তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, তার থেকে জানা যাচ্ছে, যে দেশগুলোতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নেই বা থাকলেও খানিকটা নড়বড়ে, সেখানে শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ক্ষেত্রে সমাজমাধ্যম সদর্থক ভূমিকা নিয়েছে (যেমন, ‘আরব বসন্ত’)। আবার, গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে দক্ষিণপন্থী জনবাদের উত্থানের ক্ষেত্রেও তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।
তবে এখানেও একটা প্রশ্ন থেকেই যায়— বামপন্থী গণআন্দোলনের যে ইতিহাস আমরা জানি, সমাজমাধ্যমের ফলে তার উত্থান বা প্রসার কেন হচ্ছে না? এর একটা সোজা উত্তর হল, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক যে কায়েমি স্বার্থগুলো, তাদের হাতে সম্পদ এবং সংগঠিত হওয়ার ক্ষমতা, উভয়ই বেশি। তাই সব মাধ্যমের মতো সমাজমাধ্যমেও তাদের প্রচার করার সুযোগ ও ক্ষমতা অনেক বেশি। তুলনায় বামপন্থী দলগুলোর পিছনে আর্থিক শক্তি কম। তা ছাড়াও, দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষকে সঙ্ঘবদ্ধ করা শক্ত, কারণ তাঁরা সংখ্যাগুরু হলেও অনেক ছড়িয়ে আছেন, এবং তাঁদের নিজস্ব দৈনন্দিন জীবনযাপনের সংগ্রাম তাঁদের মনোযোগ অনেকটাই নিয়ে নেয়, তাঁদের শিক্ষা ও আন্তর্জালে উপস্থিতিও তুলনায় কম। আগেও ছবিটা এই রকমই ছিল, সমাজমাধ্যম এই প্রবণতাগুলোকে প্রকটতর করেছে।
এটাও ভুললে চলবে না যে, নিরপেক্ষ না হলেও, বা নানা বিকৃতি থাকলেও শেষ বিচারে সমাজমাধ্যম বাস্তব পৃথিবী থেকে বিযুক্ত নয়। বর্তমান পৃথিবীতে ঐতিহাসিক নানা কারণে বামপন্থী বা প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তিগুলো দক্ষিণপন্থী শক্তির তুলনায় পিছিয়ে পড়েছে, আর তাই অন্যান্য পরিসরের মতো সমাজমাধ্যমেও তা গুণগত ভাবে আলাদা হবে, আশা করার কারণ নেই। সময় পাল্টালে, এই ছবিটাও পাল্টে যেতে পারে। বামপন্থী গণআন্দোলনের যে ঐতিহাসিক দৃষ্টান্তগুলি আমরা জানি, সেখানে সমাজমাধ্যমের উপস্থিতি থাকলে তাদের ব্যাপ্তি ও জোর নিঃসন্দেহে অনেকটা বাড়ত।
স্পষ্টতই, সমাজমাধ্যম সমাজেরই দর্পণ। সমাজে যা ভাল বা মন্দ, এতে তা-ই প্রতিফলিত হয়। সমস্যা হল, এই প্রতিফলন নিরপেক্ষ নয় এবং প্রযুক্তিগত কারণে কিছু প্রবণতা বেড়ে গিয়ে গুরুতর সমস্যার আকার নিতে পারে। মনে রাখা ভাল যে, কোনও নতুন ওষুধই হোক বা নতুন প্রযুক্তি, তার প্রভাব সবার উপরে সমান হয় না। সমাজমাধ্যম সম্বন্ধে এখনও অবধি যা তথ্যপ্রমাণ আছে, তাতে গড়পড়তা লোকের উপরে তার কুপ্রভাব খুব বেশি, এ রকম সিদ্ধান্তে আসা যাচ্ছে না। তার মানে কিন্তু এই নয় যে, যাঁদের এর থেকে ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকি বেশি (যেমন, যাঁদের মানসিক স্বাস্থ্য গড়পড়তা লোকের তুলনায় কম মজবুত), তাঁদের ক্ষেত্রে এর প্রভাব নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনও অবকাশ নেই। আর, যে যে গবেষণায় মানসিক স্বাস্থ্যের উপরে সমাজমাধ্যমের কুপ্রভাব ধরা পড়ছে সেখানেও দেখা যাচ্ছে যে, যাঁদের মানসিক অবসাদের প্রবণতা বেশি, তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সাহায্য খোঁজার সম্ভাবনা— যা একটা সদর্থক পদক্ষেপ— তা-ও ফেসবুক ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে। এখানেও দেখা যাচ্ছে, সমাজমাধ্যমের ব্যবহার কতটা হচ্ছে, কী ভাবে হচ্ছে, কে করছে সেটা না দেখে সমাজমাধ্যম ভাল না মন্দ, এই দ্বিত্বের মধ্যে আবদ্ধ থাকলে চলবে না।
মনে রাখা জরুরি যে, কোনও জিনিস ভাল না লাগলে, বা তার কুফল সম্পর্কে চিন্তার কারণ থাকলেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, করা কাম্যও নয়। কারও ব্যক্তিগত মতামত বা পছন্দ নিয়ে তর্ক চলে না— তা নিয়ে আমাদের নিজস্ব মতামত থাকতেই পারে, কিন্তু কে কী দেখবে, বলবে, বা চর্চা করবে, সেটা তার ব্যাপার— তাতে হস্তক্ষেপ করার অধিকার আমাদের নেই। তা ছাড়া, যে কোনও নতুন প্রযুক্তির ক্ষেত্রেই রক্ষণশীলরা ‘গেল গেল’ রব তোলেন— তা সে নাটক-নভেলই হোক বা সিনেমা-থিয়েটার-টিভি, সমাজমাধ্যম বা আন্তর্জাল, যা-ই হোক না কেন। গুটেনবার্গের সৌজন্যে যখন প্রথম বই ছাপার প্রযুক্তি প্রচলিত হয়, তখনও সমাজের একটি অংশে এই রকম প্রতিক্রিয়া হয়েছিল বলে শোনা যায়।
কাজেই, সমাজমাধ্যম ভাল না মন্দ, এই দ্বিত্বের বাইরে বেরোতে হবে। তবে, প্রযুক্তিই হোক বা অন্য কোনও সামাজিক পরিসর— তার মধ্যে পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা কর্মক্ষেত্রও পড়ে— তাকে কোনও আইন বা নিয়ন্ত্রণের বাইরে রাখা যায় না। আন্তর্জালের পরিসরে কী ভাবে এই আইন বা নিয়ন্ত্রণের প্রয়োগ করা যায়, বরং তা নিয়ে অনেক বেশি ভাবনাচিন্তা প্রয়োজন। সমাজমাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলির একচেটিয়া ব্যবসায়িক ক্ষমতা, রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে যোগসাজশ, বা তারা যে অ্যালগরিদম ব্যবহার করে, সে বিষয়ে স্বচ্ছতা এবং দায়বদ্ধতা অপরিহার্য। তবে, আরও মৌলিক প্রশ্ন হল, নজরদারি করবে যে প্রতিষ্ঠানগুলো, তাদের পক্ষপাত এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের উপরে নজরদারি করবে কে?
অর্থনীতি বিভাগ, লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy