এলিট’ শব্দটি ইদানীং বেশ সমস্যাজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এলিট বলতে এখানে শিক্ষিত, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ভাবে অগ্রসর শ্রেণির কথা বোঝাচ্ছি। আসলে লেখাপড়া করা লোকজনকে অনেক সময়েই পছন্দ করা মুশকিল। বিদ্যেবোঝাই বাবুমশাইয়ের মতো এঁরা কী বলতে চান, সে কথা সবাই বুঝতে পারেন না। তার উপরে সব কিছু নিয়ে কেমন সবজান্তা আর উন্নাসিক ভাব— সাধারণ বুদ্ধি যা বলে, অনেক সময়েই এঁরা উল্টো কথা বলেন। পছন্দের খাবার? খাওয়া যাবে না, কারণ তা স্বাস্থ্যের জন্যে খারাপ, বা এর জন্যেই পরিবেশ দূষণ বাড়ে। পছন্দের সিরিয়াল বা সিনেমা? নিম্নমানের, এবং তার মধ্যে যে নিহিত মতাদর্শ, তা অত্যন্ত পশ্চাৎমুখী। পছন্দের কড়া নেতা? অগণতান্ত্রিক। সমাজবিরোধীদের উত্তমমধ্যম দিয়ে ঢিট করা? গণতান্ত্রিক অধিকারের অবক্ষয়।
অসুখ করলে আমরা ডাক্তার দেখাই। চিকিৎসাবিজ্ঞান শিখতে তো আর যাই না। কিন্তু চিকিৎসকদের উপরেও আমাদের রাগ। স্কুল, কলেজে পড়ি। কিন্তু কেউ শিক্ষাসংক্রান্ত কোনও নীতি নিয়ে আলোচনা করতে চাইলে এড়িয়ে যাই। ওটা তো আমার বিষয় নয়! ডিগ্রি আর চাকরি— এর বাইরে ভাবার আছেটা কী? এ সব বেশি চর্চা করেই তো ক্যাম্পাসগুলো অতি-বাম বা জাতীয়তাবিরোধী রাজনীতির আখড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এক সময়ে সিনেমার ভিলেন হতেন অত্যাচারী জমিদার। তার পর সেই জায়গাটা নিলেন অসাধু ব্যবসায়ী। তার পর অসৎ রাজনীতিক। এখন অনেক সময়েই তাঁরা ভণ্ড, লোভী বা অসৎ পেশাজীবী বা আমলা বা বুদ্ধিজীবী। অর্থাৎ এলিট। সারা বিশ্বে দক্ষিণপন্থী জনমোহিনী রাজনীতির যে জোয়ার, যার প্রভাব আমাদের দেশেও কম নয়, তার একটা বড় দিক হল এলিট-বিরোধিতা, যেমন হার্ভার্ড বনাম হার্ড ওয়ার্ক। যেন এলিটরা বিলাসী এক শ্রেণি, যাঁরা ফাঁকি দিয়ে নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে ঢুকে পড়েছেন এবং বাকিদের দমিয়ে রাখাই তাঁদের একমাত্র উদ্দেশ্য। আর হার্ভার্ডের মতো প্রতিষ্ঠানে প্রবেশপত্র পেতে বা সফল হতে কোনও পরিশ্রম লাগে না। অথচ এই কোভিড-পরবর্তী জমানায় ভ্যাকসিন তৈরির অন্যতম কেন্দ্র কোনটা? অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অসুস্থ মানুষদের চিকিৎসা ও সেবা করছেন কারা? ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীরা।
তা হলে কি ভাল এলিট আর খারাপ এলিট, এই দ্বৈত কাঠামোয় ব্যাপারটা বুঝতে হবে?
আসলে সমাজদেহে একটি প্রবল ক্রোধ রয়েছে। ক্রোধ একটি রিপু। সবারই আছে। কিন্তু সেই ক্রোধ যখন একটি সমষ্টিগত আকার পায়, তাকে খুব সহজেই রাজনৈতিক বলা যেতে পারে। রাজনীতিতে আমরা ‘ধর তক্তা’ গোছের একটা কথা শুনি— মূল শত্রু চিহ্নিত করতে হবে। কিন্তু একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে যে, গণতান্ত্রিক ভাবনার জগতে ‘শত্রু’ চিহ্নিত করার প্রয়োজন নেই। বিকল্প মতাদর্শ ও নীতির মধ্যে প্রতিযোগিতা কাম্য, কিন্তু প্রতিযোগিতা মানেই তো শত্রুতা নয়। আমরা নেহরু আর বাজপেয়ী বা বিধানচন্দ্র রায় আর জ্যোতি বসুর মধ্যে সৌহার্দের গল্প শুনে উন্মনা হই। কিন্তু সমাজের মৌলিক কোনও পরিবর্তন তো হয়নি। মতান্তর যদি ক্রোধোন্মত্ত শত্রুতায় পরিণত হয়, তা দুর্ভাগ্যজনক।
বরং প্রয়োজন পার্থক্য ও বিকল্প চিহ্নিত করা। আমার নিজস্ব নীতিবোধ যে বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠুক না কেন, যখন তা রাজনৈতিক মাত্রা পাবে, তার জন্য প্রয়োজন সমষ্টিগত বিকল্প। সেটিকেই মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়ার নাম গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ। কিন্তু বাদ সাধছে ওই সমষ্টিগত ক্রোধ। যার মূলে আছে সাদা-কালো, ভাল-মন্দের এক অতি-সরলীকৃত এবং বিপজ্জনক দৃষ্টিভঙ্গি। কবির ভাষা একটু পাল্টে বলা যায়, যেখানে তাকাই, শুধু অন্ধকার, শুধু অন্ধকার, অন্ধকারে জেগে আছে মৌলিক নিষাদ— এই ক্রোধ।
রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের মধ্যেও সেই ক্রোধই প্রধান। আবেগ হিসেবে ক্রোধের একটা বড় সুবিধে হল, ভাবনাচিন্তা বা বিচার সরিয়ে রাখা যায়। কাঠামোগত সমস্যা সমাধানের শক্ত কাজটা এড়িয়ে, অসন্তোষের এক দৃশ্যমান প্রতীক খাড়া করে তাতে ক্রোধানলের শলাকা নিক্ষেপ করা যায়। এক রকম তাৎক্ষণিক তৃপ্তি আছে তাতে। যেমন, আমেরিকায় বিশ্বায়ন ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের কারণে চাকরির বাজারে যে দীর্ঘকালীন মন্দা, তার দোষ গিয়ে পড়ে অভিবাসীদের উপর। যে রাজনীতিকরা এই পুঞ্জীভূত বিক্ষোভকে মূলধন করে বেশি করে মানুষ খেপাতে পারেন, তাঁরাই প্রাধান্য পান। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই, যে রাজনীতির ধারা কোনও গোষ্ঠীকে নন্দ ঘোষ ঠাহরে চটজলদি সমাধান দেয় না, তা মনে হয় নেহাতই দুর্বল বা দুর্নীতিগ্রস্ত। তাই চিন্তাশীল, বিদ্বান বা স্থিতধী মানুষ রাজনীতিতে আগ্রহী হন না, অথচ সবার আক্ষেপ— রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন হচ্ছে।
কিন্তু সমস্যা শুধু এটাই না। আরও অনেক গভীর। এই বিভাজন ও বিক্ষোভের রাজনীতির রোষের একটি লক্ষ্য হল এলিটরা— যা শুধু সমস্যার সমাধান থেকে দূরেই নিয়ে যায় না, আস্তে আস্তে গণতন্ত্রের যে প্রাতিষ্ঠানিক শিকড়, তাকে আলগা করে তোলে। গণতন্ত্র বলতে সাধারণ ভাবে বুঝি, সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন। কিন্তু তার আর এক দিক হল সুশাসনের চাহিদা। দিনের শেষে মানুষ চান একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ, আর স্বাধীন ভাবে জীবনযাপনের অধিকার। যত বেশি সম্ভব মানুষের জন্য একটি উপকারী রাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে তোলা যায়, ততই মঙ্গল। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্র পরিচালনার উপযোগী কাঠামো। এই রাষ্ট্রব্যবস্থা চালাতে দরকার মানবসম্পদ, তার জন্য চাই উপযুক্ত শিক্ষা ও মূল্যবোধের বিকাশ। অর্থাৎ, রাষ্ট্রযন্ত্রের এই প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো— যেমন প্রশাসন, আইন, প্রযুক্তি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য— সব স্তরে চাই শিক্ষিত ও দক্ষ নেতৃত্ব ও কর্মী-বাহিনী। অর্থাৎ এলিট সম্প্রদায়।
তা হলে তাদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে কার লাভ হচ্ছে? জনরোষের বহ্নি যদি রাষ্ট্রযন্ত্রের বহুমুখী কাঠামোকে দুর্বল করে দেয়, আখেরে লাভ কার? গণতন্ত্রের বিপদ এ ভাবে ঘনিয়ে আসে তার অভ্যন্তর থেকেই। সুশাসন যখনই পরাস্ত হয়, পাল্টা সামগ্রিক ক্রোধের আগুন ছড়াতে থাকে। তখনই জন্ম নেন কোনও ‘মহান ব্যক্তি’, যিনি নিজেকে সামগ্রিকতার সঙ্গে একাত্ম করে জন্ম দেন একমাত্রিক শাসনকাঠামোর। তাই অগণতন্ত্রকে রুখতে প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় কাঠামোর যথাযথ মেরামতি। অর্থনীতির যুক্তিসম্মত পরিচালনা ও প্রশাসনের আইনগত দিকটির যথার্থ প্রয়োগ। এর জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামত লাগে না। সেটা রাজনীতি, এটা রাষ্ট্রনীতি। দু’টি পৃথক। একটিতে জনমত জরুরি। অন্যটিতে প্রয়োজন সেই জনমতের শুশ্রূষা, যার জন্যে প্রয়োজন শিক্ষার বিস্তার।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার নবজাগরণে এই শিক্ষাপ্রসারের সুরটি ধরা ছিল। রামমোহন, কেশবচন্দ্র, বিদ্যাসাগর মশাইরা শুধুমাত্র প্রগতিশীল সমাজসংস্কারকের তকমা বহন করতেন না, নিজেরাও ছিলেন বিশিষ্ট পণ্ডিত। বিদ্যাসাগর মশাইয়ের জীবন তো ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় শিক্ষার প্রসারের সঙ্গে অঙ্গীভূত। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও একাই বহন করে চলেছিলেন সেই গুরুকুল, যা বঙ্গদেশের মূল পরিচয়। আমরা সামরিক জাতি নই। আমাদের একমাত্র বিশ্বপরিচয় এসেছিল শিক্ষার হাত ধরেই। বিবেকানন্দ, ভগিনী নিবেদিতার ভাবনা ও প্রচেষ্টা, রামকৃষ্ণ মিশনের প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ বা রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতী, বেগম রোকেয়ার লড়াই, সেই চলমানতার এক একটি নিদর্শন। বেদনার কথা, স্বাধীনতা-উত্তর দেশে রাজ্যে শিক্ষার প্রসার শুধুমাত্র বেতনভুক কর্মচারী নিয়োগ এবং উন্নতির সোপান হয়ে গিয়েছে। সরকারের অনেক কমিশন হয়েছে; যা হয়নি, তা হল যথার্থ প্রয়োগ ও নিরলস সাধনা।
একদা কেরলে বামপন্থী নেতারা ‘গ্রন্থাগার আন্দোলন’ করেছিলেন। পার্টি অফিসের তুলনায় বেশি গ্রন্থাগার নির্মিত হয়েছিল। ইএমএস নাম্বুদিরিপাদের এই রাজ-নীতি প্রকৃত ভাবেই একটি দীর্ঘ সামাজিক আন্দোলনের উত্তরাধিকার বহন করে। এর সুফল পেয়েছিলেন কেরলের মানুষ। বামপন্থীরা একাদিক্রমে ক্ষমতায় থাকতে পারেননি, কিন্তু বারে বারে তাঁদের ফিরে আসতে সমস্যা হয়নি।
শিক্ষা ও সুশাসনে বিনিয়োগের লাভ দীর্ঘমেয়াদি। বিভাজনের রাজনীতির পরিণতি হল হিংসা— সাম্প্রদায়িক, বা জাতিগত, বা দলীয়। জনরোষানলে দগ্ধ হতে হতে গণতন্ত্রের কাঠামো দুর্বল হয়ে একনায়কতন্ত্রের অবশ্যম্ভাবী উত্থান। তখন শুধু এলিট বা সংখ্যালঘু কোনও গোষ্ঠী বা বিরোধী দল নয়, ক্রোধের আগুন থেকে কেউই মুক্ত থাকতে পারবেন না। তখন গণতন্ত্র ও সুশাসন দুই-ই হারিয়ে হাতে থাকবে পেনসিল, থুড়ি, রাষ্ট্রশক্তির ডান্ডা।
অর্থনীতি বিভাগ, লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স; রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, বঙ্গবাসী কলেজ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy