প্রতিরোধ: এনআরসি-র বিরোধিতায় কলকাতায় মানবশৃঙ্খল রচনা করেছেন আন্দোলনকারীরা। প্রদীপ সান্যাল।
সম্প্রতি তথ্যের অধিকার আইনে মামলা করে জানা গেল, ২০১৫ সালেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক আধার-এর তথ্যভান্ডারকে সংযুক্ত করেছে ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টার-এর (এনপিআর) তথ্যভান্ডারের সঙ্গে। এনপিআর ও ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনশিপ (এনআরসি) তৈরির পথে এ এক বিপুল পদক্ষেপ। এই দু’টি তথ্যভান্ডারের সংযুক্তিকরণের একমাত্র আইনি পথ ছিল জনগণনার মতো একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশের সব নাগরিকের সম্মতি গ্রহণ করা। তা করতে হত রেজিস্ট্রার জেনারেল অব ইন্ডিয়া (আরজিআই)-র মাধ্যমে। দেখা যাচ্ছে, সম্মতির তোয়াক্কা না করেই সরকার কাজটি করে ফেলেছে।
২০২০ সালে যখন দেশ জুড়ে সিএএ-এনআরসি’র বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চলছে, তখন সরকার জানিয়েছিল যে, জনগণনার সঙ্গেই এনপিআর-এর কাজ হবে (প্রসঙ্গত, বিধি অনুসারে ২০২১ সালে জনগণনা হওয়ার কথা থাকলেও সরকার এখনও সে প্রক্রিয়া শুরু করেনি)। তখন বেশ কিছু রাজ্য সরকার এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিল; জনগণনার মধ্যে এনপিআর-সংক্রান্ত প্রশ্নগুলি বয়কট করার ডাক দিয়েছিল।
এনপিআর-এনআরসি’র জন্য নির্দিষ্ট চারটি প্রশ্নের মধ্যে একটি প্রশ্ন ছিল উত্তরদাতার মা-বাবার জন্মস্থান ও তারিখ সংক্রান্ত। বিরোধী দল-শাসিত রাজ্য সরকারগুলির প্রশ্নের মুখে পড়ে তখন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জানিয়েছিল যে, এই প্রশ্নগুলির উত্তর দেওয়া না-দেওয়া সম্পূর্ণত ব্যক্তির ইচ্ছার উপরে নির্ভরশীল। তবে, ১৯৪৮ সালের জনগণনা আইন অনুসারে, প্রতি দশ বছর অন্তর জনগণনার জন্য যে প্রশ্নগুলি করা হয়, তার উত্তর দিতে নাগরিকরা আইনত দায়বদ্ধ। উল্লেখ্য যে, জনগণনার ক্ষেত্রে নাগরিকের মুখের কথাই নথিভুক্ত করা হয়, তার জন্য কোনও নথিপত্র জমা করতে হয় না; এমনকি কোথাও স্বাক্ষরও করতে হয় না। দেশের নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে জনগণনার তথ্যের গুরুত্ব অপরিসীম। অন্য দিকে, এনপিআর হতে পারে দ্য সিটিজ়েনশিপ (রেজিস্ট্রেশন অ্যান্ড ইস্যু অব ন্যাশনাল আইডেন্টিটি কার্ডস) রুলস, ২০০৩-এর অধীনে। আবার দেখতে গেলে, ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের ১৪ক ধারা-র (২০০৪ সালে সংশোধিত) ধারায় শুধু বলা হয়েছিল যে, সরকার “বাধ্যতামূলক ভাবে দেশের প্রতিটি নাগরিককে দেশের নাগরিক হিসাবে পঞ্জিভুক্ত করতে পারে, এবং তাঁদের একটি জাতীয় পরিচয়পত্র দিতে পারে।” ২০০৩ সালের নাগরিকত্ব নিয়মবিধিগুলি এনপিআর তৈরির যে পদ্ধতি নির্দিষ্ট করে, তা ১৯৫৫ সালের আইনের সীমাকে অতিক্রম করে যায়। মনে রাখা প্রয়োজন যে, সেই নিয়মগুলি কিন্তু আইন নয়; নাগরিকত্ব আইনের ১৪ক ধারা এবং ২০০৪ সালের নিয়মাবলি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে একাধিক মামলা চলছে।
২০২১-২২ সালের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের বার্ষিক রিপোর্ট থেকে জানা গেল, নাগরিকের নাম, লিঙ্গ, জন্মের তারিখ ও স্থান, বাসস্থান, পিতা-মাতার নামের মতো অতি ব্যক্তিগত তথ্য— যা একমাত্র রেজিস্ট্রার জেনারেল অব ইন্ডিয়ার কর্মীদের মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি ঘুরে সংগ্রহ করার কথা— তা সরকার ইতিমধ্যেই গোপনে সংগ্রহ করে ফেলেছে; আধার, মোবাইল নম্বর ও রেশন কার্ডের সংযুক্তিকরণের মাধ্যমে। একাধিক আরটিআই-এর সংগৃহীত তথ্য থেকে বোঝা গিয়েছে যে, গোটা প্রক্রিয়াই ঘটেছে নাগরিকের সম্মতির তোয়াক্কা না করে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ২০১০, ২০১৫-১৬ এবং ২০২০ সালের রিপোর্ট আরও কিছু প্রশ্নের জন্ম দেয়।
আধার তথ্যভান্ডার থেকে কত নাগরিকের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে এনপিআর-এর জন্য? তথ্যের অধিকার আইনে বহু বার সে প্রশ্ন করেও আরজিআই-এর থেকে নির্দিষ্ট উত্তর পাওয়া যায়নি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ২০১৪-১৫ সালের বার্ষিক রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, ১১৯.১৯ কোটি ভারতীয়র তথ্য ডিজিটাইজ়েশন এবং তথ্যভান্ডার নির্মাণের কাজ হয়ে গিয়েছে। মন্ত্রকের ২০১৭-১৮ সালের রিপোর্ট বলছে, অসম ও মেঘালয় বাদে সব রাজ্যের নাগরিকদের তথ্য সংগ্রহ ও আপডেট করার কাজ ২০১৫-১৬ সালে সম্পূর্ণ হয়েছে। মন্ত্রকের অন্যান্য রিপোর্টেও আধারের সঙ্গে এনপিআর-এর তথ্য সংযুক্তিকরণের হিসাব পাওয়া যাচ্ছে, তবে সেগুলো ২০১৫-১৬ সালে তথ্য সংযুক্তিকরণ প্রক্রিয়ার পূর্ববর্তী তথ্য। অনুমান করা চলে যে, ২০১৫-১৬ সালের পর প্রক্রিয়াটি আরও অনেক বেশি গতিশীল হয়েছে, এবং আরও অনেক ভারতীয় নাগরিকের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
আধারের তথ্যভান্ডার থেকে এনপিআর-এর জন্য তথ্য নেওয়াকে কেন আইন-বহির্ভূত বলছি? এনপিআর-এর আইনি ভিত্তি হল নাগরিকত্ব আইনের ১৪ক ধারা, যার মাধ্যমে নাগরিকদের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া সম্ভব হতে পারে (বিধি অনুসারে, এনপিআর এই কাজটিরই প্রক্রিয়া)। অন্য দিকে, আধার বাসস্থানের পরিচয়পত্র মাত্র, যার সঙ্গে থাকা বায়োমেট্রিক তথ্য বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের সুবিধা পেতে কাজে লাগে। ২০১৬ সালের আধার আইন অনুসারে, কোনও একটি নির্দিষ্ট কাজের জন্য আধারের তথ্য ব্যবহার করতে হলে নাগরিকের প্রত্যক্ষ অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। ২০১৮ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বেসরকারি পরিষেবার জন্য আধারের ব্যবহার নাকচ হয়েছে। আধারের ফলে নাগরিকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নষ্ট হওয়ার উদ্বেগও বারংবার প্রকাশিত হয়েছে।
আধার ও এনপিআর-এর সংযুক্তিকরণের প্রশ্নটি যদিও জটিল। ২০১০ সালে আরজিআই বাড়ি বাড়ি গিয়ে ফর্মে স্বাক্ষর করিয়ে এনপিআর-এর তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করে; কিন্তু তার পর প্রক্রিয়াটি বাতিল হয়ে যায়। অন্য দিকে, ইউনিক আইডেন্টিটি অথরিটি অব ইন্ডিয়া (ইউআইডিএআই) ছবি, দশ আঙুলের ছাপ এবং চোখের মণির ছবির মতো বায়োমেট্রিক তথ্যসমেত আধারের তথ্য সংগ্রহ করার পর আধার নম্বর দেয়। এই আধার নম্বরকেই দু’টি তথ্যভান্ডারে থাকা ব্যক্তির তথ্যের সংযোগসূত্র হিসাবে ব্যবহার করার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু, ২০০৩ সালের নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইনে দু’টি পৃথক কর্তৃপক্ষের দ্বারা সংগৃহীত এই দু’টি তথ্যভান্ডারের সংযুক্তিকরণের কোনও অবকাশ নেই। বারে বারে ক্যাম্পের আয়োজন করে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে আধারের তথ্য সংগৃহীত হয়েছিল, আরজিআই-এর কর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে তা সংগ্রহ করেননি। নাগরিকের প্রত্যক্ষ সম্মতি ব্যতিরেকেই ২০১৫ সাল অবধি তথ্যভান্ডার সংযুক্তিকরণের যে কাজ হয়েছিল, স্বভাবতই তা আইনানুগ নয়।
তা ছাড়াও মনে রাখা প্রয়োজন যে, এনপিআর-এর তথ্যযাচাই প্রক্রিয়া নিজের নাগরিকত্ব প্রমাণের দায়টি নাগরিকের কাঁধে চাপিয়ে দেয়। প্রয়োজনীয় নথি না থাকলে, বা তাতে কোনও গরমিল থাকলেই কোনও ব্যক্তি ‘সাধারণ বাসিন্দা’-র তালিকা (অর্থাৎ, নাগরিকদের তালিকা) থেকে বাদ পড়ে যেতে পারেন। তেমন ঘটনা ঘটলে তার পরে কী দুর্ভোগ, অসমের বর্তমান ঘটনাক্রম তার সাক্ষ্য বহন করছে। এই প্রক্রিয়াটি শুধু মূলগত ভাবে অনৈতিক নয়, এই আইন-অতিরিক্ত প্রক্রিয়া সাধারণ নাগরিককে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের বিবেচনার হাতে ছেড়ে দেয়।
এর পর এল ২০১৯ সাল। ধর্মীয় ভিত্তিতে তৈরি নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (২০১৯) নিয়ে তৈরি হল বিপুল বিতর্ক। সরকারের উচ্চপদস্থ ব্যক্তি জানালেন, সিএএ-এনপিআর-এনআরসি হবে ক্রনোলজি মেনে। আতঙ্ক তৈরি হল যে, এটাই বোধ হয় শাসনযন্ত্রের হাতে নথিপত্র যাচাইয়ের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ নাগরিকের প্রান্তিকায়নের, তাঁদের ভারতীয় নাগরিকত্ব থেকে ছেঁটে ফেলার প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ। শোনা যাচ্ছে, অনতিবিলম্বেই সিএএ-র নিয়মবিধি তৈরি হয়ে যাবে। ফলে, ক্রনোলজি মেনে নাগরিকত্ব ছাঁটাইয়ের কাজটি যে কোনও দিনই শুরু হয়ে যেতে পারে, এই আশঙ্কা তীব্র।
আজ অবধি অসমে এই প্রক্রিয়ায় খরচ হয়েছে ১৭০০ কোটি টাকা। অসম বর্ডার পুলিশ ও ফরেনার্স ট্রাইবুনালস-এর (রাজ্যের শাসনবিভাগের অধীনস্থ দু’টি বিভাগ, যার হাতে নাগরিকত্ব যাচাই প্রক্রিয়ার ভার) পাঠানো যথেচ্ছ নোটিসের ভিত্তিতে সওয়া দু’লক্ষ নাগরিক ও তাঁদের পরিবার হয় এনআরসি থেকে বাদ পড়ার ভয়ে ত্রস্ত, নয়তো তাঁদের সন্দেহভাজন বিদেশি বা ‘ডি-ভোটার’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, তাঁদের ৯৯ শতাংশই খাঁটি ভারতীয়! আধার ও এনপিআর-এর তথ্যভান্ডারের গোপন সংযুক্তিকরণে নথির গরমিলের সম্ভাবনা আরও বাড়বে। তার উপরে, ২০০৩ সালের নিয়মবিধিতে যে-হেতু নাগরিকত্ব প্রমাণের দায় ব্যক্তিনাগরিকের উপরে চাপানো হয়েছে, তার ফলে এক বিপুল সামাজিক ও মানবিক সঙ্কটের মুখে দাঁড়াবে দেশ।
সম্ভবত এই সব কারণেই ইউপিএ আমলে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এনপিআর-এর কাজ আরম্ভ করেও তা বন্ধ করে দেয়। নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য প্রয়োজনীয় নথির অভাব, অথবা স্থানীয় সরকারি আধিকারিকদের সঙ্গে নাগরিকদের ক্ষমতার অসাম্যজনিত সমস্যা— এগুলো অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের জন্য যতখানি সমস্যাজনক, এক বিপুলসংখ্যক খাঁটি ভারতীয় নাগরিকের জন্যও ততখানিই। কেন্দ্রীয় সরকার যদি সত্যিই সব নাগরিকের প্রতিনিধিত্ব করে, তবে এই সমস্যার কথা তার বোঝা উচিত। অবশ্য, সরকারের যদি জনগণের প্রতি কোনও দায়বদ্ধতা না থাকে, তা হলে সমস্যা বোঝার বালাইও নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy