—ফাইল চিত্র।
আজি হতে শতবর্ষ’ আগে, ১৯২৪ সালে এই প্যারিসেই বসেছিল অলিম্পিক্সের আসর— ১৯০০ সালের পর দ্বিতীয় বার। তার পর সিন নদীতে বয়ে গেল বহু জল। সর্বার্থেই। আইফেল টাওয়ারের কাঠামোটা হয়তো অটুট, আগুনে ভস্মীভূত নোত্রদাম ব্যাসিলিকা হয়তো পুনর্জাগরিত হচ্ছে তার সাবেক চেহারায়, তবু এই একশো বছরে দেশটার সমাজ আর রাজনীতি বদলেছে লক্ষণীয় ভাবে। এবং তা শুধুমাত্র সময়ের স্বাভাবিক প্রভাবই নয়, রয়েছে আরও বেশি কিছু।
একশো বছরে পাল্টে গিয়েছে অলিম্পিক্স-ও। ১৯২৪-এ ১৭টি খেলার ১২৬টি ইভেন্টে প্রতিযোগী ছিলেন ৪৪টি দেশের ৩,০৮৯ জন। আর ২০২৪-এ ৩২টি খেলায় ৩২৯টি মেডেল ইভেন্টে ২০৬টি দেশের প্রায় সাড়ে দশ হাজার প্রতিযোগী উপস্থিত প্যারিসে। বেড়েছে দর্শকসংখ্যাও— ১৯২৪-এর অলিম্পিক্স দেখেছিলেন ৬ লক্ষ ২৫ হাজার দর্শক। আর ২০২৪-এ সংখ্যাটা দাঁড়াবে দেড় কোটিতে। গত একশো বছরে ক্রীড়াক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্যও কমেছে। ১৯২৪-এ মহিলা অ্যাথলিটের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৩৫, যেখানে ২০২৪-এ মোটামুটি আধাআধি প্রতিযোগীই মহিলা। অলিম্পিক্স-এর ইতিহাসে এই প্রথম লিঙ্গসাম্য প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।
আধুনিক অলিম্পিক্স-এর পুরোধাও তো এক জন ফরাসি। ব্যারন পিয়ের দ্য কুবার্ত্যাঁ। আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির প্রতিষ্ঠাতা, এবং তার দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট। ১৯২৪-এর প্যারিস অলিম্পিক্স ছিল কুবার্ত্যাঁর অধীনে শেষ অলিম্পিক। সেই অলিম্পিক্স অনেক কিছুরই সূত্রপাত করে— অলিম্পিক ভিলেজ, প্রথম রেডিয়ো সম্প্রচার। সেই অলিম্পিক্স-এর অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল শিল্পকলার প্রতিযোগিতাও— মেডেল দেওয়া হয় স্থাপত্য, ভাস্কর্য, সাহিত্য, চিত্রকলা এবং সঙ্গীতে।
প্রতিটা অলিম্পিক্সেই জন্ম হয় অনেক তারকার, অনেকতর গল্পের। ১৯২৪-এ ব্রিটিশ অ্যাথলিট হ্যারল্ড আব্রাহামস আর এরিক লিডেল-এর অলিম্পিক সোনার অভীপ্সায় সাধনার গল্প নিয়ে তৈরি হয়েছিল অস্কার-বিজয়ী ছবি চ্যারিয়টস অব ফায়ার (১৯৮১)। এই অলিম্পিক্সেই ছিলেন ফিনল্যান্ডের মাঝারি এবং দূরপাল্লার দৌড়বিদ পাভো নুরমি— শতবর্ষ পরেও লোকগাথায় রয়ে গিয়েছেন ‘উড়ন্ত ফিন’, যাঁর সম্বন্ধে পত্রিকায় লেখা হয়েছিল যে, তিনি মানুষের ক্ষমতার সীমারেখাকে ছাপিয়ে গিয়েছেন। এই আসরেই সেলেব্রিটি হয়ে ওঠে উরুগুয়ের ফুটবল দল, তাদের শৈল্পিক ক্রীড়াশৈলীর জন্য, ব্যালে নর্তকদের মতো ছন্দ আর তালের জন্য। আবার, এই অলিম্পিক্সের সুইমিং পুল থেকে উঠে আসা এক মহাতারকা পরবর্তী কালে দাপিয়ে বেড়াবেন হলিউডের রুপোলি পর্দায়— জনি ওয়েসমুলার, যিনি বারোটি সিনেমায় অভিনয় করবেন টারজানের ভূমিকায়।
তবে ১৯২৪-এর প্যারিসের রূপকথার আসল রাজপুত্র মিক্সড ডাবলসে সোনাজয়ী আমেরিকান টেনিস তারকা রিচার্ড নরিস উইলিয়ামস। বারো বছর আগে টাইটানিক বিপর্যয়ে অল্পের জন্য রক্ষা পান উইলিয়ামস। হিমবাহে টাইটানিক আটকে গেলে বাঁচার আশায় ১২ মিটার উচ্চতা থেতে মাইনাস দুই ডিগ্রি তাপমাত্রার বরফ জলে ঝাঁপ দেন তিনি। তার পর সাঁতরে পৌঁছন লাইফবোটের কাছে, এবং অবশেষে উদ্ধারকারীদের নৌকায়। ঠান্ডায় জমে গিয়েছিল তাঁর পা। ডাক্তার তৎক্ষণাৎ পা বাদ দিয়ে দেওয়ার কথা বললে চিৎকার করে ওঠেন উইলিয়ামস, এবং হাঁটার চেষ্টা করেন সেই উদ্ধারকারী নৌকার ডেকে। ধীরে ধীরে ঠিক হয় অসার হয়ে যাওয়া পা। পরবর্তী কালে তাঁর এক জন সফল টেনিস তারকা এবং অলিম্পিক স্বর্ণজয়ী হওয়াটা রূপকথা ছাড়া আর কী?
১৯২৪-এর প্যারিস অলিম্পিক্সের সত্যিকারের অবদান অবশ্য অন্যত্র। এই আসর বাঁচিয়ে দিয়েছিল গোটা অলিম্পিক্স আন্দোলনকেই, যা তখন পড়েছিল অস্তিত্বের সঙ্কটে। ১৯২০-র এন্টোয়ার্প অলিম্পিক্স-এ তথাকথিত ‘ভদ্রলোক’ খেলোয়াড়দের অপেশাদার প্রচেষ্টা খুব একটা আকর্ষণ করতে পারেনি দর্শকদের। তার উপরে ১৯২১ থেকে মেয়েদের আলাদা অলিম্পিক্সের আসর বসছিল প্রতি বছর। অদূর ভবিষ্যতেই শিল্প-শ্রমিকরা ফ্র্যাঙ্কফুর্টে প্রথম ওয়ার্কার্স অলিম্পিক্সের আয়োজন করবেন, ১৯২৫ সালে। এবং বেসবল, সাইক্লিং, বক্সিং কিংবা ফুটবলে তৈরি হচ্ছিল নতুন নতুন তারকা আর উন্মাদনা, যার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছিল না অলিম্পিক্স। ১৯২৪-এর আসল তাৎপর্য এখানেই যে, সমস্ত ক্ষেত্রেই তা ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জের উত্তর দেয় খেলারই মাধ্যমে। এবং বাঁচিয়ে দেয় অলিম্পিক্স-কে, অন্তত পরবর্তী এক শতাব্দী কালের জন্য।
আজ অলিম্পিক আন্দোলন যেন ১৯২৪-এর চেয়েও বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। অলিম্পিক্সের টিভি রেটিং কমেছে, বিশ্বের যুবসম্প্রদায় আগ্রহ হারিয়েছে এই আসরে। আর গত অর্ধশতাব্দী ধরে অলিম্পিক্সের আয়োজনও হয়ে পড়েছে কঠিন। ১৯৭৬-এর মন্ট্রিয়ল কিংবা ২০০৪-এর এথেন্সের মতো অলিম্পিক্স আয়োজন করে প্রায় দেউলিয়া না হলেও অনেক ক্ষেত্রেই আয়োজক দেশ বা শহর পরবর্তী কালে পড়ছে গভীর সমস্যায়। পরিকাঠামো তৈরি কিংবা আয়োজনের রাজসূয় যজ্ঞই শুধু নয়, গড়ে ওঠা পরিকাঠামোর অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হচ্ছে না উপযুক্ত ব্যবহার, আর তার রক্ষণাবেক্ষণও হয়ে দাঁড়াচ্ছে শ্বেতহস্তী পোষার মতো ব্যয়সাধ্য। সব মিলিয়ে ১৯২৪-এর একশো বছর পরে প্যারিস নতুন কোনও ম্যাজিক-মন্ত্রে অলিম্পিক আন্দোলনকে বাঁচিয়ে দিতে পারে কি না, সেটাই দেখার।
এক ভিন্নতর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে প্যারিস আজ হয়ে উঠছে এক সামাজিক-রাজনৈতিক বদলের প্রেক্ষাপট। সেই সঙ্গে এক অস্থির অভ্যন্তরীণ সামাজিক পটভূমিতে দাঁড়িয়ে আছে ফ্রান্স দেশটা। কিংবা বলা ভাল, গোটা ইউরোপটাই। তীব্র সামাজিক-রাজনৈতিক টানাপড়েন তাই চলতেই থাকে। ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে সামাজিক সুস্থিতি। এই ‘টাইটানিক’-বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেয়ে অলিম্পিক আন্দোলন এবং ইউরোপ মহাদেশ নতুন কোনও ফরাসি রূপকথা গড়তে পারে কি না, তার লড়াইও চলতে থাকে ২০২৪-এ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy