—প্রতীকী ছবি।
বাহাত্তর নম্বর বনমালী নস্কর লেনের আড্ডায় একটি কালজয়ী স্লোগান বানিয়েছিল গৌর: “ভোট দেবেন কাকে?/ বিশ্ব-ঘনাদাকে।/ কী করবেন তিনি?/ কালো বাজার সাদা করে/ সস্তা চাল তেল চিনি!” ভোটে জিতলেই যেন দেশের অর্থনীতি দখলে চলে আসে, জাদুকাঠি-হেলনে নিমেষেই নিয়ন্ত্রণ করা যায় কালো বাজার, কালো টাকা, বা টাকার দাম। বিজেপির নেতারা যেমন বলে থাকেন— অর্থনীতির ধুঁকতে থাকা অলস ঘোড়াটিকে জাদুমন্ত্রে চাঙ্গা করে গত দশ বছর ধরে দানাপানি খাইয়ে একেবারে পক্ষিরাজ বানিয়ে ছেড়েছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার। দেশের জিডিপি এখন ৩.৭ লক্ষ কোটি, তিন বছরের মধ্যে তা পৌঁছবে পাঁচ লক্ষ কোটিতে, ২০৪৭-এ হবে ৩০ লক্ষ কোটি, এমন প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে আর্থিক সমীক্ষা।
অর্থনীতিবিদেরা অবশ্য বারে বারেই প্রশ্ন তুলেছেন, “পক্ষীরাজ যদি হবে, তাহলে ন্যাজ নেই কেন?” জিডিপি অতখানি বাড়তে গেলে যতটা বৃদ্ধি হওয়া দরকার, বাস্তবে তা আদৌ সম্ভব কি? সরকারি হিসাব অনুযায়ী, সাম্প্রতিক কালে সমস্ত পূর্বাভাসকে ছাপিয়ে বৃদ্ধির হার অস্বাভাবিক রকম বাড়তে শুরু করেছে। শেষ ত্রৈমাসিকে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে আট শতাংশের উপরে। এ নিয়েও অনেক বিতর্ক হয়েছে। ইন্ডিয়া ইজ় ব্রোকেন বইয়ের লেখক অধ্যাপক অশোক মোদী দেখিয়েছেন, অন্য অনেক দেশে যেখানে জিডিপি হিসাব করা হয় মোট উৎপাদন এবং মোট ব্যয়ের তথ্য মিলিয়ে, ভারতে সেখানে শুধু মোট উৎপাদনের তথ্য ব্যবহার করে এই হিসাব করা হয়। এই গরমিল না থাকলে আট শতাংশের আশপাশ থেকে বৃদ্ধির হার নেমে আসত সাড়ে চার শতাংশে। উৎপাদনের তথ্য ব্যবহার করার আর একটি সমস্যা হল, এ দেশে অসংগঠিত ক্ষেত্রের আয়তন বিপুল। এই ক্ষেত্রের উৎপাদনের নির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না, অনেকটাই অনুমান করে নিতে হয় সংগঠিত ক্ষেত্রের তথ্যের ভিত্তিতে। এর ফলে অসংগঠিত ক্ষেত্রের উৎপাদন বাস্তবের চেয়ে বেশ কিছুটা বেশি দেখায়। বিজেপি সরকারের প্রাক্তন মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যনের মতে, মূল্যবৃদ্ধির হারকে আসলের চেয়ে অনেক কম ধরা হচ্ছে বলেই জিডিপির বৃদ্ধির হার এত বেশি দেখাচ্ছে। ঠিকমতো হিসাব হলে বৃদ্ধির হার থাকত পাঁচ শতাংশের কাছাকাছি (আবাপ, পৃ.৪, ২-৪)।
এর চেয়েও বড় এবং মৌলিক সমস্যা হল, চুলচেরা হিসাবের কূট তর্কে ঢুকে অনেকেই ভুলে যাচ্ছেন, জিডিপির অঙ্ক বা বৃদ্ধির হার অর্থব্যবস্থার ভাল-মন্দের শেষ কথা নয়। ক্ষমতায় এলে দশ বছরে জিডিপি দ্বিগুণ হবে বলে যে প্রতিশ্রুতি কংগ্রেসের ইস্তাহারে রয়েছে, তাকে দুয়ো দিয়ে দক্ষিণপন্থী গণমাধ্যম জানাচ্ছে, মোদী সরকার পুনর্বহাল হলে ছ’বছরের মধ্যেই দ্বিগুণের বেশি হবে জিডিপি। যেন হ য ব র ল-র বুড়ো আর কাকের নিলাম ডাকাডাকি! অথচ মানুষ সত্যি কী রকম ভাবে বেঁচে আছেন, তা বুঝতে জিডিপির অঙ্ক অনেক সময়েই গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের গানের ‘শুধু শূন্য শূন্য শূন্য রাশিরাশি’ বই নয়। এমন সব শূন্য, যা সুচতুর ভাবে নজর ঘুরিয়ে দিতে পারে বেড়ে চলা অসাম্যের থেকে। আলোচনা থেকে সরিয়ে দিতে পারে কর্মসংস্থান, জলবায়ু, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং জীবনের মানের মতো বিষয়কে।
২০১৩ সালে জগদীশ ভগবতী ও অরবিন্দ পানাগড়িয়া তাঁদের বই হোয়াই গ্রোথ ম্যাটার্স: হাউ ইকনমিক গ্রোথ ইন ইন্ডিয়া রিডিউসড পভার্টি অ্যান্ড দ্য লেসনস ফর আদার ডেভলপিং কান্ট্রিজ়-এ লেখেন, আর্থিক বৃদ্ধিই হল অর্থনীতির সর্বরোগতাপহর মহৌষধি। সে দিকে নজর দিলে শুরুতে হয়তো অসাম্য একটু বাড়বে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত দারিদ্র, অশিক্ষা, অপুষ্টি, সমস্ত দুর্দশারই অবসান হবে। বৃদ্ধির হার বাড়লেও শিশুদের অপুষ্টি কমেনি কেন, তার ব্যাখ্যা দিতে পানাগড়িয়া লেখেন যে, অপুষ্টি মাপার আন্তর্জাতিক পদ্ধতিটিই ভুল— ভারতীয় শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির সমস্যা বাস্তবে অনেক কম।
সে সময়ে অমর্ত্য সেন ও জঁ দ্রেজ়ও একটি বই লেখেন অ্যান আনসার্টেন গ্লোরি: ইন্ডিয়া অ্যান্ড ইটস কন্ট্রাডিকশন্স নামে। তাঁদের মতে, ভারতে বৃদ্ধির হারের উপরে একপেশে গুরুত্ব দিলে সমস্যা বাড়বে বই কমবে না। বৃদ্ধির হার বাড়া গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু ততোধিক জরুরি যথাযথ সরকারি ব্যয়। বৃদ্ধির প্রক্রিয়াটির ফলে যদি অসাম্য বাড়ে বা দূষণের মাত্রা অনিয়ন্ত্রিত হয়ে ওঠে, তবে সে বৃদ্ধির ফলে দেশের বেশির ভাগ মানুষের মঙ্গল হয় না। যেমন নব্বইয়ের দশকে আর্থিক সংস্কারের ফলে দেশের ধনীতম ২০ শতাংশের আর্থিক অবস্থার আশাতীত উন্নতি হলেও এক জন রিকশাচালক, গৃহসহায়িকা বা ইটভাটার কর্মীর জীবনে পরিবর্তন হয়েছিল খুব সামান্য। অমর্ত্য সেন দেখিয়েছেন, সামাজিক ক্ষেত্রে বেশি বিনিয়োগ করলে মানুষের সক্ষমতা বাড়ে। তার ফলে দেশের আর্থিক বৃদ্ধিও হয়। নইলে অসাম্য বেড়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত আর্থিক বৃদ্ধিও থমকে যায়।
বৃদ্ধির হার ছাড়া সামষ্টিক অর্থনীতির অন্য সূচকগুলির নিরিখেও কিন্তু গত দশ বছরে দেশের অবস্থান আশাব্যঞ্জক নয়। ২০১১-১২’র পর থেকেই বিনিয়োগের হার কমতে শুরু করে। মোদী জমানার প্রতিটি বছরেই বিনিয়োগের হার ছিল ২০১৩-১৪’র তুলনায় কম। কর্পোরেটদের যথেষ্ট করছাড় দেওয়া সত্ত্বেও কর্পোরেট বিনিয়োগ এ সময়ে একেবারেই বাড়েনি। অর্থনীতির কারবারিরা জানেন যে, বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘমেয়াদি লাভ-ক্ষতির হিসাব কষে বিনিয়োগ করেন। অর্থনীতি সত্যিই পক্ষিরাজ ঘোড়ার মতো উড্ডীন হলে চিত্রটা অন্য রকম হত।
অনেকেই মনে করেন যে, এই মুহূর্তে ভারতীয় অর্থব্যবস্থার সবচেয়ে বড় সঙ্কট কর্মসংস্থানের অভাব, বিশেষ করে শিক্ষিত অংশের মধ্যে। পুলাপ্রে বালাকৃষ্ণন এবং এম পরমেশ্বরন পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, নোটবন্দির পরে বেকারত্বের হার এক লাফে অনেকটাই বেড়ে যায়, এবং গত দশ বছরের তুলনায় ইউপিএ জমানায় বেকারত্বের হার ছিল কম। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য ভিডিয়ো কনফারেন্সে রোজগার মেলায় যুবকদের হাতে সরকারি চাকরির নিয়োগপত্র তুলে দিয়ে বলেছেন, আগের জমানার চেয়ে দেড় গুণ বেশি কর্মসংস্থান হয়েছে তাঁর শাসনকালে।
এই জমানার প্রথম পাঁচ বছরে মূল্যস্ফীতি লক্ষণীয় ভাবে কমলেও পরে তা আবার বাড়তে শুরু করে। অতিমারি বা ইউক্রেনের যুদ্ধের আগেই মূল্যস্ফীতির এই বৃদ্ধি শুরু হয়। মনে রাখতে হবে, মূল্যস্ফীতি কমাতে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা থাকলেও কৃষিজাত পণ্যের দামের বাড়া-কমা তার আওতায় আসে না। গবেষকরা দেখিয়েছেন যে, ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে মূল্যস্ফীতি বাড়ার একটা প্রধান কারণ ছিল খাবারের দাম বেড়ে যাওয়া।
২০১৪ সালে মোদী সরকার চালু করে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্প। সরকার দস্তুরমতো ঘোষণা করে বলে, এর ফলে শিল্পক্ষেত্রে ১০ কোটি নতুন চাকরি হবে, এবং জিডিপিতে এই ক্ষেত্রের উৎপাদনের ভাগ হবে ২৫ শতাংশ। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো ছিল এই প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য। ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ বাস্তবিকই বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিল্পক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার বা জিডিপিতে তার ভাগ— দুইয়ের একটিও বাড়েনি গত দশ বছরে। ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের ‘ইজ় অব ডুয়িং বিজ়নেস’ সূচকের নিরিখে অবশ্য এগিয়েছে ভারত। ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র ওয়েবসাইট সে কথা সদম্ভে প্রচারও করে চলেছে। বিভিন্ন দেশের গবেষণায় কিন্তু দেখা গিয়েছে যে, এই সূচকের সঙ্গে বিনিয়োগের কোনও সরাসরি সম্পর্ক নেই। অডিটের গোলমাল ধরা পড়ায় ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক সূচকটি প্রকাশ করাই বন্ধ করে দেয় ২০২১ সালে। এ দেশে ব্যবসায় সুবিধার নামে আসলে শ্রমিকদের অধিকার খর্ব করে শিল্পপতিদের অন্যায় সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে বিধিনিষেধগুলি তুলে দিয়ে। বিপুল অসংগঠিত ক্ষেত্রে এমনিতেই কর্মক্ষেত্রের সুরক্ষা বলে কোনও কিছুর অস্তিত্ব নেই। সংগঠিত ক্ষেত্রেও নিয়মগুলিকে লঘু করে দিয়ে শ্রমিকের স্বার্থ এবং পরিবেশের ক্ষতি সম্পর্কে উদাসীনতা দেখিয়ে চলেছে বর্তমান সরকার।
বনমালী নস্কর লেনের আড্ডায় গৌর ঘনাদার মহিমাকীর্তন করতে স্লোগানটি বানিয়েছিল শিবুকে টেক্কা দিতে। শিবুর বানানো স্লোগানটি ছিল, ‘দেশের নাড়ি বড় ক্ষীণ/ ঘনাদাকে ভোট দিন’। এখন অহরহ শুনছি দেশ আমাদের বিশ্ব-গুরু, নাড়ি তার অতীব সচল। আখ্যান নির্মাণের চাতুর্যে চমৎকৃত হয়ে অবশ্য মাঝেমধ্যেই গুলিয়ে যাচ্ছে, ঠিক শুনলাম তো? বিশ্বগুরু, না কি বিশ্ব-ঘনাদা?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy