Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Leela Majumdar

মনের মধ্যে স্বপ্নের দেশ

মাথায় আসে ‘সহযোগী’ নেওয়ার কথা! একটা গল্প দু’জনে লেখা— বিরল হলেও নজিরবিহীন নয়।

অরুন্ধতী মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৪:৫৫
Share: Save:

১৯৪০-এর দশকে প্রেমেন্দ্র মিত্র একটি গল্প কয়েক পাতা লিখে, শেষ না করে ফেলে রেখেছিলেন। বহু দিন পর আলমারি ঘাঁটতে ঘাঁটতে অসমাপ্ত গল্পটি তাঁর চোখে পড়ে। সন্দেশ তখন তাঁর কাছে একটি ধারাবাহিক লেখা চেয়েছিল। গল্পটি দেখে মনস্থ করেন, সেটিই শেষ করে সন্দেশ-এ দেবেন। এত দিন পর কি লেখাটা ‘ঠিকঠাক’ শেষ করা যাবে? মাথায় আসে ‘সহযোগী’ নেওয়ার কথা! একটা গল্প দু’জনে লেখা— বিরল হলেও নজিরবিহীন নয়। মনে আসে লীলা মজুমদারের নাম। তিনি গল্পটি শেষ করার পরে প্রেমেন্দ্র মিত্র বলেছিলেন, “লেখার জোড় মেলাবার সূক্ষ্ম দাগটা পর্যন্ত বোঝা যায় না, এমন সহযোগী লীলা মজুমদারের মধ্যে পেয়েছি বলে আমার সগর্ব দাবি।” গল্পের নাম হট্টমালার দেশে।

আজ, ২৬ ফেব্রুয়ারি লীলা মজুমদারের জন্মদিন। সেই প্রসঙ্গেই এই গল্পটা মনে পড়ল। যৌথ ভাবে লেখা বলে নয়, তাঁর অসংখ্য সৃষ্টির অন্যতম শ্রেষ্ঠ বলেও নয়, হট্টমালার দেশে লীলা মজুমদারের চিন্তার এক বিশেষ দিক তুলে ধরে বলে। প্রেমেন্দ্র মিত্র লিখেছিলেন, “সিঁধেল চোর রাখাল আর তার শাকরেদ ভূতোর চোখে আমার দুনিয়াকে দেখিয়ে আমার যা বোঝাবার আমি বোঝাতে পারব? হ্যাঁ ঠিক তাই। ঘুণধরা পচা কাঠের হাড়হদ্দ খবর তাদের একটু উলটোপালটা ঝাঁকুনি দিয়েই পাওয়া যেতে পারে।” গল্পের শুরু থেকেই দুই প্রধান চরিত্রের মধ্য দিয়ে ঘুণধরা পচা কাঠের খবর ঢোকানো হয়েছিল। বিলুপ্ত রংমশাল পত্রিকায় তিন-চার কিস্তি বেরিয়েছিল গল্পটি। বছর কুড়ি বাদে যখন লীলা মজুমদারের উপর তা চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ এল, তিনি সাবলীল হাতে সেই ভাবনার সলতেটি জ্বালিয়ে রেখে গল্প শেষ করলেন। লেখার কয়েক কিস্তি পড়ে তিনি বলেছিলেন, “এমন অভূতপূর্ব নির্ভীক আদর্শবাদী লেখা শিশুসাহিত্যে খুব কমই আছে।” তাই প্রেমেন্দ্র মিত্রের কথায় গল্পটি শেষ করতে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন।

কী সেই আদর্শ? যার যেটুকু দরকার, সে সেটুকুই নিক। ‘ইচ অ্যাকর্ডিং টু হিজ় এবিলিটি’ থেকে সরে এসে ‘ইচ অ্যাকর্ডিং টু হিজ় নিড’ স্লোগানটি জনপ্রিয় করেছিলেন কার্ল মার্ক্স। সহজ, সরল গল্পে রাখাল আর ভূতোর মধ্যে মার্ক্সীয় চিন্তাটি ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। লীলা মজুমদারও সেই বামপন্থী চিন্তাধারা কখনও ক্ষুণ্ণ হতে দেননি। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য না হয়েও বরাবর বামপন্থী চিন্তাধারার স্রোত বয়েছে প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্প-উপন্যাসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে তাঁর মননে প্রকট ছিল নাৎসি বিরোধিতার সুর। নিয়মিত লিখতেন কালিকলম, কল্লোল-এ। ছোটগল্প, উপন্যাসে থাকত গরিব ও নিম্নবর্গের কথা।

হট্টমালার দেশে-র প্রথম দিকেই সেই সুতো ধরিয়ে দিয়েছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। রাখাল আর ভূতো এক অদ্ভুত দেশে এসে পৌঁছয়— অঢেল খাবার, প্রাচুর্য, ঐশ্বর্য, সোনাদানা। মানুষ তো বটেই, টেবিল-চেয়ার, থালাবাসন, গাছপালা, ঘরবাড়ি, মাঠঘাট— সে দেশে সব ভাল। যে যা খুশি, যত খুশি নিতে পারে, খেতে পারে। কিছু কিনতে হয় না। পুলিশ-দারোগা নেই, ধনসম্পদ পাহারা দেওয়ার কেউ নেই, নেই জেলখানাও। চাইলে বিলাস করা যায়। খারাপ কাজ করলেও শুধু নিন্দা হয়, আর কিছু নয়। আবার, ডাক্তারিও করা হয়। রাখাল আর ভূতো তো চোর! ভূতো ভাবে, “এত ঐশ্বর্যি নিয়ে করব কী বল তো!” কী যে করবে, ভেবে পায় না রাখালও। তবু সোনাদানা চুরি করে বড়লোক হয়ে গ্রামে ফেরার কথা ভাবতে থাকে।

সে দেশে সবাই মন দিয়ে নিজের কাজটুকু করে। যার যেটুকু দরকার, সেটুকুই নেয়। ধনরাশি থাকলেও কেউ কোনও দিন প্রয়োজনের বেশি নেয় না। সে সব দেখে রাখারও কেউ নেই। রাখালরা গামছায় ধনসম্পদ নিয়ে পালানোর চেষ্টা করলে সেখানকার লোকজন ভাবে, নিশ্চয়ই ওদের কিছু ‘দরকার’ আছে। এই খাঁটি মানুষগুলোকে দেখে রাখাল আর ভূতো গ্রামে ফিরে চুরি ছেড়ে কাজে মন দেয়। বাড়িতে আর সোনা ঢুকতে দেয় না। অনেক দিন পর তাদের মনে ধন্দ জাগে— এমন দেশ কি সত্যিই আছে? উত্তরও পায় নিজেরাই। আছে ঠিকই, তবে মনের মধ্যে। কার্ল মার্ক্স সম্ভবত এমনই একটা পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেছিলেন।

লীলা মজুমদারের মনের মধ্যেও গরিব মানুষের জন্যে একই রকম সহানুভূতি ছিল। সঙ্গে ছিল বামঘেঁষা চিন্তা। শ্রীমতী আর জোনাকি পত্রিকায় তিনি যে সব লেখা লিখেছেন, তাতেও মাঝেমধ্যে এই ধরনের সব ভাবনা ফুটে উঠত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লঙ্গরখানায় গিয়ে খাবার দিয়েছেন তিনি। সে কালে গঠিত ‘মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি’-তেও তিনি নিয়মিত যেতেন। বামপন্থী নীহাররঞ্জন রায়ের সঙ্গে তাঁর নিবিড় যোগাযোগ ছিল। ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন মণিকুন্তলা সেন ও অনিলা দেবী, যাঁরা বাঙালি সমাজে বামমনস্ক বলে সমাদৃত, সমাজচেতনায় অগ্রণী নারী হিসেবেও। এ সব ঘটনা এবং বন্ধুত্বগুলোই লীলা মজুমদার আর তাঁর লেখালিখি নিয়ে আবারও নতুন করে ভাবনাচিন্তা করার সুযোগ করে দেয়।

অন্য বিষয়গুলি:

birth anniversary Premendra Mitra Leela Majumdar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy