তথাপি: ঘর গিয়েছে গুঁড়িয়ে, ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই ‘খেলা’ শিশুদের। গাজ়া, মে ২০২১। —ফাইল চিত্র।
তখন বিশ্বকাপ জোরদার চলছে, দীপাবলির আগে একটা ভিডিয়ো ছড়িয়ে পড়ল সমাজমাধ্যমে। আমদাবাদের রাত, ফুটপাতে লোক ঘুমিয়ে কাদা। শুনশান রাস্তায় একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে। সেখান থেকে নেমে একটি লোক ফুটপাতবাসী এক মহিলার সঙ্গে খানিক কথা বললেন, তার পর ঘুমিয়ে থাকা এক-একটি মানুষকে না জাগিয়ে, তাঁদের পাশে কী যেন চটপট রেখে, গাড়িতে উঠে চলে গেলেন। যিনি দূর থেকে ফোনে ভিডিয়ো করছিলেন, এগিয়ে গিয়ে দেখলেন, ঘুমন্ত মানুষগুলির পাশে রাখা আছে পাঁচশো টাকার এক-একটা নোট!
পরিচয় জানা গেছে পরে, রহমানুল্লা গুরবাজ়! আফগানিস্তানের উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান, উঠতি তারকা, আইপিএল-এ কলকাতার হয়ে খেলেছেন বলে তাঁকে আরও ভাল চেনেন বাংলার ক্রিকেটভক্তেরা। জানামাত্র হইহই আবেগ, রইরই জয়জয়কার: রাত তিনটেয় এক বিদেশি ক্রিকেটার পাঁচতারা সুখনিদ্রা বা স্বপ্নসম বিশ্বকাপ-অভিজ্ঞতা সরিয়ে রেখে ফুটপাতের মানুষকে চুপিচুপি অর্থসাহায্য করে যাচ্ছেন, এ-ও হয়?
লোকগাথার হারুন অল-রশিদ বা হাতিম অল-তাই, গুরবাজ় এর কোনওটাই নন। তবু আশিরপদনখ কুৎসিত দেখনদারির এই দিনকালে এ ঘটনা রূপকথার মতোই শোনায়। আমদাবাদে ক্রিকেট বিশ্বকাপ ফাইনালের টিকিট এ বছর বাজারে (এবং কালোবাজারে) যে দর ছুঁয়েছিল, তার পাশে খানকয় পাঁচশো টাকা কী-ই বা? তবু, যাঁদের জীবনে ভারত-অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপ-যুদ্ধ নেই কিন্তু অষ্টপ্রহর জীবনযুদ্ধ আছে, নোংরা কাঁথা-কম্বল জড়ানো সেই মানুষগুলোর মুখে সে দিন ভোরে ঘুম ভেঙে যে দেওয়ালির রোশনাই ফোটেনি, কে বলতে পারে!
‘চ্যারিটি’ কত লোকেই করে, গুরবাজ়ের কাজকেও একই খোপে পুরে ঘটনার ‘দি এন্ড’ করা যেত। যাচ্ছে না, তার কারণ তাঁর অতীত। তাঁর দেশ। মুক্তি, বাক্স্বাধীনতা, মানবাধিকারের মতো প্রাণদ ভিটামিনগুলো আফগানিস্তান আর কবে দেখেছে! সুদূর অতীতে সে ব্রিটিশ আর রাশিয়ার পিং পং খেলার বল, সাম্প্রতিক অতীতে তালিবানের খেলার পুতুল। তার রাজনীতি লজ্জাকর, অর্থনীতি হাস্যকর, তার পরে জীবনের ছিটেফোঁটা যা থাকে, ভূমিকম্প খরা দুর্যোগে কাবার। দেশটা ক্রিকেটই শিখল উদ্বাস্তু শিবিরে, সোভিয়েটের তাড়া খেয়ে পাকিস্তানে পালিয়ে এসে। মহম্মদ নবির জন্ম পেশোয়ারে, তিনি ক্রিকেট খেলতেন রিফিউজি ক্যাম্পগুলোয় গিয়ে, বা বাবা-মাকে লুকিয়ে স্কুলে। আফগানিস্তান বোর্ডের এক তথ্যচিত্রে দেখছিলাম গুরবাজ় বলছেন, তাঁদের ঘর যে ঠিকাদারের বানিয়ে দেওয়ার কথা তাঁরই অধীনে তিনি দিনমজুরি খাটতেন, ওই পয়সায় ব্যাট-বল, ক্রিকেট সরঞ্জাম কিনবেন বলে! রশিদ খানরা দশ ভাইবোন, ছোটবেলায় ওঁকে বাড়ির বাইরে যেতে দেওয়া হত না, তালিবান ধরে নিয়ে যায় যদি!
যে দেশে একটা প্রজন্ম জ্ঞানবুদ্ধি হওয়া ইস্তক হয় দেখছে ভিন দেশি সেনার বুট নয়, চিনছে তালিবানের কালাশনিকভ, সেখানে ক্রিকেট খেলার স্বপ্ন? খেলাটাই সেখানে স্বপ্ন। ঘুড়ি ওড়ানো পর্যন্ত নিষিদ্ধ। পুরুষদের ক্রিকেট ছাড় পেয়েছে, মেয়ে ক্রিকেটাররা দেশ ছেড়েছেন, কিংবা ছেড়েছেন খেলার স্বপ্নটাই। এত কিছুর পরেও, এত সবের মধ্যেও আফগান পুরুষ ক্রিকেট দল টেস্ট খেলার যোগ্যতা অর্জন করল, নিজেদের ‘বেস’ গড়ল কখনও ভারতে, উত্তরাখণ্ডের দেহরাদূনে, কখনও সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে। দলাই লামার মতো তাঁরাও ‘নির্বাসিত’। তবু ফিনিক্সের মতো উত্থান এবং পুনরুত্থান তাঁদের: এক দিনের বিশ্বকাপে তিন-তিন বার যোগ্যতা অর্জন, আর এ বছর তো ইংল্যান্ড পাকিস্তান নেদারল্যান্ডস শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে স্বপ্ন-উড়ান, চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতেও খেলবেন পরের বার।
এঁদের কেউ কেউ দেশে ফিরতে পারেন, কেউ পারেন না। কিংবা ফেরেন না: তাঁদের ঘরের ঠিকানাই গিয়েছে বদলে, পরিবার-পরিজন থাকেন অন্য দেশে। শিকড়ছাড়া হয়েছে যে, সে-ই বোঝে ঘর আর দেশের মানে; ওঁদের কাছে দেশপ্রেম, দেশাত্মবোধ তাই ময়দানি যুদ্ধের তর্জন-গর্জন নয়, সমাজমাধ্যমে কুৎসিত হিংস্র আস্ফালন নয়। যুদ্ধ যদি বাদই দিই, ২০২২ থেকে আজ পর্যন্ত অন্তত দশটা ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প হয়েছে আফগানিস্তানে, এমনকি এ বারের বিশ্বকাপ চলাকালীনও হেরাটে: মৃত প্রায় দু’হাজার, আহত আর ঘরহারারা আক্ষরিক অর্থেই অগণিত। ব্যক্তিগত শোকের ঊর্ধ্বে উঠে ক্রিকেটের মাঠে মহাকাব্য লেখার কীর্তি বিশ্বকাপ-ইতিহাসে অপরিচিত নয়, কিন্তু দেশের দুর্যোগে দূরে থেকেও রক্তাক্ত হয়ে, দুর্বিপাককেই প্রেরণা করে নিয়ে ক্রিকেট মাঠে লড়া? ইংল্যান্ড ম্যাচের সেরা মুজিব-উর-রহমান জয় উৎসর্গ করেছেন ভূমিকম্পে ধসে পড়া দেশকে, বিশ্বকাপের সব ম্যাচের ফি ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে থাকা দেশকে দিয়েছেন রশিদ খান। ফোনের পর্দায় দেশের হাহাকার-ভরা ছবি আর ভিডিয়ো দেখে মনখারাপ হয়ে গিয়েছিল গুরবাজ়ের, সতীর্থরা খেয়াল করেছিলেন। চেয়েছিলেন, মাঠে শতরান করে একটু হলেও দেশের ব্যথা উপশম করার। পারেননি। সেই কারণেই কি ক’দিন পরে ভোররাতে ছুটে গিয়েছিলেন আমদাবাদের ফুটপাতে, টাকা রেখে এসেছিলেন ঘুমন্ত মানুষগুলোর বালিশের পাশে? দারিদ্রের কোনও দেশ হয় না, তাই?
আর ফুটবলপ্রেমী দেশ প্যালেস্টাইন? এই যুদ্ধের বাজারে তার মাঠ-ময়দানের কী হাল? ঘরের কাছে বলে আফগানিস্তানের যত খবর পাই, তার ভগ্নাংশও রাখি না প্যালেস্টাইনের ক্ষেত্রে। নইলে একই রকম শিউরে উঠতে হত। ইজ়রায়েলের আক্রমণে গাজ়ায় আর কোনও ইস্কুলবাড়ি অবশিষ্ট নেই, ক’দিন আগেই খবর হয়েছিল প্রচারমাধ্যমে। স্টেডিয়ামও কি আছে আর? এগারো বছর আগে এমনই এক নভেম্বরে ইজ়রায়েলি বিমান-হানায় গুঁড়িয়ে গিয়েছিল প্যালেস্টাইন স্টেডিয়াম। কেন? ফুটবল মাঠ থেকে নাকি রকেট ছোড়া হচ্ছিল! ইজ়রায়েল ছাড়া আর কেউ দেখেনি, আর কোনও প্রচারমাধ্যম বলেনি তা। ২০০৬-এও ইজ়রায়েল গুঁড়িয়ে দিয়েছে এই স্টেডিয়াম, সেখানেই ছিল যুব ফুটবলের অফিসও। ছ’বছর ধরে গাজ়ার মানুষ একটু একটু করে ফের গড়ে তুলছিলেন মাঠ, স্ট্যান্ড, গ্যালারি। জাতীয় দল খেলবে, ফুটবলপ্রেমীরা জড়ো হবেন, এত বছর ধরে এত যুদ্ধ রক্ত প্রাণহানির সাক্ষী থাকা মাটি এটুকু আশ্রয় পাবে না ফুটবলে?
এ বার আলাদা করে গাজ়ার স্টেডিয়ামের খবর মেলেনি। কিন্তু যেটুকু খবরাখবর এসেছে তাতে স্পষ্ট, এই ধ্বংসলীলার পর আর কিছু মাথা তুলে থাকতে পারে না। ফুটবলাররাও মানুষ, প্যালেস্টাইনের বহু ফুটবলার বহু বছর ধরেই প্রাণভয়ে স্বেচ্ছানির্বাসনে— জর্ডন, মিশর, ওমানের নানা লিগে খেলেন। তবু দেশের হয়ে খেলতে কার না সাধ জাগে? অনেকে ফিরে এসেছেন, আবারও চোখের সামনে দেখেছেন নিজের ঘরবাড়ি ধুলোয় মিশে যেতে, আবার দেশ ছেড়েছেন। এক-এক বারের আক্রমণে কমতে কমতে কারও পরিবারের তেমন কেউই বেঁচে নেই; যাঁরা ছিলেন এবং দেশে ছিলেন, এ বারের হানার পরে সেই আত্মীয়-বন্ধুদের খবর নেই আর। এক প্যালেস্টাইনি ফুটবল-বিশ্লেষক এগারো জনের দল গড়েছেন, গোলকিপার থেকে ফরোয়ার্ড, কোন পজ়িশনে কে খেলবেন সব লেখা। ভুল হল, ‘খেলবেন’ নয়, ‘খেলতেন’। ওঁরা সবাই যে ইজ়রায়েলি আক্রমণে মৃত!
ঘর নেই, প্রিয়জন নেই, ফুটবলে পা ছোঁয়ানোর প্রশ্ন নেই। এ দিকে চলছে ২০২৬ ফুটবল বিশ্বকাপের কোয়ালিফায়িং রাউন্ড। প্যালেস্টাইনের জাতীয় দল অতি কষ্টে দেশ ছেড়েছে, শারজার দর্শকশূন্য মাঠে গত ১৬ তারিখ গোলশূন্য ড্র করেছে লেবাননের সঙ্গে, ২১ নভেম্বর কুয়েতে ষাট হাজার দর্শকের সামনে হেরেছে অস্ট্রেলিয়ার কাছে। তাতে কী, সমর্থকেরা গ্যালারিতে সাদা-কালো ‘কেফিয়ে’ স্কার্ফ দুলিয়ে, পতাকা নেড়ে পাশে ছিলেন, তাঁদের ম্যাচ ফি-র কিছুটা দিয়ে গাজ়ার পাশে দাঁড়িয়েছেন অস্ট্রেলীয় খেলোয়াড়রাও। ভারত-অস্ট্রেলিয়া ফাইনালে আমদাবাদের মাঠেও এক জন ঢুকে পড়েছিলেন না? মুখে প্যালেস্টাইনের পতাকারঙা মাস্ক, টি-শার্টে লেখা ছিল ‘স্টপ বম্বিং প্যালেস্টাইন’। খেলা খানিক ক্ষণ বন্ধ থাকা, রক্ষী এসে লোকটিকে ধরে নিয়ে যাওয়া বাদে বেশি কিছু হয়নি অবশ্য।
আসলে একটা খেলাকে কে কোথায় কী ভাবে দেখছেন, কোন বিপন্ন বা সম্পন্ন অবস্থান থেকে, সেটাই তফাত গড়ে দেয়। দশটা ম্যাচ উড়িয়ে জিতে ফাইনালে ওঠে যে দেশ, তার দেশবাসী, ভক্তকুল ও প্রচারমাধ্যমের কাছে একটা ফাইনাল হয়ে ওঠে ‘লাস্ট ফ্রন্টিয়ার’, ‘মহারণ’: ছায়াযুদ্ধের আস্ফালনে ফোলানো বেলুন। রোজ চোখের সামনে যুদ্ধ দেখছে যারা, তাদের কাছে ও সব আদিখ্যেতা, বিলাসিতা। একটা আস্ত মাঠ আছে, সেখানে নেমে খেলা যাচ্ছে, এই না কত! রক্ত মাংস ঘিলু উড়ে-পুড়ে যাওয়া সেই যুদ্ধের সামনে অন্য সব যুদ্ধ ফোঁপরা দেখায়।
আচ্ছা, ইউক্রেনেও একটা যুদ্ধ হচ্ছিল না?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy