Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
সব কথায় হাসতে নেই
West Bengal Assembly Election 2021

‘ভিক্ষা’ বললে অধিকারের প্রশ্নটাকেই অস্বীকার করা হয়

রসিকতা অতি চমৎকার বস্তু, নিয়মিত অভ্যাস করলে মন পরিষ্কার থাকে। রেগে কাঁই হয়ে মুখে ফেনা তুলে গালিগালাজ করার চেয়ে রসিকতায় গায়ের ঝাল মিটিয়ে নেওয়াও স্বাস্থ্যকর অভ্যাস।

অমিতাভ গুপ্ত
শেষ আপডেট: ১১ মে ২০২১ ০৬:০৮
Share: Save:

ভোটের ফল বেরোনোর পর অনেকেরই ভারী গোসা হয়েছে। রাজ্যবাসীর উপর। উন্নয়নের যাবতীয় সম্ভাবনাকে আদিগঙ্গার ঘোলা জলে ভাসিয়ে রাজ্যবাসী শেষ অবধি কি না বেছে নিল বিনে পয়সার চাল, বিধবা ভাতা আর সবুজসাথীর সাইকেল! সোশ্যাল মিডিয়ায় যাঁরা গরগরে রাগ উগরে দিচ্ছেন, তাঁদের একাংশ আগমার্কা বিজেপি। কিন্তু, সবাই নন। অনেকেই স্বঘোষিত বামপন্থী। পরিশীলিত, ভদ্র— তাই তাঁরা রসিকতার ছলে মনে করিয়ে দিচ্ছেন, বাঙালি শেষ অবধি ‘ভিক্ষা’ পেয়েই সন্তুষ্ট।

রসিকতা অতি চমৎকার বস্তু, নিয়মিত অভ্যাস করলে মন পরিষ্কার থাকে। রেগে কাঁই হয়ে মুখে ফেনা তুলে গালিগালাজ করার চেয়ে রসিকতায় গায়ের ঝাল মিটিয়ে নেওয়াও স্বাস্থ্যকর অভ্যাস। তবে, কী নিয়ে রসিকতা করছেন, সেটা ভেবে নিলে হয়তো অনেক রসিকতাই আলজিভের গোড়ায় আটকে যেত, মুখ ফস্কে বাইরে চলে আসত না। অথবা, কে বলতে পারে, আসতও হয়তো। গরিব মানুষের শুকনো ভাতে লবণের ব্যবস্থা হচ্ছে দেখলে হয়তো পেট গুলিয়ে সোডার মতো হাসিই উঠত। তবু এক বার মনে করিয়ে দেওয়া যাক, বিনে পয়সার রেশনের মতো যাবতীয় ‘শ্রী’ আর ‘সাথী’র অধিকাংশকেই কেন ‘ভিক্ষা’ বলতে নেই।

গত এক মাসে আনন্দবাজার পত্রিকা-র সম্পাদকীয় পাতাতেই একাধিক লেখা আর চিঠি প্রকাশিত হয়েছে, যাতে ব্যবহৃত পরিসংখ্যানে স্পষ্ট যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির একটা বিশেষ গোত্রের উন্নতি হয়েছে। জিডিপির বৃদ্ধির হারে সেই উন্নতির ছবি তেমন ধরা পড়বে না, যতখানি পড়বে মানবোন্নয়নের বিভিন্ন সূচকের দিকে তাকালে। সেই পরিসংখ্যানের মধ্যে ঢুকব না— আগ্রহী পাঠক চাইলে পুরনো কাগজের পাতা উল্টে দেখে নিতে পারেন। ‘যথেষ্ট’ আর্থিক বৃদ্ধি না হওয়া সত্ত্বেও যদি ভারতের গড় হারের চেয়ে মানবোন্নয়নে এগিয়ে থাকা যায়, তবে অর্থনীতির সেই মডেলটি সম্বন্ধে অন্তত একটা কথা নিশ্চিত ভাবে বলা সম্ভব— এই মডেল সম্পদের পুনর্বণ্টনে জোর দিয়েছে। বস্তুত, গত দু’তিন বছরে ‘পশ্চিমবঙ্গ মডেল’ বিষয়ে কিঞ্চিৎ আলোচনাও হয়েছে— বিশেষত, গুজরাত মডেলের বিপ্রতীপে। দ্বিতীয় মডেলটিতে শিল্প আছে, জিডিপির বৃদ্ধি আছে, কিন্তু সেই বৃদ্ধির সুফল চুইয়ে গরিবগুর্বো মানুষের কাছে পৌঁছয় না কিছুতেই। ফলে, জিডিপির বৃদ্ধির হারের অঙ্কে গুজরাত এগিয়ে যায়, মানবোন্নয়নের সূচক তাল মেলাতে পারে না সেই গতির সঙ্গে। আর, পশ্চিমবঙ্গ মডেল সম্বন্ধে পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের রিপোর্টও বলছে, টাকাপয়সার দিক থেকে এই রাজ্য পিছিয়ে আছে, কিন্তু মানবোন্নয়নের মাপকাঠিতে বহু ক্ষেত্রেই প্রথম সারিতে।

রসিকতার তোড়ে অনেক সময় খেয়াল থাকে না যে, সম্পদের পুনর্বণ্টনের কথাটা নিয়ে বিজেপি হাসতে পারে— নাগপুরের পাঠশালায় ওই সব বালাই নেই— কিন্তু, স্বঘোষিত বামপন্থীরা হাসলে সেটা নিজের বোধ এবং বুদ্ধির প্রতি কটাক্ষের বেশি কিছু হয় না। সেই পুনর্বণ্টন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় করলেও, ওটা রসিকতার বিষয় নয়— সম্মান না করতে পারুন, নিদেনপক্ষে মুখ বন্ধ রাখতে হয়। ঘটনা হল, ‘পশ্চিমবঙ্গ মডেল’ দাঁড়িয়ে আছে পুনর্বণ্টনের উপর— সরকারের নতুন একটা ভূমিকার উপর, যেখানে গরিব মানুষের প্রাত্যহিকতার খোঁজ রাখে সরকার। জানে, শুধু ব্রিগেডের সভার দিন ডিম-ভাত খাওয়ালেই হয় না, মানুষের রোজ খিদে পায়। জানে, স্কুলে যাওয়ার জন্য একটা জুতো পেলে কার ভাল হয়, কন্যাশ্রীর টাকা পাওয়া যাবে বলে মেয়েগুলো আর ক’টা দিন স্কুলে যেতে পারে, শ্বশুরবাড়ির হেঁশেল ঠেলার আগে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর খানিক হলেও সুযোগ পেতে পারে। জানে, অনেক বিধবারই দু’বেলা অন্নসংস্থানেরও সামর্থ্য নেই, যদি সরকার পেনশনের ব্যবস্থা না করে দেয়। শুনছি, এই নির্বাচনে নাকি মেয়েরা অনেক বেশি ভোট দিয়েছেন তৃণমূলকে। সংসার তো তাঁদেরই চালাতে হয়— ফলে, পুনর্বণ্টনের দার্শনিক তত্ত্ব না বুঝলেও তাঁরা টের পান, ‘কোন মডেল’-এ তাঁদের দুশ্চিন্তা খানিক হলেও কমে।

ভোটে জেতার জন্যই এই সব করেছেন মমতা, বিলক্ষণ। নির্বাচনী গণতন্ত্রে দলগুলো যা যা করে, ভোটে জেতার জন্যই তো করে? কিন্তু, ভোটে জেতার জন্যও যদি মেয়েদের বিয়ের বয়স সামান্য বাড়িয়ে দেওয়া যায়, শিশুদের পুষ্টির মাত্রা একটু টেনে তোলা যায় উপরের দিকে, কৃষকের আয় যদি গোটা দেশের তুলনায় দ্বিগুণ হারে বাড়ে, তা হলে সেই ভোটের রাজনীতিকে দু’হাত তুলে সমর্থন জানাবে মানুষ। অন্তত, সেই গরিব মানুষরা, দু’টাকা কেজি দরে চাল পাওয়া গেলে যাঁদের হাঁড়িতে রোজ ভাত চড়ে। মনে করিয়ে দেওয়া জরুরি— এই প্রাপ্তি কিন্তু গরিব মানুষের জন্য দয়ার দান নয়, এটা তাঁদের অধিকার, হকের পাওনা। একাধিক কারণে এই অধিকার— কল্যাণকামী রাষ্ট্র কোনও নাগরিককে, কোনও কারণেই, অতলে তলিয়ে যেতে দিতে পারে না বলে; রাষ্ট্রীয় উন্নয়নে প্রত্যেকটি মানুষের হিস্সা আছে বলে।

সরকার পুনর্বণ্টনের দিকে জোর দেয় বলে সেই রাজ্যে শিল্প আসে না, এমন যুক্তিও কেউ খাড়া করে ফেলতেই পারেন— আজকাল আর কিছুতেই ভরসা পাই না। তবে, যিনিই বলুন, কথাটা সত্যি হবে না। পুনর্বণ্টনের মাধ্যমে, সাধারণ মানুষের জীবনে সরকারের অধিকতর সংযুক্তির মাধ্যমে উন্নয়নের সঙ্গে শিল্পায়নের কোনও বিরোধ নেই। এই রাজ্যে কেন শিল্প আসে না, তার গন্ডা গন্ডা কারণ আছে। একাধিক কারণের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রত্যক্ষ ভাবে দায়ী। কিন্তু, তর্কের খাতিরে যদি ধরে নিই যে, সব ভুলে তিনি শিল্পসাধনায় বসলেন— অথবা, তাঁর বদলে মুখ্যমন্ত্রী হলেন এমন কেউ, যাঁর এই সব ‘খয়রাতি’র দিকে নজর থাকবে না বিলকুল, শিল্পের স্বার্থকে যিনি রক্ষা করবেন চোখের মণির মতো— তা হলেই কি ভাল হবে সবার? যে বিধবা বৃদ্ধা কোমরের ব্যথায় সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন না, শিল্পায়নের সুফল তাঁর বাড়িতে ঢুকত কোন পথ দিয়ে? যে মেয়েটির বিয়ে হয়ে যাবে পনেরো পেরনোর আগেই, প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডিটুকু শুধু টপকাতে পারবে ভাগ্য সহায় হলে, হাজার একর জমিতে ঝাঁ-চকচকে কারখানা তৈরি হলেই তার হাল ফিরবে? হ্যাঁ, মেয়েটির স্বামী চাকরি পেতে পারে সেই কারখানায়; হ্যাঁ, শিল্পোন্নয়নের ফলে রাজ্যের সার্বিক অর্থনীতিতে গতি বাড়লে সেই মেয়েটিরও কর্মসংস্থান হতে পারে কোথাও— কিন্তু, রাষ্ট্র যদি তাকে পড়ার সুযোগটুকু করে দিতে পারে, তা হলে শিল্পায়নের ফলে তার প্রত্যক্ষ লাভের পরিমাণ বাড়বে। বাজার থেকে লাভ তুলে আনার জন্য নাগরিককে তৈরি করে নেওয়ার দায়িত্ব যদি রাষ্ট্র নেয়, সেটা হেসে উড়িয়ে দেওয়ার বিষয় নয়।

অমর্ত্য সেনের লেখা মনে করিয়ে দেবে যে, উন্নয়নের দৌড়ে যাঁরা দৌড়াতে পারেন না, তাঁদের পিছনে ফেলে যেতে নেই— তাঁদের জন্য তত দূর অবধিই ব্যবস্থা করে যেতে হবে, যতটা ব্যবস্থা হলে তাঁরা নিজেদের প্রাথমিক অসুবিধাগুলোকে টপকে অন্যদের সমান স্তরে এসে পৌঁছতে পারেন। কোনও ভাবেই যাঁরা নিজেদের জোরে এগোতে পারবেন না, শেষ অবধি তাঁদের বহন করে চলাই রাষ্ট্রের কর্তব্য। কন্যাশ্রী আর বিধবা ভাতার উদাহরণ দুটো পাশাপাশি রাখলে বোধ হয় বুঝতে একটু সুবিধা হবে। মেয়েরা যাতে আর একটু বেশি দিন স্কুলে থাকতে পারে, আর একটু বেশি তৈরি হতে পারে পরবর্তী জীবনের জন্য— এটা নিশ্চিত করতে পারলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের তৈরি করে দেওয়া বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতাকে টপকে উন্নয়নের দৌড়ে ঢুকে পড়তে পারে এই মেয়েরাও। আবার, বয়স বা শারীরিক সক্ষমতা বা যে কোনও ধরনের দক্ষতার অভাব— যে কারণেই হোক না কেন, যাঁর পক্ষে কোনও মতেই উন্নয়নের দৌড়ে যোগ দেওয়া অসম্ভব, তেমন মহিলাদের বেঁচে থাকার ন্যূনতম সংস্থানটুকু করতে পারে বিধবা ভাতা। এটা দয়ার দান নয়, রাষ্ট্রের কাছে এটা ন্যায্য পাওনা, অধিকার। এটুকুর ব্যবস্থা করা তো রাষ্ট্রের প্রাথমিক দায়িত্ব, তাই না? প্রায় কেউই সেই দায়িত্ব পালন করেন না বলে যিনি করছেন, তাঁর মাহাত্ম্য অস্বীকার করব কেন?

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতা করার অজস্র কারণ আছে। যতগুলো ক্ষেত্রে তিনি রাজকোষ উজাড় করেছেন, তার সবটাকেই যে এই অধিকার আর ন্যায্যতার মাপকাঠিতে দেখা যায়, এমনকি সব ক’টাই যে সমর্থনযোগ্য, এক বারও তেমন দাবি করব না। সেই প্রশ্নগুলোয় চেপে ধরুন তাঁকে। আন্দোলন করুন। তাঁকে বাধ্য করুন রাজ্যে শিল্পের আবাহন করতে। শুধু, যেখানে তিনি মানুষকে প্রাপ্য অধিকারটুকু দিচ্ছেন, সেখানে হাসবেন না। তাতে মমতার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি আপনাদের।

অন্য বিষয়গুলি:

West Bengal Assembly Election 2021
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy