Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
সব আশ্রয়দাতার মতোই বাড়িও আসলে আশ্রয়হীন, একা
Old House Demolish

ভেঙে যাওয়ার আগে

বাড়ির ইতিহাস সাধারণত দু’রকমের। দখলের ও দ্রষ্টার। দখল, অর্থাৎ, তার অস্তিত্ব রয়েছে। দ্রষ্টা, অর্থাৎ, সে আদতে অস্তিত্বহীন।

An image of a window

—প্রতীকী চিত্র।

বোধিসত্ত্ব ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২২ জুলাই ২০২৩ ০৪:২৩
Share: Save:

কয়েক দিন আগেই কলকাতায় ভাঙা হল অর্ধ শতকেরও বেশি প্রাচীন একটি বাড়ি। সে বাড়ি ছিল গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের। সেই ভাঙা বাড়ির ফ্রেম থেকে বেরিয়ে এসে রাস্তায় দাঁড়ালেন উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খাঁ সাহেব, সঙ্গে পুত্র মুনাওয়ার আলি খাঁ; হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, এ টি কানন, চিন্ময় লাহিড়ী; শ্যামল গুপ্ত আর সলিল চৌধুরী। মুক্তিহীন, অবসরহীন, রুক্ষ চুন-সুরকি-বালির স্তূপের মধ্যে জড়াজড়ি হয়ে পড়ে রইল যুগের সঙ্গে যুগ। স্মৃতির পিঠে স্মৃতি। বিষণ্ণতা জেগে রইল কোমল নিষাদের মতো— প্রতিরোধহীন, কিন্তু মোক্ষম।

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি ভাঙা হচ্ছে শুনে উদ্বেল হয়েছিল বঙ্গীয় নেটিজ়েন সমাজ। কিন্তু, তত বিখ্যাত নয় যে হৃদয়পুর, সে সব বাড়ি বড় জোর পথচলতি চোখকে টানে কয়েক মুহূর্তের জন্য— তার পর হারিয়ে যায় চোখ থেকে, মন থেকেও। তারা বাঁচল কি না, বা সে বাঁচার সঙ্গে মরে যাওয়ার দূরত্ব কতখানি, সে খোঁজ রাখার দায় কার! অতি প্রাচীন সরু খালপোল পেরিয়ে গেলেই চোখে পড়বে তেমনই এক বাড়ি। তার এক দিকের দেওয়াল খোলা। শীত পড়লে, উত্তুরে হাওয়া ঢুকলে ওই খোলা জায়গা দিয়ে শব্দ হয়।

বাড়ির ইতিহাস সাধারণত দু’রকমের। দখলের ও দ্রষ্টার। দখল, অর্থাৎ, তার অস্তিত্ব রয়েছে। দ্রষ্টা, অর্থাৎ, সে আদতে অস্তিত্বহীন। সমস্ত প্রাকৃতিক ও বানিয়ে তোলা দৃশ্যের সে শুধু আর এক রকম দর্শক। একটির পর একটি দৃশ্যের সাক্ষী হতে হতে বয়স বেড়েছে সেই দেওয়াল খোলা বাড়ির। তার মধ্যেই সে মাটিতে কিছুটা চেপে বসে যায়। কখনও জায়গা দেয় দলছুট চড়াইপাখি, মরা পাতা এবং গাছের আড়াল থেকে ভুল করে চলে আসা চাঁদের আলোকে। বাড়িটায় কেউ থাকে না। কাপড় মেলতে দেওয়ার দড়িটাও খুলে নিয়ে চলে গেছে কেউ। বাড়ির আপনজন বলতে সে নিজেই। তার বয়স হতে পারে পঞ্চাশ বছর, হতে পারে শ’খানেক বছরের বেশি। ভাঙা, পরিত্যক্ত বাড়িটিকে দেখলে মনে হয়, সে নিজের প্রতি ওই শ’খানেক বছরের ভালবাসা নিয়েই বুঁদ হয়ে আছে।

এমন বাড়ির সামনে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লে আমরা হয়তো মুহূর্তকাল ভেবেছি, বাড়ির ভিতর দিয়ে টানা সরু যে পথ চলে গেল, তার মধ্যে কোথাও চেন দিয়ে বাঁধা আছে কি না কোনও বাদামি কুকুরছানা, যাকে গৃহস্বামী নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছে। অথবা, কোনও পয়লা বৈশাখের ক্যালেন্ডার আজকের তারিখ নিয়ে হাওয়ায় পতপত করতে করতে অপেক্ষা করে রইল কি না। এই মনে পড়াটুকুই সার। আমরা দেখেছি, আমরা অপেক্ষা করেছি, তার পর হাঁটা লাগিয়েছি নতুন কোনও রথের মেলার উদ্দেশে। বাড়িটা রয়েছে, এটুকুই যেন একটা নিশ্চিন্তি। কোনও দিন ভেবেছি হয়তো— বাড়িটা যদি ভেঙে যায়, বাড়িটা যদি না থাকে, তা হলে ওই শূন্যতার সামনে দাঁড়িয়ে আমরা কী করব?

‘বাড়ি ভাঙা পড়েছে’— এই সত্যটুকু যেন অধিক মাত্রায় জীবন্ত হয়ে ওঠে বাড়ি ভাঙার পরের দৃশ্যগুলো সামনে আসতে থাকলে। আমরা বুঝতে পারি, পিঠে টোকা মারতে মারতে এই দৃশ্যই কোনও এক সময় শূন্যতার গর্ভে নিয়ে প্রবেশ করবে আমাদের। কিন্তু, কোনও দেখাই তো একেবারে শূন্য থেকে শুরু হয় না। প্রতিটা দেখার সঙ্গেই তাদের আগের বহু দেখাই নিজেদের ইতিহাস-ভূগোল নিয়ে জুড়ে থাকে লেজুড় হিসাবে। এ ভাবেই এক দেখার ভিতরে আরও এক বা একাধিক দেখা বেড়ে উঠতে থাকে ঢোলকলমি লতার মতো করে। ঠিক সে ভাবেই সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের বাড়ির ধ্বংসস্তূপের দৃশ্যের মধ্যে জুড়ে যেতে থাকে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেন কিংবা এ রাজ্যে বোমায় উড়ে যাওয়া মাটির বাড়ির দৃশ্যও। যত দূর চোখ যায়, শুধু দেখি সব বাড়ি ভেঙে গেছে। নির্বিকার উদাসীনতায় পড়ে আছে দুটো-তিনটে জীবনসঞ্চয়। অতীতের কোনও সকালবেলার ধূপ জ্বালানোর সুবাসের স্মৃতি দু’হাতে নিয়েই যেন মুখ ঢেকে বসে আছে রঙিন পোশাক পরা পরিজনহীন এক বালিকা। ইন্টারনেটে যার ছবি দেখে আমরা চমকে উঠেছি। বিষণ্ণ হয়েছি।

আমপানের সময় এক পরিচিতার বাড়ির চাল উড়ে গিয়েছিল ঝড়ে। তার মাসখানেক আগেই মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে বাড়িতে বসেছিল সেই নতুন টিনের চাল। পঞ্চান্ন বছর বয়সি পরিচিতা তাঁর পোষা বিড়ালের সঙ্গে জলের বড় ড্রামের পাশে ভয়ে কুঁকড়ে থাকতে থাকতে দেখেছিলেন চাল উড়ে যাওয়ার দৃশ্য। ঝড়ের আঁধারের মধ্যে তার পর বৃষ্টি এসে ঘরময় শুধু জল। এক পাশে কাত হয়ে পড়া সদর দরজা দিয়ে দক্ষিণ দিকে ভেসে চলে গেল রাতের তরকারি রাখা বাসন। তার পর বেশি দিন বাঁচেননি মহিলা।

‘আমার বাড়ি’— এই দুই শব্দ মাইলের পর মাইল জুড়ে অ-বিশ্বস্ত, অ-নির্ভরযোগ্য ও কল্পনার সত্য হয়ে পড়ে থাকে। সূর্য ডুবে গেলে এদের পাশেই নদীর মতো পড়ে থাকে রাত্রি। ছাদহীন, দেওয়াল ভাঙা, সংসারের শেষ কুটোটি পর্যন্ত কালো হয়ে যাওয়া ঘরগুলির মধ্যের আপাত শান্ত-ভাব, হিংসাহীনতা এমনই তীব্র হয়ে ওঠে যে এমনকি ভাম, বাদুড়ও আর আসে না। বাড়ির সঙ্গে অনেকটা দূরত্ব রেখে কাদা পেরিয়ে পুকুরে নেমে যাওয়া হাঁসের পায়ের ছোট ছোট ছাপে এর পিঠে ওর মুখ রেখে শুয়ে থাকে জীবন এবং মৃত্যু।

বেঁচে থাকা ও মরে যাওয়ার মাঝের যত গভীর গোপন আকাঙ্ক্ষা ও অসহায়তাকে খুলির মধ্যে বহন করে নিয়ে যেতে হয় আমাদের, তার সবটাই মশলা বানিয়ে গেঁথে তোলা হয় বাড়ি। সেই বাড়ি ভেঙে যাওয়া মানে মানুষ ও তার অন্তহীন অসহায়তার কাহিনি একেবার ফেটে ছড়িয়ে পড়া। বহু মৃতদেহ পেরিয়ে এসে আরও বহু মৃতদেহ প্রত্যক্ষ করার মধ্যেই নিহিত রয়েছে সভ্যতার ইতিহাস। মানুষের ইতিহাস। বাস্তবের এই কঠোর সত্যকেই যে ভাবে পেরেছে পায়ের তলায় কিছুটা জমি ও মাথার উপরের একফালি ছাউনি দিয়ে শোধন করার চেষ্টা করেছে মানুষ। এ যেন এক রকম বুদ্ধিকে হৃদয় দিয়ে শোধন করার মতোই ব্যাপার। নতুন বাড়ি হলে তাঁর ছবি পাঠান অনেকে। গৃহপ্রবেশ হল। দামি টাইলস লাগালাম। কেউ আবার তাঁদের পুরনো বাড়িরই ছবি পাঠিয়ে যান বার বার। লাল মেঝে শুভ্র দেওয়াল সবই যেন সুখে। এমনই এক বন্ধু তাঁদের ছোট ছাদের সিঁড়ির দরজার বিভিন্ন ছবি পাঠাতে থাকেন এক দিন। তাঁদের বাড়ি প্রায় একশো বছরের পুরনো। গুহার মতো ছোট ছাদের সিঁড়ির দরজার চার পাশ ঢেকে গিয়েছে অল্প যত্নের ম্যান্ডেভিলার গাছের পাতায়। বহু দিনের পরিত্যক্ত সেই দরজার ছবি উল্টো দিকের নতুন বাড়ির বারান্দায় বসে বিভিন্ন ভঙ্গিতে আঁকার চেষ্টা করেন আমার বন্ধু। তাঁর মূল উদ্দেশ্য, পুরনো বাড়ির ছোট ছাদের সিঁড়ির দরজার মুখ এঁকে সেই আঁকা নিয়ে নতুন বাড়ির প্রতিটি কোণে ঘুরে বেড়ানো। কারণটা খুব সহজ। ছোট ছাদের সিঁড়ির দরজার গুহার মতো ওই মুখটা তো আর নতুন বাড়িতে আসতে পারবে না নিজে থেকে! কিন্তু, ওই ছাদের দরজার সিঁড়িকে তো দেখাতে হবে নতুন বাড়ির সবটা! সে তো আসলে বন্ধু! তার কাছেই তো রাঙা আঁচল পেতে বসে ছিল আমার বন্ধুর শৈশব।

বাড়ি তৈরি হয়। গাছের মতো নুইয়েও পড়ে। কেউ কেউ এক মালিকানা থেকে অন্য মালিকানায় চলে যায়। ইতিবাচক-নেতিবাচক গোলপাকানো তথ্যের উপরে ভিত্তি করে তাদের দিকে তাকাই আমরা। কোনও বাড়ির নাম ‘দুপুরমণি’, কোনও বাড়ির নাম ‘কমলা রঙের রোদ’। প্রাচীনতম সেই সব কাঠামোর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি, দুনিয়ারসমস্ত আশ্রয়দাতার মতোই বাড়িও আসলে আশ্রয়হীন। তার গোপন ছিল না। আড়াল ছিল না কখনও। ছায়া ছিল। গাছ ছিল। বারান্দার পাশে ঘর। বহু অপেক্ষার শেষে দুঃখী স্বপ্নের মতো একাই দাঁড়িয়ে থাকে আমাদের সেই সব বাড়ি। একটু নিরালা পেলে যেখানে স্বচ্ছ জালের দোতলা-তিন তলা বানাবে মাকড়সা।

অন্য বিষয়গুলি:

Old house Destruction Kolkata
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy