—প্রতীকী ছবি।
এক মফস্সল শহরের বাসিন্দা মেয়েটি। বিবাহিত। বছর দুই আগে নিজের নামে একটি ‘ভ্লগ’ (ভিডিয়ো ব্লগ) শুরু করেছিল। রান্না করা, তরকারি কোটা, বাজার করা, মেলায় ঘোরা— রোজকার যাপনের আপাততুচ্ছ ঘটনাবলি, প্রতি দিনকার থোড়-বড়ি-খাড়া মেলে ধরতে শুরু করেছিল তার ভ্লগে। কোনও কিছুতে চটক বা চমৎকারিত্ব নেই। কখনও সে একা আবার কখনও সঙ্গে তার বিবাহিত সঙ্গী। এক দিন মেয়েটি জানাল, তার শরীর ভাল নেই। তখন থেকে তার সঙ্গী ভিডিয়ো করার দায়িত্ব নিল। মেয়েটির স্বাস্থ্যের ক্রমশ অবনতি হতে থাকলে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানা গেল, তাকে মারণ রোগে ধরেছে। কমেন্ট বক্সে নানা পরামর্শ, লক্ষ লক্ষ শুভেচ্ছাবার্তার বন্যা বয়ে গেল। সঙ্গে আর্থিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি। তার পর এক দিন মেয়েটি চলে গেল। মৃত্যুর আগের দিন হাসপাতালের বেডে বসে কান্না চাপতে চাপতে সে ভিডিয়ো করে জানাল, এটাই তার শেষ ভিডিয়ো। সে বাঁচতে চেয়েছিল, কিন্তু সবার কপালে কি আর দীর্ঘ আয়ু জোটে! মৃত্যুর পরও তার স্বামী ভ্লগ চালিয়ে যায়। তার অন্তিমযাত্রার ছবি তাদের অগণন সমর্থকদের সামনে তুলে ধরে। আবেগের জোয়ারে ভাসতে থাকে দর্শককুল। এই ভাবে সাধারণ একটি মেয়ের রোজকার পথচলা, এবং সেই পথচলার এক দিন থেমে যাওয়া লক্ষ লক্ষ মানুষের আবেগ উস্কে দেয় আন্তর্জাল-নির্ভর সমাজমাধ্যমে।
এই মেয়েটি একা নয়। ইদানীং ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও ইউটিউব ঘাঁটলে দেখা যায়, অল্পশিক্ষিত, অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল, মফস্সল বা গ্রামাঞ্চলের বিবাহিত মহিলাদের একাংশ রোজকার গার্হস্থজীবনের খুঁটিনাটি অথবা যৌন আবেদনকে পুঁজি করে ‘ভিডিয়ো করা’র মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করতে চাইছেন, জনপ্রিয়তা অর্জন করতে চাইছেন। তাঁদের ঘরদোরে অভাব-অনটনের চিহ্ন বিদ্যমান। বেশির ভাগ সময়ই পরনে সস্তার ম্যাক্সি। প্রায় প্রত্যেকেরই সিঁথিভর্তি সিঁদুর ও হাতে শাঁখা-পলা। তাঁরা বিছানার চাদর পাল্টানোর, কাপড় কাচার, মাটিতে বসে বঁটি দিয়ে মাছ কাটার, রাঁধা-বাড়ার ভিডিয়ো করেন। দর্শকদের দেখিয়ে এক থালা ভাত নিয়ে মাটিতে খেতে বসেন। আবার কেউ একটু সাজগোজ করে ফিল্মি গানের সঙ্গে বাড়ির উঠোনে নাচেন। সেই নাচের মধ্যে কোনও নান্দনিকতা বা নৈপুণ্যের চিহ্ন বেশির ভাগ সময়ই খুঁজে পাওয়া যায় না। আবার কেউ কলতলায় বসে স্নানের দৃশ্যের ভিডিয়ো করেন। ক্যামেরার সামনে বসে সন্তানকে স্তন্যপান করান। অনেক সময় তাঁদের নাবালিকা কন্যারাও ভিডিয়োতে শামিল হয়। কোনও কোনও ভিডিয়োতে স্বামী-স্ত্রী এক সঙ্গে। তাঁদের অন্তরঙ্গতার কিছু মুহূর্তের ভিডিয়ো করে মেলে ধরেন সকলের সামনে, নিজেদের মধ্যে মান-অভিমান, খুনসুটি করেন। দর্শকদের উদ্দেশে চটুল যৌনইঙ্গিতবাহী মন্তব্য করেন। নেটদুনিয়ার ‘দেবর’-দের উদ্দেশে নানা ‘বৌদি’-সুলভ রঙ্গরসিকতা করেন। এঁদের অনেকেরই লক্ষ লক্ষ ‘ফলোয়ার’, লক্ষ লক্ষ ‘লাইক’ বর্ষিত হয় এঁদের ভিডিয়োতে। কমেন্ট বক্সে উপচে পড়া মন্তব্য।
মন্তব্যকারীদের মধ্যে মহিলারাও থাকেন। মহিলারা তীব্র ভাষায় এঁদের আক্রমণ করেন। এঁদের ‘নোংরামি’-র বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেন। রোজগারের এই পন্থাকে নিন্দা করেন, স্বামীর রোজগার, পরিবারের শিক্ষা-দীক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। পুরুষদের একটি ছোট অংশ মহিলাদের মতো একটা উচ্চতর নৈতিক অবস্থান নিলেও, তাঁদের বেশির ভাগ নানা অশ্লীল মন্তব্যে ভরিয়ে দেন কমেন্ট বক্স। বোঝাই যায়, তাঁরা এই ভিডিয়োগুলো তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেন। আবার এই মহিলাদের ‘রোস্ট’ করে কেউ কেউ ভিডিয়ো বানান। সে সব ভিডিয়োর দর্শকও অনেক। নিন্দিত মহিলারা আবার ভিডিয়ো করে দর্শকদের পাল্টা আক্রমণ করেন। এক মহিলা জানান, তিনি এ সব ভিডিয়ো করেন সন্তানদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য। প্রশ্ন করেন, ওদের পড়াশোনার দায়িত্ব অন্য কেউ নেবে কি? তাঁকে উপদেশ দেওয়া হয়, ঘরের বাইরে বেরিয়ে চাকরি করতে। চাকরি পাওয়া কি এতই সহজ? তা ছাড়া বাইরে গেলে ঘরসংসার কে সামলাবে? অতএব, ঘরে বসে ভিডিয়ো করাই সহজ রোজগারের পথ।
যে কোনও তারকার ভিডিয়োর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে এঁদের জনপ্রিয়তা। অথচ নক্ষত্রদের বিপরীত মেরুতে এই মহিলা ভ্লগারদের অবস্থান। শিক্ষা, বৈভব, সৌন্দর্য, চটক বা প্রতিভার অভাব থাকলেও এঁদের ভ্লগ বা রিলের উপর বর্ষিত আবেগী প্রতিক্রিয়া প্রমাণ করে যে, এঁরাও পারেন দর্শক আকর্ষণ করতে, জননজরের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে। পারেন তাঁদের অস্তিত্বের সাধারণত্বকে অতিক্রম করতে।
কেন মানুষ এঁদের ভিডিয়ো দেখেন? যৌন সুড়সুড়িতে ভরা ভিডিয়োগুলির দর্শক অনেক। এঁরা পোশাকে, চেহারায় সাদামাঠা হলেও এঁদের যৌন আবেদনে সাড়া দেওয়ার লোকের অভাব নেই। কিন্তু রোজকার রাঁধা-বাড়া-খাওয়ার কিস্সাও তো নেট-নাগরিকদের দেখতে বেশ ভালই লাগে! নিম্নবর্গীয় জীবনযাত্রার প্রতি শহুরে মানুষদের কৌতূহল এ সব ভিডিয়োর জনপ্রিয়তার একটা কারণ হতে পারে। হয়তো শহুরে চটকদারি, চাকচিক্য দর্শকদের একঘেয়ে লাগছে। স্বাদবদলের জন্য এঁদের সাদামাঠা যাপনের ভিডিয়োগুলি মুখরোচক মনে হচ্ছে। অথবা, কোথাও নিজেদের আটপৌরে জীবনের সঙ্গে দর্শকরা নিজেদের জীবনকে মেলাতে পারছেন। নাক্ষত্রিক জীবনের সঙ্গে নিজেদের দৈনন্দিন যাপনের যে দুরতিক্রম্য ব্যবধান তা এই মহিলাদের ভিডিয়োগুলোর প্রতি আকর্ষণ বাড়িয়ে তোলে। নিজেদের সঙ্গে মেলাতে পারেন তাঁরা। কোভিডের সময় থেকেই সম্ভবত এই ভিডিয়োকারীদের আবির্ভাব। অতিমারির কারণে বহু মানুষ কর্মচ্যুত হয়েছেন, ব্যবসাবাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বোঝা যাচ্ছে, যে মেয়েরা এত দিন শুধুমাত্র গৃহশ্রম দান করতেন, ঘরের বাইরে বেরিয়ে এত দিন কোনও জীবিকায় যোগদান করেননি, তাঁরা আজ ঘরে থেকেই রোজগারের উপায় করে নিয়েছেন, সংসারের হাল ধরতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন।
সমাজমাধ্যম সাধারণ মেয়েদের জীবনে এ ভাবে অভূতপূর্ব বিপ্লব এনেছে। ঘর ও হাতের মোবাইলটি হয়ে উঠেছে জীবিকা উপার্জনের সহজ একটি রাস্তা। রোজগার করতে হলে আর বিশেষ কোনও শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ দরকার নেই। রোজকার রাঁধা-বাড়া-খাওয়া এবং যৌনতাকে পুঁজি করে ঘরে থেকেই উপার্জনের রাস্তা খুঁজে পাওয়া যায়। নারীর শরীর যে একমাত্র তাঁর স্বামীর ভোগের বস্তু, এই ধারণাকে তোয়াক্কা না করেই, গার্হস্থজীবনে প্রোথিত হয়েও অনেকেই যৌনগন্ধি ভিডিয়ো বানানোর নেশায় মেতে ওঠেন। স্বামীর সায় বা সহায়তা কখনও থাকে, আবার কখনও থাকে না। এঁদের রোজগার হয়তো পরিবারের জন্য, সন্তানদের জন্য, বেকার স্বামীর রোজগারের খামতি পূরণ করার জন্য, অথবা নিজেদের শখ-সাধ মেটানোর জন্য। পিতৃতান্ত্রিক সমাজের চোখে গৃহশ্রম শুধু যে পারিশ্রমিকের অযোগ্য তা নয়, তাকে তুচ্ছ, অকিঞ্চিৎকর, একঘেয়ে, বৈচিত্রহীন মনে করা হয়। সেই সব শব্দ-দৃশ্য নেটদুনিয়ায় উপস্থাপিত করে উপার্জন করার এই প্রয়াস পিতৃতান্ত্রিক ধ্যানধারণার বিরুদ্ধে নিঃসন্দেহে একটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। আর একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, মেয়েরা নিজেদের কথা, ঘরের কথা, রোজকার দিনযাপনের কথা নিজেদের মুখে বলছেন। সমাজের এক অংশের মেয়েদের সমাজমাধ্যমে নিজেদের মেলে ধরার এই প্রবণতা নিয়ে সমাজবিজ্ঞানীদের আরও গভীর অনুসন্ধান জরুরি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy