—প্রতীকী ছবি।
অর্থশাস্ত্রের ছাত্ররা আগে শিখতেন যে, বিত্তশালী দেশগুলোর সঙ্গে গরিব দেশগুলোর মূল ফারাক হল, বিত্তশালী দেশগুলোতে জাতীয় আয়ের অনেক বেশি অংশ লগ্নি খাতে যায়, গবেষণা, বা নতুন প্রযুক্তির ক্ষেত্রে প্রচুর বিনিয়োগ করে, ফলে তাদের জাতীয় আয়বৃদ্ধির হার গরিব দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি হয়। বিত্তশালী দেশে এই বিনিয়োগ যে-হেতু বেশিই থাকবে, ফলে তাদের আয়বৃদ্ধির হারও বাকি দুনিয়ার চেয়ে উপরে থাকবে। এই তত্ত্ব দীর্ঘ দিন রাজত্ব করেছে। কয়েক বছর আগে রিচার্ড বল্ডউইন দ্য গ্রেট কনভার্জেন্স নামে একটা বই লেখেন, যার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল যে, বেশ কিছু উন্নয়নশীল দেশ গত কয়েক দশকে সমগ্র বিশ্বের আয়ের বড় অংশ দখল করে নিয়েছে। বিত্তশালী দেশের ভাগ বলবার মতো কমে এসেছে। অর্থাৎ, কম বিত্তশালী বা খানিকটা গরিব দেশগুলো উন্নত দেশগুলোর চেয়ে বেশ কিছু দিন ধরেই বেশি গতিতে আয়বৃদ্ধি করে চলেছে।
চিন এবং ভারতের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা আয়বৃদ্ধির যাবতীয় তত্ত্বকে নড়বড়ে করে দিয়েছে। চিনের আর্থিক বৃদ্ধিকে অর্থশাস্ত্রের প্রচলিত যুক্তিতে ব্যাখ্যা করা যায়— সে দেশে জাতীয় আয়ের ৫০% লগ্নি করা হচ্ছে বহু দিন ধরে, প্রযুক্তির পেটেন্ট পাওয়ার দৌড়ে তারা অনেককে পিছনে ফেলে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে। ব্যাখ্যা করা মুশকিল ভারতের গত তিন দশক ধরে গড়ে প্রায় সাত শতাংশ হারে আয়বৃদ্ধির ঘটনাটি।
ভারতের না আছে বলার মতো বিনিয়োগের হার, না নতুন প্রযুক্তি, না প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডবিশিষ্ট শিল্পজাত দ্রব্য। পেটেন্টের সংখ্যা প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য দেশগুলোর তুলনায় নগণ্য, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য কোনওটাতেই বলার মতো বিনিয়োগ নেই। ভারত পরিষেবা ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব বৃদ্ধির জোরে গত তিন দশক ধরে ভেল্কি দেখিয়ে চলেছে, আয়বৃদ্ধির অর্থনীতির সব তত্ত্বকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে। অনেকেই একমত যে, ১৯৯১-পরবর্তী সংস্কারমুখী অর্থনীতির সুফল পরিষেবা ক্ষেত্রকে মজবুত করে তুলেছে। সহজ কথায়, ভারতের উন্নতির মূলে কম্পিউটার, যা অন্য দেশের কারিগর এবং প্রযুক্তি তৈরি করে, আর আমরা ব্যবহার করে তাক লাগিয়ে দিই— কম খরচে বিদেশের সমান, এমনকি বেশি দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করে।
আশ্চর্যের বিষয়, এত বড় একটা ঘটনা কিন্তু ভারতীয় অর্থনীতি বিষয়ক আলোচনার মূলস্রোতে ঢুকতেই পারে না। সে আলোচনা সব সময়ই দারিদ্রকেন্দ্রিক— উন্নয়নের আলোচনা; বণ্টনব্যবস্থার দুর্দশা; বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক গাফিলতির গবেষণা দিয়ে সমৃদ্ধ। কিন্তু এই দেশটা অর্থনীতির বইপত্রের গবেষণা টপকে কী ভাবে আয়বৃদ্ধির হার এত বাড়িয়ে ফেলল, তা নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু লেখা ছাড়া কিছুই নেই। তার কারণ মূলধারার অর্থনীতিতে ধনী দেশের সমস্যা বা বিজয়াভিযানের কথা ছাড়া তাত্ত্বিক স্তরে এ-হেন আয়বৃদ্ধির ঘটনা ব্যতিক্রম বলেই ব্রাত্য।
আমরা স্বীকার করি অথবা না-ই করি, ভারতের সামগ্রিক আয়বৃদ্ধির ঘটনা পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অভিজ্ঞতা। চিনের ইতিবৃত্তও এর কাছে ম্লান। ভারতের ব্যর্থতার তালিকাটি যে খুব ছোট নয়, তা অনস্বীকার্য। বড়লোকদের রোজগার যখন বিশ শতাংশ বাড়ছে, দরিদ্রের হয়তো পাঁচ শতাংশ, ফলে বৈষম্য ঊর্ধ্বমুখী। কিন্তু, এটাও অনস্বীকার্য যে, সবার আয় বেড়ে চলেছে তিন দশক ধরে। একেবারে প্রথম সারিতে দৌড়চ্ছে ভারত।
গবেষণায় উন্নতি, নতুন প্রযুক্তি, নতুন নতুন যন্ত্রপাতি এখন সবই খানিকটা ভার্চুয়াল জগৎ নির্ভর। সে সব প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে বাজারে নামতে গেলে, তার দৈনন্দিন ঝক্কিঝামেলা সামলাতে গেলে খানিকটা বুদ্ধিমান কম্পিউটারদক্ষ কর্মচারী প্রয়োজন। বিত্তশালী বিশ্বে শ্রমিকের জোগানে হাহাকার, ইউরোপ থেকে জাপান। ১৪০ কোটির দেশ বলে ভারতে কম্পিউটারদক্ষ শিক্ষিত কর্মী সংখ্যা অনায়াসে বিত্তশালী বিশ্ব প্লাবিত করতে পারে। তাই হচ্ছে।
এক বহুজাতিক সংস্থা কোনও কারণে ক্রুদ্ধ হয়ে ঠিক করেছিল, অন্য কোনও দেশে কাজের বরাত দেবে। দু’-তিন মাসের মধ্যে সিদ্ধান্ত পাল্টে তারা ফের ভারতেরই কিছু কোম্পানিকে বরাত দিতে বাধ্য হয়। কারণ, কম্পিউটার-নির্ভর প্রযুক্তি চালনায় দক্ষ এবং বিত্তশালী দেশের তুলনায় ভারতে সস্তার দক্ষ কর্মী সহজলভ্য, এখনও। দেশের ভিতরে স্টার্টআপ সম্পর্কিত কমবয়সি উদ্যোগপতি এ দেশে গত দশকে বেশ খানিকটা বেড়েছে। ভবিষ্যতে সেখানে বিনিয়োগ বাড়তে বাধ্য। অনেক ক্ষেত্রেই এ ধরনের কোম্পানি ভারতের পরিষেবা ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত।
প্রকৃতি যদি কৃষিক্ষেত্রকে খুব বেশি ব্যতিব্যস্ত না করে, তা হলে ভারতে কারখানা হোক না হোক, বিত্তশালী দেশগুলোর প্রয়োজনেই ভারতে লক্ষ্মী চঞ্চলা হবেন না। যখনই কম্পিউটার-নির্ভর প্রযুক্তির চালনায় দক্ষ কম্পিউটার কর্মীর প্রয়োজন হবে, ভারতকে অদূর ভবিষ্যতে টেক্কা দেওয়া শক্ত হবে। ডিজিটাল টেকনলজির সুফল পেতে ভার্চুয়াল ব্যবসার থেকে মুনাফা করতে কিংবা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স-প্রসূত সমস্যার সমাধানে তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে ভারতীয় শ্রমের জোগানের উপর নির্ভরতা কমবে না। অবশ্যই বৈষম্যের গতি এই কারণে এবং অন্য অনেক কারণে রুদ্ধ হবে না। কিন্তু বাবা-মা জমিতে কাজ করতেন, ছেলে-মেয়ে কম্পিউটারের দৌলতে সারা পৃথিবীতে কাজ করছে, এক অর্থে বৈষম্য আজ কম, সেটাই বা দেখব না কেন?
যদি কম্পিউটার না আবিষ্কার হত, তা হলে ভারতের কী হত, ভেবে দেখতে পারেন। প্রযুক্তির আবিষ্কর্তার চেয়েও যে তার ব্যবহারকারী সেই প্রযুক্তি থেকে বেশি লাভবান হতে পারে, এটাই অর্থশাস্ত্রের নতুন শিক্ষা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy