— প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
গত জুলাই মাসে ভারতে দরিদ্র মানুষের অনুপাত নিয়ে একটা রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল নীতি আয়োগ। রিপোর্টে বলা হয়েছিল, বিজেপির শাসনকালে দারিদ্রের অনুপাত ও তীব্রতা দুই-ই উল্লেখযোগ্য ভাবে কমেছে। রিপোর্ট বলছে, ২০১৫-১৬ সালে গোটা দেশে ২৪.৮৫% মানুষ দরিদ্র ছিলেন। ২০১৯-২১’এ পৌঁছে অনুপাতটি হয়েছে ১৪.৯৬%। গ্রামে দারিদ্রের অনুপাত ৩২.৫৯% থেকে কমে হয়েছে ১৯.২৮%, শহরে ৮.৬৫% থেকে ৫.২৭%। নির্বাচনের আগে এই রিপোর্ট নিয়ে বিস্তর চর্চা চলছে।
সংখ্যাগুলো দেখে কিছুটা খটকা লাগা স্বাভাবিক। যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, তার মধ্যেই তো ঘটেছিল নোটবন্দি, তার মধ্যেই তো অতিমারি তার করাল ডানা বিস্তার করেছিল। নোটবন্দি এবং অতিমারি— বিশেষ করে অতিমারি— অবস্থাপন্নদের তুলনায় গরিব মানুষকেই বেশি বিপাকে ফেলেছিল। তা সত্ত্বেও দারিদ্র এতটা কমল কী করে?
ব্যাপারটা বোঝার জন্য প্রথমেই দেখা দরকার, নীতি আয়োগ কী ভাবে দারিদ্র মাপছে। আগে দারিদ্র মাপা হত খরচের একটা পূর্বনির্দিষ্ট মাপকাঠি দিয়ে। যেমন, একটা বহুল-প্রচলিত মাপকাঠি ছিল মাথাপিছু দৈনিক এক ডলার খরচ করার ক্ষমতা। দিনে এক ডলার খরচ করার ক্ষমতা যাঁদের নেই, এই মাপকাঠি অনুযায়ী তাঁদের গরিব বলা হত। একই ভাবে কখনও দৈনিক দু’ডলার খরচের মাপকাঠি, আবার কখনও টাকার অঙ্কে খরচের মাপকাঠি ধার্য করে দারিদ্র মাপা হত। নীতি আয়োগ কিন্তু একেবারে অন্য ভাবে দারিদ্র মেপেছে।
খরচ করার ক্ষমতা দিয়ে নয়, নীতি আয়োগ দারিদ্র মেপেছে বহুমাত্রিক মাপকাঠিতে। প্রথমে স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং জীবনযাত্রার মান— এই তিনটি মূল ক্ষেত্র বেছে নেওয়া হয়েছে। একটি পরিবার কতটা বঞ্চিত, তা বোঝার জন্য প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়েছে— স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে তিনটি, শিক্ষা ক্ষেত্রে দু’টি, এবং জীবনযাত্রার মান বোঝার জন্য সাতটি। স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে প্রশ্ন— পরিবারে কেউ অপুষ্টিতে ভোগেন কি না, গত পাঁচ বছরে পরিবারে কোনও শিশুমৃত্যু হয়েছে কি না, গত পাঁচ বছরের মধ্যে সাম্প্রতিকতম সন্তানটিকে জন্ম দেওয়ার সময় পরিবারের মায়েরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ধাত্রী বা চিকিৎসকের সহায়তা পেয়েছিলেন কি না। শিক্ষা ক্ষেত্রে দেখা হয়েছে, পরিবারে দশ অথবা তার বেশি বয়সের অন্তত এক জন ন্যূনতম ছয় বছর স্কুলে পড়েছেন কি না, এবং এখন যে বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়ার বয়স, তারা কেউ অষ্টম শ্রেণির আগে স্কুলছুট হয়েছে কি না। জীবনযাত্রার মান বোঝার জন্য জিজ্ঞাসা করা হয়েছে রান্নার গ্যাস, শৌচালয়, পরিস্রুত পানীয় জল, বিদ্যুৎ, পাকা বাড়ি ও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের সুবিধা পরিবার পেয়েছে কি না এবং রেডিয়ো, টিভি, ফোন, সাইকেলের মতো দশটি সম্পদের মধ্যে একটিও পরিবারে আছে কি না।
কোনও প্রশ্নের উত্তর নেতিবাচক হলে পরিবার একটা নম্বর পাচ্ছে— এক-একটা প্রশ্নের জন্য এক-এক রকম নম্বর, প্রত্যেকটা ভগ্নাংশে। স্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রথম প্রশ্নটিতে ১/৬ নম্বর, অন্য দু’টিতে ১/১২ করে। শিক্ষা-সংক্রান্ত দু’টি প্রশ্নেই ১/৬ নম্বর, জীবনযাত্রার মান সংক্রান্ত সাতটি প্রশ্নের প্রত্যেকটিতে ১/২১ করে নম্বর। যেমন, পরিবারে অপুষ্টি থাকলে ১/৬ নম্বর পাওয়া যাচ্ছে, বাড়িতে বিদ্যুৎ না থাকলে ১/২১। আবার কোনও প্রশ্নের উত্তর ইতিবাচক হলে সেই প্রশ্নে পরিবার শূন্য নম্বর পাচ্ছে। সব ক’টা প্রশ্নের নম্বর যোগ করে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ নম্বর দাঁড়াচ্ছে ১ এবং প্রত্যেকটি পরিবারের মোট নম্বর হচ্ছে ০ থেকে ১-এর মধ্যে একটা সংখ্যা। প্রাপ্ত নম্বর যত বেশি, বঞ্চনাও তত বেশি। মোট প্রাপ্ত নম্বর ১/৩ বা তার বেশি হলে পরিবারটিকে দরিদ্র বলা হচ্ছে। উল্লেখ করা দরকার, এই প্রশ্নগুলি জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা-র চতুর্থ ও পঞ্চম দফায় ( যথাক্রমে ২০১৫-১৬ এবং ২০১৯-২১) করা হয়েছিল। সমীক্ষা থেকে প্রাপ্ত উত্তরগুলি দিয়ে নীতি আয়োগ দারিদ্রের হার হিসাব করেছে এবং তুলনার জন্য পাশাপাশি রেখেছে দু’টি সমীক্ষা থেকে হিসাব করা দারিদ্রের হার।
এ ভাবে বঞ্চনা মাপার সারবত্তা নেই, তা বলা যাবে না। কিন্তু বঞ্চনা মাপার সঙ্গে দারিদ্র মাপার কিছু মৌলিক তফাত আছে। দরিদ্র মানুষ নানা ভাবে বঞ্চিত হতে পারেন— কিন্তু তাঁর নিজের কাছে বঞ্চনার স্তরভেদ আছে, অনুক্রম আছে। অর্থাৎ তাঁর কাছে কিছু বঞ্চনা অন্যান্য বঞ্চনার তুলনায় অনেক বেশি পীড়াদায়ক। অনায়াসে বলা যায়, খাদ্য বা পুষ্টি তাঁর কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। টাকার অভাবে অনাহার-অর্ধাহারে থাকতে হলে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, শৌচালয়, গ্যাস বা বিদ্যুতের সুবিধা, এমনকি বাড়ির কাছে স্কুল থাকাটাও অর্থহীন হয়। তা ছাড়া, পকেটে টাকা না থাকলে তিনি ব্যাঙ্কে কী রাখবেন? গ্যাস বা বিদ্যুৎ কিনবেন কোথা থেকে? সরকারি খরচে তৈরি শৌচালয়টা হয়তো ছাগল রাখার জন্য পড়শিকে ভাড়া দিতে বাধ্য হবেন। স্কুলের খাতায় নাম লেখানো থাকলেও সন্তানদের ক্লাস কামাই করে অর্থ উপার্জনের চেষ্টা করতে হবে। সরকারি সাইকেল পেলেও সেটা বেচে দিতে হবে। হাতে টাকা থাকলে একটি পরিবার তার অগ্রাধিকার অনুযায়ী খরচ করতে পারে, নিজেই বেছে নিতে পারে কোনগুলো তার আগে দরকার। সে দিক থেকে দেখলে খরচের মাপকাঠি দিয়ে দারিদ্র মাপাটা অধিকতর অর্থবহ।
অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান— এই তিনটি মানুষের মৌলিকতম চাহিদা। অন্যান্য সুবিধা, যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক, কখনও এই তিনটির বিকল্প হতে পারে না। সমস্যা হল, নীতি আয়োগের মতো করে দারিদ্র মাপলে মৌলিক অগ্রাধিকারগুলো ধরা পড়ে না। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা বোঝা যাবে। ধরা যাক, একটি পরিবার অপুষ্টিতে ভুগছে, তারা বিশুদ্ধ পানীয় জল পায় না এবং তাদের বাড়িটাও পাকা নয়। বাকি সমস্ত প্রশ্নে পরিবারের অবস্থান ইতিবাচক। বস্ত্র সম্বন্ধে কোনও তথ্য যে-হেতু সমীক্ষা থেকে পাওয়া যাচ্ছে না, তাই ওটা হিসাব থেকে বাদ দিচ্ছি। নীতি আয়োগের স্থির করা নম্বর অনুযায়ী পরিবারটির মোট প্রাপ্ত নম্বর (১/৬ + ১/২১ + ১/২১), অর্থাৎ ১/৩-এর কম। অতএব এই পরিবারটিকে দরিদ্র বলা যাবে না। এটা থেকে মনে হবে যে, আধপেটা ভাত আর অপরিস্রুত জল খেয়েও, এবং জল-ঝড়ে মাথার চাল উড়ে যাওয়া আস্তানায় থেকেও, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, শৌচালয় ইত্যাদি সরকারি সুবিধা পেয়ে একটি পরিবার ভালই থাকতে পারে।
বস্তুত, অপুষ্টিই দারিদ্রের প্রধানতম সূচক। দুর্ভাগ্যবশত, নীতি আয়োগের হিসাবে যেখানে ২০১৯-২১’এ দারিদ্রের অনুপাত ১৪.৯৬ শতাংশে নেমে এসেছে, সেখানে নীতি আয়োগের হিসাবই জানাচ্ছে যে, ওই সময়ে অপুষ্টির হার ছিল ৩১.৫২%, অর্থাৎ দারিদ্রের অনুপাতের দ্বিগুণেরও বেশি। যদি বলি অপুষ্টি-দূরীকরণ হল দারিদ্র-দূরীকরণের প্রাথমিক শর্ত, কারণ অপুষ্টি মানেই অনাহার বা অর্ধাহার, তা হলে মেনে নিতে হবে যে, দারিদ্রের হার ১৪.৯৬% নয়, ৩১.৫২%। আবার বলছি, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট কিংবা গ্যাস-বিদ্যুতের সংযোগ খাদ্যের বিকল্প হতে পারে না।
যে সুবিধাগুলো গরিব মানুষের জন্যে সরকার তৈরি করতে পেরেছে, তার মূল্য কম নয়। সুস্থ, স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্যে তার প্রতিটিই প্রয়োজন। এর জন্য কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকারগুলির ধন্যবাদ প্রাপ্য। কিন্তু সরকার যেটা পারেনি সেটাও জোর দিয়ে বলতে হবে। সরকার এমন একটা অর্থনৈতিক বাতাবরণ তৈরি করতে পারেনি, যেখানে গরিব মানুষ সহজে কাজ পান, তাঁদের আয় বাড়ে, ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। আয় এবং ক্রয়ক্ষমতা বাড়লে অপুষ্টি সরাসরি কমত, গরিবকে সরকারি দাক্ষিণ্যের উপরে নির্ভর করতে হত না।
দীর্ঘ দিন মৌন থাকার পর ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে অফিস অতি সম্প্রতি ২০২২-২৩’এর পারিবারিক ব্যয় সংক্রান্ত তথ্য দিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এই তথ্য দেখিয়ে সরকার-ঘনিষ্ঠ থিঙ্কট্যাঙ্কগুলি চটজলদি দারিদ্র কমে যাওয়ার নানা রকম অলীক দাবি করছে, যেগুলি আদৌ গ্রাহ্য নয়। বোঝাই যাচ্ছে, আগামী লোকসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে দাবিগুলো করা হচ্ছে। নতুন তথ্যের উপরে ভিত্তি করে নতুন ভাবে দারিদ্রের হিসাব করা অবশ্যই সম্ভব। কিন্তু তার জন্য সময় লাগবে, সৎ গবেষণা ও পরিশ্রম লাগবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy