Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪
independence day

মায়ের আঁচলের মতো?

দানাদারের রস লাগা হাত ইউনিফর্মে মুছে গোলগাল চেহারার ফাইভের ছাত্রীটি গুটিগুটি পায়ে এগোচ্ছিল দড়িতে লাগানো কাগজের পতাকার দিকে।

সোনালী দত্ত
শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০২২ ০৫:১৩
Share: Save:

অনুষ্ঠানসূচি হাতে নিয়ে শশব্যস্ত ঘুরছেন দিদিমণি। উদ্বোধনী সঙ্গীতের মেয়েরা এখনও স্কুলে আসেনি। কাগজের তেরঙ্গা লাগানো হয়েছে মাঠের চার দিক ঘেরা প্রাচীরে। মাঠের কোণের বেদিতে রড লাগানো। তাতেই উঠবে আসল পতাকা। বড় ক্লাসের মেয়েদের ফুল আনতে বলা হয়েছে। ফুল দিয়ে ভারতের মানচিত্র আঁকা হবে। দিদিমণি উদ্‌ভ্রান্ত। প্রথমে তো পতাকাই উল্টো লাগানো হয়েছিল। বড় দিদিমণি এসে গিয়েছেন। অশিক্ষক কর্মচারীকে ধমকাচ্ছেন, মাঠে চেয়ার পাতা হয়নি কেন? চন্দন, গোলাপ কোথায়? প্রধান অতিথি বরণ করতে হবে না? মাইক্রোফোনে কুঁ কুঁ আওয়াজ হচ্ছে। কান পাতা দায়। অনুষ্ঠান শুরু হয়। উদ্বোধনী সঙ্গীত গাইবার সময় অনেকেরই চোখ থাকে, মোবাইল ক্যামেরায় ছবি উঠছে কি না। বড় ক্লাসের এক জন লম্বা একটা প্রবন্ধ পড়ল। সকলে বিরক্ত। নাচগান কখন হবে? শেষ পর্বে হিন্দি গানের সঙ্গে ‘হম হিন্দুস্থানি’ নাচ। জমে গেল একেবারে। তার পর নাটক। জলপাই রঙের মানুষজন আমাদের ‘অ্যায় ওয়াতন’ কেমন পাহারা দিচ্ছেন ‘জান ভি’ দিয়ে, সেই বিষয়ে। বড় দিদিমণির তোলা হাফ খোলা পতাকাটা মাঠের কোণে প্রাচীরের পাশের বাড়ির দোতলা বরাবর অল্প অল্প দুলছিল। যেন পেন্ডুলাম। যেন তার ক্লান্ত ডানায় দীর্ঘ পঁচাত্তর বছরের ক্লান্তি আর অঙ্গহানির যন্ত্রণা। ক্রমশ রোদ তীব্র হচ্ছিল। প্রধান অতিথির ভাষণ তাই সংক্ষিপ্ত। নেতাজি, গান্ধীজি বেশি এগোতে পারলেন না। এর পর জাতীয় সঙ্গীত আছে, মিষ্টি বিতরণ। ‘স্বাধীনতা দিবস’ বলে কথা!

দানাদারের রস লাগা হাত ইউনিফর্মে মুছে গোলগাল চেহারার ফাইভের ছাত্রীটি গুটিগুটি পায়ে এগোচ্ছিল দড়িতে লাগানো কাগজের পতাকার দিকে। একটা পতাকা বাড়ি নিয়ে যাওয়ার খুব ইচ্ছে তার। গত কাল ক্লাসে বাংলা দিদিমণি জিজ্ঞেস করেছিলেন, “স্বাধীনতা মানে বোঝো? আমাদের জাতীয় পতাকার গায়ে কত বিপ্লবীর রক্ত লেগে আছে, জানো?” বাচ্চা মেয়েটা জানে, ‘স্বাধীনতা’ মানে ১৫ অগস্ট। পতাকা তুলতে হয়। প্যারেড হয়। নাচগান হয়। তা হলে দিদিমণি অমন রেগে রেগে প্রশ্ন করছিলেন কেন? বিপ্লবী মানে কি ক্ষুদিরাম? তাঁর রক্ত লেগে আছে পতাকায়? মেয়েটা একটা কাগজ ধরে টান দিল। যাহ্, মাঝখান থেকে দু’টুকরো হয়ে গেল কাগজটা! তার মনে পড়ল ঠাকুমা বলেন, “বুক চিরা মাটি লইয়া নিল। তায় এ আবার স্বাধীনতা!” এই ভাবেই কি ঠাকুমার বুক চিরে কেউ মাটি নিয়ে নিয়েছিল? সে মাটিতে দশটা নারকেল গাছ, একটা পুকুর, সোনালি ধান আর গাছের ছায়ায় ছোট্ট একটা বাড়ি ছিল। টিন দিয়ে ছাওয়া। দেশভাগ কী, মেয়েটা জানে না। ঠাকুমাকে দেখে বোঝে তাঁর বেঁচে থাকার অর্ধেকটা ভাগ হয়ে অন্য কোথায় চলে গিয়েছে।

পাড়ার ‘সানস্কিতিক’ অনুষ্ঠান সন্ধেবেলা। সকালে পতাকা উত্তোলন, বক্তৃতা-টক্তৃতা। আসল ধামাকা সন্ধ্যায়। বাইরে থেকে আর্টিস্ট আসবে বলে শোনা যাচ্ছে। তার পর ছবি দেখানো হবে, বর্ডার। মন্দিরের চাতালে বসে মাথাগরম দাদু চিৎকার দেন, “কেন? বাংলা ভাষায় দেশভক্তি হয় না? বাংলা ছবি হয়নি স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে?” পাড়ার তরুণ ক্যাপ্টেনরা হাসে। হিন্দিতে যা জম্পেশ সব গান আছে, বাংলায় আছে? বাংলা ছবিতে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ দেখাতে পারবে? এরই মধ্যে কয়েক জন আবার বাজেট থেকে টাকা মেরে দেওয়ার তালে থাকে, দিলটা তো খুশ রাখতে হবে? বাড়িতে টাকা চেয়ে লাভ নেই। কোভিডের পর বাবা একেবারে খেপচুরিয়াস সর্বক্ষণ। মা’র সামনে পড়লে এক ঘ্যান ঘ্যান, গ্যাসের দাম। মাছের কিলো। ওষুধের খরচা।

দাদু নাকি ‘ফ্রিডম ফাইটার’ ছিলেন। প্রেস্টিজ জ্ঞান প্রবল ছিল বলে ‘পেনশন’ নেননি। এখন বাড়ির লোক বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে চায়, দাদু তবু নাছোড়। বলেন, “শুধুই কি কামান, বন্দুক, প্যারেড দেখাবি? আর যারা মিছিলে লাঠিপেটা খেল, গুলি খেল, ফাঁসি গেল, জেলে পচল। ১৫ অগস্ট তাদের দিন নয়? স্বাধীনতা কি আকাশ থেকে পড়ল?” সিগারেটে লম্বা টান মেরে স্টেজে আলো ফিট করতে করতে পাড়ার ক্যাপ্টেন ভাবে, এরা সব এত কষ্ট করেছিল কেন? কী লাভ হয়েছে তাতে? বোকার দল সব!

দিদিমণি এক বার মেয়েদের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন, “স্বাধীনতা কী বল দেখি?” ‘বন্দে মাতরম্’ থামিয়ে তারা অবাক চোখে তাকিয়েছিল। এ আবার কেমন প্রশ্ন? কেউ বলল, “ওই দিন ইংরেজ চলে গিয়েছিল।” কেউ বলল, “ওই দিন পতাকা তোলা হয়।” কেউ কিছুই বলল না। জেদ চেপে বসল দিদিমণির মাথায়। আবার প্রশ্ন: “তোমরা কি স্বাধীন?” মেয়েরা আরও ধাঁধায়। এক জন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “না, আমরা পরাধীন। আমরা নিজের ইচ্ছামতো চলতে পারি না।” কী রকম ইচ্ছে? মেয়েটার অবস্থা সঙ্গিন। বলল, “ফুটবল খেলতে চেয়েছিলাম। বাবা বলেছে, চলবে না। মেয়েরা ও সব খেলে না। কিন্তু দাদাকে বাবা বল কিনে দিয়েছে।” তাই শুনে আর এক মেয়ে বলল, “আমার দিদির তো বিয়েই দিয়ে দিল। পড়তে চেয়েছিল দিদি।”

‘আসর’-এর নমাজ শেষে এক শীর্ণকায় তরুণ আসে স্কুলের মাঠ পরিষ্কার করতে। কাগজের টুকরো, প্লাস্টিক, ফুল সব একটা ঝুড়িতে বোঝাই করে ক্লান্ত হয়ে সে বসে পড়ে বেদির পাশে। সূর্য অস্ত যায়, গাছের ছায়া মেলায় মাঠের ধুলোটে বুকে। তরুণ তার ছেঁড়া প্যান্টের পকেটে রাখে একটা ছোট চকলেট। ঘরে ফিরে ছোট বোনকে দেবে। মনে মনে বলে, “আল্লা ওকে ভাল রেখো।” কে যেন বলছিল, এ স্বাধীনতা নাকি তার নয়? এ দেশই নাকি তার নয়? তরুণ ভগৎ সিংহ হতে চাইত। তা হলে কি শহিদ ভগৎ সিংহও তার নন? ইতিহাস সে বেশি পড়েনি। সে কেন এই দেশের ‘সনাতন’ ঐতিহ্যের ধারক নয়, তাও বোঝে না। কিন্তু সচিন তেন্ডুলকরের খেলা তার খুব ভাল লাগে। ‘ভারতমাতা’ দেবী কি না, তাঁর অর্চনায় যাগযজ্ঞ দরকার কি না, এ সব তার মাথায় ঢোকে না। তবে পাশের বাড়ির মণ্ডল কাকিমা যখন পায়েস রেঁধে দিয়ে যান তার আর বোনের জন্মদিনে, খুব মনে পড়ে শৈশবে হারানো আম্মার কথা।

সূর্য অস্তাচলে। তরুণের মাথার উপর মায়ের আঁচলের মতো উড়ছে ভারতের জাতীয় পতাকা। একটু আবছা লাগলেও এখন তা আর গুটিয়ে নেই। চকলেটটা ঠিকঠাক আছে তো? তরুণ পকেটের উপর হাত রাখে সস্নেহে।

অন্য বিষয়গুলি:

independence day India
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy