—প্রতীকী ছবি।
দিন বদলের কালে দলও বদল হয়, লোকেরও বদল হয়। বাংলায় ২০১১-র পরিবর্তনের কালে অন্য নানা দল থেকে বহু লোক ও কর্মী জনবাদীদের সারিতে যোগ দিয়েছিলেন। বামপন্থীদেরও সারি থেকে এই ধরনের যোগদান ঘটেছিল উল্লেখযোগ্য ভাবে। সংশয়বাদীরা বলেছিলেন, এই দল বদল ও লোক বদল ঘটেছিল ব্যাপক সন্ত্রাসের ফলে। মানুষ গা বাঁচাতে জনবাদীদের দিকে চলে গিয়েছিল।
১৯৭৭-এর পরিবর্তনে এই একই ঘটনা লক্ষ করা গিয়েছিল। আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এই দল বদল চলেছিল। বামপন্থীদের শক্তিবৃদ্ধি প্রশাসনিক পটপরিবর্তন ব্যতিরেকে হত না। আজও এই ধরনের শক্তিবৃদ্ধি অন্য কোনও ভাবে সম্ভব নয়। ব্যাপক জনকল্যাণমুখী কর্মসূচি, গ্রামীণ ও শহুরে দরিদ্র ও নিম্নবিত্তদের মাঝে চমকপ্রদ প্রভাব বৃদ্ধি, এবং এক নতুন ধরনের রাজনৈতিক কর্মীর আবির্ভাব যাঁরা একাধারে একটি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, অন্য দিকে প্রশাসনিক কর্মসূচি রূপায়ণের অঙ্গীকার বহন করেন— এই ধরনের বৈশিষ্ট্য অবলম্বন করে পরিবর্তন-উত্তরকালে একটি দলের রাজনৈতিক শক্তিবৃদ্ধি হতে থাকে। জনবাদীদের শক্তিবৃদ্ধির ক্ষেত্রেও এ কথা আরও সত্য।
এক দিনে জনমুখী রাজনীতির অপ্রতিরোধ্য উপস্থিতি, অন্য দিকে হিসাব করে বলপ্রয়োগ, এই দুইয়ের সমন্বয়ে গ্রাম শহর জুড়ে এক নতুন শক্তির আধিপত্য সৃষ্টি হয়েছে, এবং মোটামুটি বেশ কিছু বছর ধরে এই আধিপত্যের ভিত শক্ত থেকেছে। অতীতে বামপন্থীদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও এ কথা সত্য। তবে, জনবাদী রাজনীতির যুগে এই সমন্বয়ের রসায়নে মাঝেমাঝেই বেহিসাব হয়ে যায়। তার জন্য শাসক রাজনৈতিক শক্তিকে মূল্যও চোকাতে হয়। শাসক শক্তির মুনশিয়ানা সেখানে, যখন সেই শাসক শক্তি আধিপত্যের সঙ্কট দ্রুত বুঝতে পারে, সমাজের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু করে, হৃত আলাপচারী সংস্কৃতিকে ফিরিয়ে আনে রাজনীতির অঙ্গ রূপে।
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে গণতন্ত্র কেতাবি বা সাবেক পদ্ধতিতে চলে না। সংসদ, নির্বাচন, সংবাদমাধ্যম, বিচারব্যবস্থা, আইনের অনুশাসন, রাজক্ষমতার দায়বদ্ধতা, নাগরিক সংস্কৃতি, নাগরিক অধিকার, গণতন্ত্রের এই কেতাবি দিকগুলোর উপর ছায়াবিস্তার করে থাকে এক মূর্ত বাস্তবতা এবং একই সঙ্গে এক বিমূর্ত ধারণা, যার নাম জনসাধারণ। এই জনসাধারণের রাজনৈতিক আচরণ এবং কর্মকাণ্ড কোন পথে এগোবে, তা নিশ্চিত করে বলা দুষ্কর। কিন্তু, কোনও নির্দিষ্ট মুহূর্তে জনসাধারণের রাজনৈতিক আচরণের স্বকীয়তা বা স্বাতন্ত্র্যকে বুঝে তাকে নিজস্ব কর্মসূচির পক্ষে নিয়ে আসা যায়, তা হল প্রত্যুৎপন্নমতি রাজনৈতিক নেতৃত্বের উদাহরণ। নয়া উদারনীতিবাদী অর্থব্যবস্থায় দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত জনসাধারণ চরম অনিশ্চয়তার সম্মুখীন। এই অনিশ্চিতির কালে, যা ‘অমৃতকাল’-এর ঠিক বিপরীত, কে জনগণকে বাঁচাবে? কে জীবনের নিরাপত্তা দেবে? কে বলবে, আমরা এই প্রশাসনের পক্ষ থেকে তোমাদের পাশে আছি? যে রাজনৈতিক শক্তি কালের এই প্রয়োজনের উপযুক্ত ভাষা জোগাবে, জনসাধারণ সেই রাজনৈতিক শক্তিকেই আঁকড়ে থাকবে তাদের রক্ষক রূপে। পরিস্থিতির এই বৈশিষ্ট্য। প্রথাগত রাজনীতির ভাঙনেরও এক সূচক।
এই অস্থিরতার যুগে রাজনৈতিক শক্তিসমূহের সামাজিক ভিত্তির চেহারা কী? আমাদের দেশের অর্ধাংশ কোনও দিন খবরের কাগজ পড়েননি, এবং মাত্র ১৫% মানুষ নিয়মিত কাগজ পড়েন। অর্থবানদের, বা সঠিক ভাবে বলা চলে উচ্চশিক্ষিত মানুষের, প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা অশিক্ষিতদের থেকে অন্তত ২৫% বেশি। অপরাধ করলেও প্রার্থিপদ লাভের সম্ভাবনা অনুরূপ। অথচ, ভোটদাতাদের অন্তত ৩০% দরিদ্র এবং আরও ৩৪% নিম্নবিত্ত। কিন্তু দরিদ্র ভোটদাতারা অন্তত শহরে অনেক সময় ভোট দেন না বা দিতে সমর্থ হন না। উচ্চ ও বিশেষত মধ্যবিত্তরা বেশি আগ্রহী ভোট দিতে।
এক সমীক্ষা অনুযায়ী ২০১৯-এ ভোটদাতাদের ২৩% ভোট দিয়েছিলেন কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোটকে, ৪৩% দক্ষিণপন্থীদের, এবং ২৬% অন্যান্য দল অর্থাৎ মূলত আঞ্চলিক দলগুলিকে। এক ভাষ্যকার বলেছেন, উচ্চবিত্ত, দরিদ্র, উচ্চবর্ণ, দলিত ও আদিবাসী জনসাধারণ, কারও কাছ থেকেই দক্ষিণপন্থীরা ৪৫ শতাংশের কম সমর্থন পায়নি। কেবল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলির মাত্র ৯% ভোট গিয়েছিল তাদের দিকে।
অতএব, এই বিপুল দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত জনগোষ্ঠীর সমর্থন অর্জনের ক্ষেত্রে দক্ষিণপন্থী ও আঞ্চলিক শক্তিগুলি আজ সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বী। নয়া উদারনীতিবাদী অর্থব্যবস্থার দুই সন্তান— কর্পোরেট পুঁজির সমর্থনে বলীয়ান দক্ষিণপন্থী শক্তি এবং ক্ষুদ্র উৎপাদক ও অসংগঠিত নিম্নবিত্ত এবং হতদরিদ্রদের সমর্থনে গড়ে ওঠা জনবাদীরা, যারা আঞ্চলিক ভাবে বলীয়ান— আজ তীব্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। কে এই ৪০% ভোটারের সমর্থন ও আনুগত্য অর্জন করবে? তাই আজ আমরা দিন বদলের কালে রাজনৈতিক সমাজের অস্থিরতা লক্ষ করছি। বেশ কিছু নেতা ও সংগঠকরা ভাবতে থাকেন, কোন দিকে যাব? কোন শক্তি এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হবে?
বিভিন্ন রাজ্যেই দল ভাঙছে, ভাগাভাগি হচ্ছে, আবার কেউ নিজের পুরনো দলে ফিরে যাচ্ছেন। আর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ, অন্যান্য দল থেকে নির্বাচনের প্রাক্কালে কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসীন দক্ষিণপন্থী দলে যোগ দিচ্ছেন এবং নির্বাচনে প্রার্থিপদ পাচ্ছেন। সর্বত্র এক অস্থিরতা এবং অনিশ্চিতি। প্রতিদ্বন্দ্বিতার তীব্রতায় স্থিতিশীল আনুগত্যে টান পড়ছে। নেতা কর্মিবৃন্দ ভয়ে এ দল ও দল করছেন। আর সঙ্গে রয়েছে নিরাপদ জীবনের হাতছানি। দুর্নীতিগ্রস্ত হলেও মুক্তি আছে, যদি কেন্দ্রের শাসক দলে যোগ দেওয়া যায়। কেন্দ্রীয় শাসকদের ‘ওয়াশিং মেশিন’-এর ভূমিকায় আজ আর কেউ বিস্মিত হন না।
নয়া উদারনীতিবাদী যুগের অনিশ্চয়তার মাঝে দরিদ্র জনসাধারণ কার দিকে যাবে? দক্ষিণপন্থী ও মৌলবাদী মতাদর্শের দিকে, না আঞ্চলিক জনবাদী শক্তির দিকে, যারা জনগণকে বলবে যে তোমাদের আমরা রক্ষা করব। আত্মশক্তিই জনসাধারণের নিরাপত্তার মূল শক্তি। আজকের ভাষায়, ‘গ্যারান্টি’।
সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তি অপেক্ষা জনবাদীরা অধিক উপলব্ধি করে এবং নিরাপত্তাহীন মানুষের আনুগত্য অর্জনের দিকে তাদের লক্ষ্য অবিচল থাকে। তাই তাদের শাসনের এক আপেক্ষিক স্থায়িত্ব নজর কাড়ে। জনবাদী রাজনৈতিক সংগঠনে কর্তৃত্বের হিসাবে কোনও গোঁজামিল নেই। আপাতদৃষ্টিতে সবল ও স্থায়ী দলীয় কাঠামো থাকে না জনবাদী রাজনৈতিক সাংগঠনিক বিন্যাসে। কিন্তু শাসনের দীর্ঘমেয়াদি চরিত্রে তার কোনও প্রভাব পড়ে না। বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, তামিলনাড়ু-সহ আরও কিছু রাজ্যে জনবাদী শাসন চলে দশ-পনেরো কখনও কুড়ি বছর ধরে। নির্বাচন আসে যায়, কিন্তু জনবাদী শাসন ভেঙে পড়ে না। শাসক-বিরোধিতার হাওয়া যে জনবাদীদের বিরুদ্ধে বইছে না। যেন আংশিক ব্যর্থতা সত্ত্বেও সরকার জনগণের সুরক্ষার প্রতীক— যেন ন্যূনতম মাত্রায় হলেও শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করেছে জনবাদী প্রশাসন। দক্ষিণপন্থী জনবাদীরাও এই কৌশল অনুসরণে সচেষ্ট। যে আত্মশক্তির কথা জনবাদীরা বলে, তা নির্বাচনী সাময়িকতাকে ছাপিয়ে যায়। ভাবে, এই শাসনের ত্রুটি তো আমাদের ত্রুটি। দোষ দেব, শুধরাবো, লোক পাল্টাব, কিন্তু আনুগত্য পাল্টাব না। আত্মশক্তির বাস্তবতা ও মোহময়তার এই দ্বৈতরূপ নিয়ে জনবাদী রাজনীতি সংসদীয় শাসন কাঠামোর সামনে এক প্রশ্নচিহ্ন রূপে আবির্ভূত।
সাধারণ মানুষের জীবনজীবিকার অনিশ্চিতি ও নিদারুণ সঙ্কটে চিহ্নিত জনজীবনের প্রাত্যহিকতার এই রূপ না বুঝলে আজকের গণ রাজনীতির অনিশ্চয়তার চেহারা বোঝা যাবে না। কোন দল কোন দল থেকে অপেক্ষাকৃত অধিক গ্রহণযোগ্য? নিজের নিজের মতো করে জনতার নানা অংশ, রাজনৈতিক নেতা অথবা কর্মীরা দল বেছে নেন। ধর্মনিরপেক্ষ দল থেকে ধর্মান্ধ দলে আনুগত্য সরিয়ে নিতে এক দিনের বেশি সময় লাগে না। এই রকম পরিবেশে দু’ধরনের রাজনীতি জনমানসে ছাপ ফেলে। এক, মতাদর্শ স্পষ্ট এই রকম দক্ষিণপন্থী রাজনীতি। অন্য দিকে, জীবিকার নিরাপত্তাহীনতা ও চরম অসাম্যের শিকার ও অনিশ্চয়তায় ভরা জনজীবনকে কেন্দ্র করে নিরাপত্তা ও সুরক্ষাকেন্দ্রিক রাজনীতি। এর নাম দেওয়া চলে তলা থেকে উঠে আসা জৈব-রাজনীতি— নিচুতলার জৈবআকাঙ্ক্ষা এবং জৈব-রাজনীতি কেন্দ্রিক এক জনবাদী কর্মসূচি।
হয় দক্ষিণপন্থী, কর্তৃত্ববাদী কেন্দ্রীকরণের রাজনীতি, নয় অঞ্চলে অঞ্চলে শিকড় গাড়া নীচের তলার জৈব-রাজনীতি, দিন বদলের কালে জনসাধারণের সামনে এই দুই বিকল্প উপস্থিত। জনবাদীরা তাদের শত ত্রুটি ও অসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও জৈব-রাজনীতির সম্ভাব্য রূপরেখা অথবা প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারছে। প্রশ্ন হল, যাঁরা সমাজ পরিবর্তনের ঘোষিত লক্ষ্যে রাজনীতি করেন, তাঁরা কি জৈব-রাজনীতির অমোঘ বাস্তবতা বুঝতে পারছেন? নিরাপত্তা ও সুরক্ষার আর্তিতে নিচুতলা থেকে উঠে আসা জৈব-রাজনীতির কোনও প্রাসঙ্গিকতা আমাদের দেশের কেতাবি বামপন্থী চিন্তাধারায় আজ পাওয়া যাবে কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy