বড় দুর্নীতিতে দেশের জাতীয় আয়ের ক্ষতি।
সব দুর্নীতি কি এক রকম হয়? কয়েকটি সংজ্ঞা অনুযায়ী ছোট দুর্নীতি এবং বড় দুর্নীতির বিভাজনও রয়েছে। বড় দুর্নীতিতে দেশের জাতীয় আয়ের ক্ষতি, আর ছোট দুর্নীতির প্রভাব ব্যক্তিবিশেষের উপর পড়ে— এ রকম একটা ধারণা প্রচলিত রয়েছে। রাফাল কেনার ‘কাটমানি’ সব করদাতার মিলিত সম্পত্তি থেকে কয়েক জনের উপরি রোজগার, আর রেশন কার্ড বা হাসপাতালের বেডবাবদ ঘুষ ব্যক্তিভিত্তিক হস্তান্তর।
গত দু’বছরের মধ্যে জার্মানির ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের করা স্বল্প নমুনার একটি সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, অন্তত ৩৯% ভারতীয় রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মী, আধিকারিক, বা ক্ষমতাশালী ব্যক্তিকে সরাসরি বা দালালের মারফত ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছেন। এশিয়ার বেশ কিছু দেশ থেকে প্রায় ২০ হাজার ব্যক্তিকে সমীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে ভারতের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি হারে ঘুষ দিতে হয়েছে পাসপোর্ট এবং আধার কার্ড জাতীয় পরিচয়পত্র পেতে। এর পরেই রয়েছে সরকারি পরিষেবা পেতে দেওয়া ঘুষের পরিমাণ। সরকারি চিকিৎসা পাওয়ার ক্ষেত্রে এশিয়ায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হারে ঘুষ দিতে হয়েছে সমীক্ষার অন্তর্গত প্রায় ২৪% ব্যক্তিকে। সব মিলিয়ে, ভারতের ৪০% উপভোক্তা মনে করছেন যে, দেশে দুর্নীতি বেড়েছে অন্তত ৪৫% হারে। সুতরাং, আপাত-ক্ষুদ্র দুর্নীতির প্রসারও যদি অত্যন্ত বেশি হয়, এবং স্থান মাহাত্ম্যে নির্দিষ্ট কিছু হাতে গচ্ছিত হয়, সে ক্ষেত্রে ছোট-বড়’র বিভাজনও আর অটুট থাকে না।
ভারতে এখন দুর্নীতি জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ— কোথাও তা মানুষকে বিচলিত করে এখনও, কোথাও চোখেই পড়ে না। দুর্নীতির ধরন, দৃষ্টান্ত, পরিমাণ যা-ই হোক না কেন, প্রত্যেকটি থেকেই যে আর্থিক ক্ষতি এবং সামাজিক বঞ্চনা সৃষ্টি হচ্ছে, এই কথাটি জনচেতনায় কোনও ভাবেই ঠাঁই পায় না। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি দুর্নীতি প্রকাশ্যে আসায়, এবং উদ্ধার হওয়া স্তূপীকৃত টাকা দেখে অনেকেই মনে করছেন যে, এটা দুর্নীতির পরিচয় বটে, কিন্তু এটাই তো একমাত্র নয়। পিএম কেয়ার্স-এর ১৪,০০০ কোটি টাকার হিসাব না দেওয়া, তার ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেওয়া, এমন সমস্ত জাতীয় আর্থিক নীতি সৃষ্টি করা, যাতে কয়েকটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বৃহৎ থেকে বৃহত্তর হতে পারে ইত্যাদি বহু ধরনের দুর্নীতি কেন যথেষ্ট গুরুত্ব পাচ্ছে না? ঘটনা হল, দুর্নীতির মাথা আর শুঁড় অনেক দূর বিস্তৃত, কারণ ক্ষমতার অলিন্দে বাজারজাত পণ্য হিসেবে দুর্নীতির লেনদেন হয়। ছোট দুর্নীতি এবং বড় দুর্নীতি ক্রমশ পরিপূরক হয়ে উঠছে এ দেশে— সেগুলিকে আলাদা করে দেখার আর উপায় নেই। যেটুকু ভোটদাতার কাছে খবর হয়ে আসে, তা আসলে সিনেমার ট্রেলারের মতন। বাকি সিনেমাটা দেখার অধিকার জনসাধারণের নেই, ফলে পুরো ছবিটা আমাদের অজানাই থেকে যায়।
এ বিষয়ে একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। যে-হেতু সমীক্ষা বলছে যে, যত মানুষ ভারতে ঘুষ দিয়ে থাকেন, তাঁদের মধ্যে আশি শতাংশই রাজ্যস্তরে ঘুষ দিতে বাধ্য হন বিভিন্ন সুবিধা, পরিষেবা পাওয়ার জন্য, এবং ইদানীং বহু অবৈধ কাজ চালিয়ে যাওয়ার লাইসেন্স হিসেবে, ফলে মনে করা যেতে পারে যে, দুর্নীতিচক্রের শুরুটা বেশির ভাগ সময়ে নিম্নস্তরে হয়ে থাকে। যেমন, শহরের বিভিন্ন রাস্তার ধারে ইট, বালি, পাথরকুচির অবৈধ স্তূপ, আর তার পাশে ফুটপাত আটকে ছোট ‘অফিস’ এখন পুরপিতা-মাতাদের আশীর্বাদে রমরমে ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। এ বাবদ রোজগার ব্যবসায়ী, পুলিশ এবং নেতাদের কাছে যাচ্ছে সরাসরি।
যে-হেতু এই ব্যবসায় গোডাউন ভাড়া নেওয়ার খরচও বেঁচে যাচ্ছে, ফলে পাড়ার প্রোমোটার তুলনায় সস্তায় এগুলো কিনে নিম্নমানের বাড়ি তৈরি করছেন, কিন্তু চলতি বাজারদরে তা বিক্রি করছেন; এবং ‘পুরসভাকে তো কিছু দিতেই হবে’, এই অছিলায় ১০% থেকে ৩০% মূল্য কালো টাকায় দাবি করছেন। এ ঘটনা এত প্রচলিত যে সবাই জানে। যারা অনিয়মের রোজগার করছে, তাদের অধিকাংশই আয়কর বিভাগের নজরে পড়ে না বিভিন্ন কারণে। কিন্তু মোট উৎপাদনের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ এই রোজগার রাজস্ব ঘাটতি বাড়াচ্ছে কর ফাঁকি দিয়ে, আবার বিভিন্ন খরচের হাত ধরে অর্থনীতিতে ফেরত এসে পণ্যের দামও যে বাড়াচ্ছে, সে বিষয় কি আমরা ওয়াকিবহাল?
অবশ্য জানলেও কিছু করা যাবে তা নয়। কারণ যারা এর সঙ্গে যুক্ত, তারা সঠিক জায়গায় প্রণামী দিয়ে চলেছে নিয়মিত, যার দরুন স্থিতাবস্থা বজায় রাখা কঠিন হচ্ছে না। কিন্তু স্থানীয় ভাবে ক্ষমতাশালী যারা এই বেনিয়ম করছে, তারা কিন্তু আরও বড় দুর্নীতি-ব্যবসায়ীর খাতায় নথিভুক্ত রয়েছে। যথাসময়ে তারও দাম দিতে হবে, এবং অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ক্ষমতা ভাগাভাগির মধ্যে দিয়ে। ছোট দুর্নীতির সঙ্গে বড় দুর্নীতির এই যোগসূত্র ভারতের নতুন পরিচয়, কারণ আগে আর্থিক দুর্নীতিকে রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহার করা হলেও তা প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে ওঠেনি কোনও ভাবেই।
অনেকে মনে করেন, যে-হেতু বৃদ্ধির সুফল সবার কাছে পৌঁছয় না, ফলে এক শ্রেণির মানুষ দুর্নীতির সহায়তায় আর্থিক এবং সামাজিক পদোন্নতির রাস্তা খোঁজে, আর সময়ের সঙ্গে আরও জটিল দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে জমি-বাড়ি জবরদখল থেকে পিছনের দরজা দিয়ে সরকারি চাকরি, সবই থাকে। শিক্ষকের চাকরি তো সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার মাপকাঠি। তবে আকাঙ্ক্ষা সর্বত্র এক রকম নয়। উত্তর-পশ্চিম ভারতে বাহুবলীরা হাজার একর জমিতে ঠাকুর হিসেবে রাজত্ব করে সম্মাননীয় হন; উত্তরপ্রদেশের নামকরা ডাক্তার বাড়িতে পাঁচ-দশ লক্ষ নগদ টাকা না রাখলে নিজেকে বঞ্চিত মনে করেন; আর কোথাও সামাজিক ভাবে উতরোতে গেলে পরের প্রজন্মের জন্যে শিক্ষা কিনতে হয়, সরকারি চাকরি কিনতে হয়। দেশব্যাপী দুর্নীতির বীজ ক্ষুদ্র পরিসর থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতা নির্ধারণের সূত্র হয়ে উঠলে বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়। ছোট দুর্নীতি আটকাতে কোথায় শুরু করব তা হলে?
ছোটদের দিয়েই শুরু করা যায়। রাষ্ট্রপুঞ্জের মাদক এবং অপরাধ বিষয়ক দফতর দুর্নীতি নিয়ে অনেক ব্যতিক্রমী পুস্তিকা এবং বিবরণী প্রকাশ করে থাকে। এর সঙ্গে এই শাখা ক্রমাগত প্রয়াস করে চলেছে, যাতে স্কুলের পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে কোনও ভাবে দুর্নীতি বিষয়ক কিছু বক্তব্য নিয়ে আসা যায়। অনেক পাঠ্যক্রম শুরুও করেছে ভিয়েনায় অবস্থিত রাষ্ট্রপুঞ্জের এই দফতর। এগুলো ভারতে কিছু পাঠ্যক্রমের অংশ হলে হয়তো সংবেদনশীলতা বাড়বে। ইটালির স্কুলে যদি মাফিয়ার বিরুদ্ধে শিশুদের অবহিত করার প্রচেষ্টা চলতে পারে, দুর্নীতি কী এবং তা কেন খারাপ, সে বিষয়ে ভারতে সচেতনতা বাড়ানোর যুক্তি অজস্র।
অর্থনীতি বিভাগ, সেন্টার ফর স্টাডিজ় ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস, কলকাতা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy