ধনী বা দরিদ্র, সব দেশেই দুর্নীতি আছে। ফাইল চিত্র।
বিশ্ব ব্যাঙ্কের দুর্নীতি বিষয়ক প্রতিবেদন বলছে, দুর্নীতি একটি মৌলিক উন্নয়ন সমস্যা। এক দিকে দুর্নীতি দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে, অন্য দিকে তা দরিদ্র ও দুর্বলতমদের উপরে অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রভাব ফেলে— আয় হ্রাস পাওয়া, ব্যয় বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও ন্যায়বিচার-সহ পরিষেবা থেকে বঞ্চনা ইত্যাদি ঘটে থাকে।
ধনী বা দরিদ্র, সব দেশেই দুর্নীতি আছে। তবুও অনেকেরই অভিমত যে, ধনী দেশগুলিতে যে ধরনের দুর্নীতি হয়ে থাকে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেশের সাধারণ মানুষের উপরে তার প্রত্যক্ষ প্রভাব দরিদ্র দেশগুলির তুলনায় কম। ২০২২ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল-এর ‘করাপশন পার্সেপশনস ইন্ডেক্স’ থেকেও দেখা যাচ্ছে, এই সূচক অনুসারে যে দেশগুলিতে সরকারি ক্ষেত্রে দুর্নীতির হার সর্বাধিক যেমন সোমালিয়া, বুরুন্ডি, ইয়েমেন— এদের মাথাপিছু আয় সর্বনিম্ন। অন্য দিকে, সরকারি ক্ষেত্রে দুর্নীতির হার যে দেশগুলোয় সবচেয়ে কম, যেমন ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, নিউ জ়িল্যান্ড, নরওয়ে, সিঙ্গাপুর— মাথাপিছু জাতীয় আয়ের নিরিখে সেগুলি সবই ধনী দেশ।
তবে এটি বিভিন্ন গবেষণায় প্রতিষ্ঠিত যে, গরিব দেশগুলিতে দুর্নীতির এই ব্যাপকতার একটা বড় কারণ হল এক দিকে চড়া আর্থিক বৈষম্য, অন্য দিকে রাষ্ট্রের কাছে প্রয়োজনীয় পরিষেবা দেওয়ার মতো সম্পদের অভাব। ফলে অপরিহার্য পরিষেবার চাহিদা আর জোগানের মধ্যে বিস্তর ফারাক। ধনী দেশে এ ধরনের দুর্নীতির অবকাশ কম।
দুর্নীতি ও সামাজিক রীতির মধ্যে একটি দুষ্টচক্র কাজ করে। দুর্নীতিকে যদি প্রাথমিক স্তরেই আটকে না ফেলা যায়, যদি তা ব্যাপক হয়ে ওঠে, তখন তা সামাজিক রীতি বা নীতিতে রূপান্তরিত হয়। এ প্রসঙ্গে দু’টি গবেষণার কথা উল্লেখ করা যায়। গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে আমেরিকার হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির দুই অর্থনীতির গবেষক ছাত্র রেমন্ড ফিশম্যান এবং এডওয়ার্ড মিগুয়েল দুর্নীতি এবং সামাজিক রীতি একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কি না, তা যাচাই করার জন্য নিউ ইয়র্ক শহরের ম্যানহাটনে রাষ্ট্রপুঞ্জের দফতরকে বেছে নিলেন। সেখানে পার্কিং-এর জায়গা যতটুকু, তা কর্মরত বিভিন্ন দেশের সব কূটনীতিকের গাড়ি রাখার জন্য যথেষ্ট নয়। ফলে, সেখানে জায়গা না পেলে দুটো উপায়— এক, বেআইনি ভাবেই আশেপাশে কোথাও পার্কিং করা; দুই, দূরে আইনসঙ্গত পার্কিং করে আসা।
এই দুই অর্থনীতিবিদ ১৯৯৭ সালের নভেম্বর মাস থেকে ২০০৫ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত এই অঞ্চলে যত এই ধরনের পার্কিং নিয়ম লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছিল, তার বিশদ তথ্য সংগ্রহ করলেন— কূটনীতিকের নাম, কোন দেশের নাগরিক, কোন জায়গায় আইন লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছিল ইত্যাদি। উদ্দেশ্য, কোনও দেশের কূটনীতিবিদদের আইন ভাঙার হারের সঙ্গে তাঁদের দেশের দুর্নীতির হারের একটা তুলনা করা। উল্লেখ করা জরুরি যে, আন্তর্জাতিক কূটনীতির রীতি অনুসারে আইন ভাঙলেও এই কূটনীতিকদের জরিমানা হত না। ফলে, এ ক্ষেত্রে যাঁরা আইন মেনে পার্কিং করেছেন, তাঁরা জরিমানার ভয়ে করেননি, করেছেন আইন মানার অভ্যাসের ফলেই।
দেখা গেল, যে দেশগুলিতে বিশ্ব ব্যাঙ্কের সংজ্ঞা অনুসারে তুলনামূলক ভাবে দুর্নীতি অনেক কম, যেমন নরওয়ে, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস, সেই দেশের কূটনীতিকদের মাথাপিছু বার্ষিক আইন লঙ্ঘনের হার দশ-বারের কাছাকাছি। দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলির কূটনীতিকদের ক্ষেত্রে এই হার গড়ে প্রায় ৩০। কিছু দেশে আরও অনেক বেশি— যেমন চাদ (১২৬), সুদান (১২১), আলবেনিয়া (৮৬)।
দেশের সুশৃঙ্খল সামাজিক নিয়ম বা রীতি, যা হয়তো বা দেশের কড়া আইন ও তার যথোপযুক্ত প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, শাস্তি পাওয়ার ভয় না থাকলেও মানুষকে দুর্নীতিমূলক কাজ থেকে বিরত রাখে। কেউ নিজেকে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত করবে কি না, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে চার পাশে তাকিয়ে দেখে— বোঝার চেষ্টা করে অন্যরা কী ভাবছে। এই প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর ‘টিচার ট্রুয়্যান্সি ইন ইন্ডিয়া— দ্য রোল অব কালচার, নর্মস অ্যান্ড ইকনমিক ইনসেনটিভস’ গবেষণাপত্রটি বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।
অধ্যাপক বসু ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে শিক্ষকদের কর্তব্যচ্যুতি ও না বলেকয়ে কামাই করার ক্ষেত্রে সামাজিক নীতি ও রীতির প্রভাবের কথা আলোচনা করেছেন। ২০০৪ সালে ভারতে শিক্ষকদের অনুপস্থিতির হার সর্বোচ্চ ছিল ঝাড়খণ্ডে (৪১.৯%) আর সবচেয়ে কম মহারাষ্ট্রে (১৪.৬%)। দুই রাজ্যে এই সময়ে শিক্ষকদের বেতন ও আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধার হার, এবং কর্তব্যচ্যুতির শাস্তি ছিল সমতুল, ফলে সে যুক্তিতে শিক্ষকদের আচরণের পার্থক্য ব্যাখ্যা করা যাবে না। দুই রাজ্যে শিক্ষকদের কর্তব্যচ্যুতির হারে ফারাকের মূল কারণ হল, শিক্ষকদের কাজে ফাঁকি দেওয়ার ক্ষেত্রে দুই রাজ্যে দু’ধরনের সামাজিক মনোভাব। যে রাজ্যে এই দায়িত্বজ্ঞানহীনতায় সামাজিক অনুমোদন যত কম, সেই রাজ্যে এমন ফাঁকিবাজি সামাজিক ভাবে ততই ‘ব্যয়সাপেক্ষ’। মহারাষ্ট্রে অনুমোদনের মাত্রা ঝাড়খণ্ডের তুলনায় কম, ফলে ফাঁকিও কম ছিল।
সাম্প্রতিক কালে পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতির যে আভাস মিলেছে, সামাজিক স্তরে তাকে অত্যন্ত ঘৃণ্য কাজ বলে প্রতিষ্ঠা করা খুবই জরুরি। সাম্প্রতিক পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষার পরিসংখ্যান বলছে, এ রাজ্যে বহুমাত্রিক দারিদ্রের হার ১৫.৩%, যা সর্বভারতীয় গড় ১৬.৪ শতাংশের চেয়ে সামান্যই কম। গ্রামীণ বাংলায় এই হার ২০%, পুরুলিয়া জেলার (৩৬.৯%) অবস্থা আরও খারাপ। দারিদ্র, দুর্নীতি ও সামাজিক রীতির দুষ্টচক্রের কথা মাথায় রেখে এখনই দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা ও প্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার, না-হলে বড় দেরি হয়ে যাবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy