Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
ব্রিটিশ রাজ ও জাতীয় রাজনীতির অংশ ছিল চলচ্চিত্র দুনিয়াও
cinema

ছবিতে সাম্রাজ্য থেকে দেশ

ব্রিটিশ সেন্সরশিপের সঙ্গে মোকাবিলা করেও জাতীয়তাবাদের প্রচারে চলচ্চিত্রমাধ্যমটি কত ভাবে ব্যবহার হয়েছে, সেই অনুসন্ধান এখনও সীমিত।

গান্ধীজি সিনেমার ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন না।

গান্ধীজি সিনেমার ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন না।

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৭ অগস্ট ২০২২ ০৪:৪৫
Share: Save:

কথা ছিল ১৪ অগস্ট মধ্যরাতেই ছবিটির উদ্বোধন হবে। রাত্রি ১টা বেজে ১ মিনিটে উত্তরা সিনেমা হলে মেয়র সুধীরচন্দ্র রায়চৌধুরী পতাকা তুলবেন। তার পর দেখানো হবে অগ্রদূতের পরিচালনায় প্রথম ছবি স্বপ্ন ও সাধনা। অনুষ্ঠানটি শেষ পর্যন্ত হয়নি, যত দূর জানা যায়। কিন্তু এমন একটি পরিকল্পনা যে হয়েছিল, তা থেকেই বোঝা যাচ্ছে স্বাধীনতা প্রাপ্তির রাতটিকে স্মরণীয় করে রাখতে চলচ্চিত্রেরও একটা ভূমিকা নেওয়ার কথা ছিল। উত্তরায় যেমন পতাকা উত্তোলনের কথা ভাবা হয়েছিল, উজ্জ্বলায় ওই শো-টি শুরু হওয়ার আগে রেডিয়োতে সংসদ ভবনের অনুষ্ঠান শোনানোর বন্দোবস্ত হয়েছিল। রূপালী সিনেমায় চলছিল হিন্দি ছবি রতন। সে দিন মধ্যরাতে রইল তার বাড়তি শো। বাণীরূপায় (পরে সুরশ্রী) মধ্যযামে বিশেষ মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হল। ১৫ তারিখ থেকে বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে চলতি শো-এর শেষে পর্দায় ত্রিবর্ণ পতাকা এবং নেপথ্যে সমবেত বন্দে মাতরম্ সঙ্গীত বাজানো হতে থাকল। এই বিশেষ রিলটি সংগ্রহ করার জন্য কাগজে দিনকয়েক আগে থেকেই বিজ্ঞাপন দিচ্ছিলেন পরিবেশকরা। পতাকার রং যে নিখুঁত হয়েছে, মিলছিল সেই আশ্বাস। সেই সঙ্গে বহু প্রেক্ষাগৃহেই চলতি ছবির সঙ্গে প্রদর্শিত হতে লাগল অরোরার তৈরি জয়তু নেতাজী।

স্বাধীনতা আন্দোলন এবং চলচ্চিত্রের আন্তঃসম্পর্কের আলোচনা সততই নিবদ্ধ থাকে কিছু নির্দিষ্ট ‘দেশাত্মবোধক’ ছবির কথায়। কিন্তু ব্রিটিশ সেন্সরশিপের সঙ্গে মোকাবিলা করেও জাতীয়তাবাদের প্রচারে চলচ্চিত্রমাধ্যমটি কত ভাবে ব্যবহার হয়েছে, সেই অনুসন্ধান এখনও সীমিত। যেমন ধরা যাক, দেশীয় নিউজ়রিল। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ছবি তুলেছিল ম্যাডান ফিল্ম কোম্পানি। সে ছবি নিষিদ্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তিরিশের দশক থেকে প্রেক্ষাগৃহে কাহিনিচিত্রের সঙ্গে নিউজ়রিল দেখানোর যে ঢেউ আসে, তাতে দেশীয় কোম্পানির তোলা জাতীয় নেতৃবর্গের অনুষ্ঠানও নিয়মিত থাকত। কলকাতায় যেমন ১৯৩৪ সালে ভারতলক্ষ্মী সিনেমা হলের (পরে প্রভাত) বিজ্ঞাপনে ছবি দিয়ে বড় বড় হরফে লেখা হচ্ছে কংগ্রেসের বম্বে অধিবেশনের ৯ রিলের সবাক চিত্র দেখানো হবে বম্বে টকিজ়ের কর্ম্ম ছবির সঙ্গে। ১৯৩১ সালে পার্ল সিনেমা হলে (পরে জ্যোতি) ছবির সঙ্গে শোনানো হচ্ছে যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের বক্তৃতা, ১৯৩৮-এ প্যারাডাইস এবং গণেশ টকিজ়ে থাকছে হরিপুরা কংগ্রেসে গান্ধী এবং সুভাষচন্দ্রের বক্তৃতা, ১৯৩৯-এ প্যারাডাইসে ভাবী ছবির সঙ্গে বম্বে শহরে রাজেন্দ্র প্রসাদের অভ্যর্থনা, চিত্রা (পরে মিত্রা) আর নিউ সিনেমায় প্রমথেশ বড়ুয়ার রজত জয়ন্তী-র সঙ্গে অরোরার তোলা মহাজাতি সদনের ভিত্তিস্থাপন অনুষ্ঠান, যেখানে সুভাষচন্দ্রকে ‘দেশনায়ক’ বলে ভূষিত করছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

অথচ মনে রাখা দরকার, গান্ধীজি সিনেমার ব্যাপারে উৎসাহী তো ছিলেনই না, বরং চলচ্চিত্রকে রীতিমতো ক্ষতিকারক জিনিস বলেই মনে করতেন। সিনেমায় গান্ধীর আদর্শ এবং কংগ্রেসের কথা উঠে আসা কিন্তু তাতে থেমে থাকেনি। গান্ধীজির ডান্ডি অভিযানের ছবি তুলেছিল অন্তত চারটি দেশি ফিল্ম কোম্পানি। বিশের দশকের গোড়ার দিকেই ভক্ত বিদুর (১৯২১) ছবিতে শারীরিক নির্যাতনের দৃশ্যে অভিনয় করার সময়ে শেঠ দ্বারকাদাস নারায়ণদাস সম্পত সহ-অভিনেতাদের বলেছিলেন, মনে করুন আমি গান্ধী আর আপনারা ব্রিটিশ অফিসার। ওই ভাবে মারবেন আমাকে। কোহিনুর ফিল্মস-এর নির্বাক এই ছবি যখন দেখানো হত, চরকা সহযোগে গাওয়া হত দেশাত্মবোধক গান। সেন্সরের কোপে বাদ পড়েছিল এ ছবির প্রায় ২২টি দৃশ্য। চল্লিশের দশকে বন্ধন ছবির ‘চল রে নওজোয়ান’ কিংবা কিসমত-এর ‘দূর হটো অ্যায় দুনিয়াওয়ালো’র মতো গান লোকের মুখে মুখে ফিরেছে, আলোচিতও হয়েছে বারংবার। বিশেষ করে, কিসমত-এর গীতিকার প্রদীপ কী ভাবে ব্রিটিশদের বুঝিয়েছিলেন যে গানটি আসলে অক্ষশক্তিকে ভেবে লেখা এবং গ্রেফতারি এড়িয়েছিলেন, সে কাহিনি কিংবদন্তি হয়ে রয়েছে। কিন্তু তারও আগে শ্যামলাল গুপ্তের লেখা ‘ঝান্ডা উঁচা রহে হামারা’র কথা একটু বদলে নিয়ে সে গান যে এমনকি ফিয়ারলেস নাদিয়ার অ্যাডভেঞ্চার ছবিতেও (লুটারু ললনা, ১৯৩৮) ঢুকে পড়েছিল, সেটা অনেকাংশে বিস্মৃতির শিকার হয়েছে। গান্ধীজির বার্তাকে পাথেয় করেই সে সময় তৈরি হয়েছে মদ্যপান বিরোধী কর্মসূচি নিয়ে আস্ত ছবি, ব্র্যান্ডি কি বটল (১৯৩৫), হরিজন আন্দোলন নিয়ে মালাপিল্লা (১৯৩৮, তেলুগু) এবং সচ হ্যায় (১৯৩৮)। বস্তুত, সরাসরি রাজনৈতিক মুক্তি সংগ্রামের কথা বলা মুশকিল বলে তিরিশ এবং চল্লিশ দশকের বহু ছবিই মনোনিবেশ করেছিল সামাজিক সমস্যার বিষয়গুলিতে। দেশগঠনের বার্তা সেখানে থাকছিল প্রচ্ছন্ন ভাবে, সেন্সরকে না চটিয়ে। বাংলায় নিউ থিয়েটার্স, মহারাষ্ট্রে ভি শান্তারামের প্রভাত ফিল্মস ছিল তার পুরোভাগে। বম্বে টকিজ়ের অচ্ছুত কন্যা নিয়ে কংগ্রেসের অনেক নেতাই উচ্ছ্বসিত ছিলেন। সরোজিনী নাইডু নিজে ছবি দেখে জওহরলাল নেহরুকে ছবি দেখতে উদ্বুদ্ধ করেন। গান্ধীর বিরাগ থাকলে কী হবে, সরোজিনী, সুভাষচন্দ্র, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ-সহ অনেকেরই সিনেমা নিয়ে যথেষ্ট উৎসাহ ছিল। অচ্ছুত (১৯৪০) ছবির প্রিমিয়ারে উপস্থিত ছিলেন বল্লভভাই পটেলও।

বিদেশি ছবিও মাঝে মাঝেই জাতীয়তার আবেগ ঘনীভূত করতে সাহায্য করছিল অজানিতেই। সিনেমার প্রভাব জনমানসে কতটা গভীর ভাবে পড়তে পারে সেটা আন্দাজ করেই বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এ দেশে চলচ্চিত্রের প্রসার জাঁকিয়ে বসার দিনগুলি থেকেই সেন্সরের প্রশ্নটি ব্রিটিশ শাসকদের মাথায় ঘুরছিল। শুধু দেশীয় ছবির বিষয়বস্তুর উপরে নজরদারিই নয়, বিদেশি ছবির আমদানির দিকটিও তাঁদের ভাবিয়ে তুলছিল। কোন কাহিনি এখানকার রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে কোন ঢেউ তুলতে পারে, সেটা মাথায় রাখার দরকার হচ্ছিল। কিন্তু ব্রিটিশরা কোন ছবি আটকাতে হবে, সেটা নিয়েই বেশি চিন্তিত ছিলেন। যে ছবি ছাড় পেল, তা নিয়ে দেশীয় সমাজে কী প্রতিক্রিয়া হবে, তার সবটা আঁচ করতে পারেননি। সুতরাং, ভারত এবং ভারতীয়দের হীন ভাবে উপস্থাপনের অভিযোগ বিদেশি ছবির ক্ষেত্রে মাঝে মাঝেই উঠতে লাগল, সেই সঙ্গে ভারতকে নিজেদের মতো করে তুলে ধরার তাগিদও বেগবতী হল।

জাতীয়তাবাদী নেতা বিপিনচন্দ্র পালের পুত্র নিরঞ্জন পাল যেমন বিলেতে চিত্রনাট্য লেখা মকশো করছিলেন, কারণ তাঁর মনে হচ্ছিল ভারতের গৌরবেতিহাস পর্দায় ঠিক ভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে না। কয়েক বছরের মধ্যে হিমাংশু রায়ের সঙ্গে জুটি বেঁধে লাইট অব এশিয়া-র (১৯২৫) নির্মাণ এই প্রণোদনা থেকেই। তিরিশের দশক থেকে আফ্রিকায় ছবির শুটিং হওয়ামাত্র আফ্রিকাকেন্দ্রিক ছবির জোয়ার এল হলিউডে। তার পাশাপাশি ভারতের বণিকদের সঙ্গে আফ্রিকার সুপ্রাচীন সম্পর্কের কথা মনে না করালে ইতিহাসের অপলাপ হবে, এই ভাবনা থেকেই হীরেন বসুকে দিয়ে ১৯৩৯ সালে ইন্ডিয়া ইন আফ্রিকা ছবি করাতে এগিয়ে এলেন কংগ্রেস নেতা শেঠ গোবিন্দদাস। প্রায় একই সময়ে বিরাট বিতর্ক বেধে গিয়েছে হলিউডের গঙ্গাদীন (১৯৩৯) চলচ্চিত্রকে ঘিরে (এরই একটি দৃশ্য উপরের ছবি)। সে ছবিতে ভারতের অপমানের প্রতিবাদে একযোগে সরব হয়েছেন জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব এবং দেশীয় সংবাদমাধ্যম। বাংলা এবং মহারাষ্ট্রে ছবিটি নিষিদ্ধ হয়ে গেল। ১৯৩৯ সালের মার্চ মাসে দেশ পত্রিকায় লেখা হল, “ভারতকে হীন জঘন্য, ভারতবাসীকে বর্ব্বর অসভ্য প্রতিপন্ন করিয়া এবং বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের ভারতে এই সমস্ত বর্ব্বরদিগকে পরিচালিত করার যুক্তি সমর্থন করিয়া যে সমস্ত ছবি ইতিপূর্ব্বে তোলা হইয়াছিল, গঙ্গাদীন তাহা হইতেও নিকৃষ্ট।” ওই নিবন্ধেই দাবি তোলা হল, শুধু বাংলা বা মহারাষ্ট্রে ছবিটি আটকানোই যথেষ্ট নয়, প্রযোজক আরকেও রেডিয়ো পিকচার্স-কে বলা হোক, এই ছবি যদি তারা প্রত্যাহার না করে, তা হলে ভারতে তাদের কোনও ছবি চলতে দেওয়া হবে না!

বাবুরাও পটেলের ফিল্ম ইন্ডিয়া আর কলকাতার দেশ পত্রিকার আওয়াজ সে দিন অভিন্ন ছিল। এই অভিন্নতা স্বতোৎসারিত হয়েছিল দেশপ্রেম আর জাতীয়তার চেতনা থেকে। আজ যখন দেশভক্তি বলতে কাশ্মীর ফাইলস কিংবা উরি বোঝানোর চেষ্টা চলছে, যখন ইতিহাসের ফর্দাফাঁই করে নিত্যনতুন কাহিনি বুননের উদ্যোগ হচ্ছে, তখন অতীতের পাতায় চোখ রাখা ভাল। ‘হর ঘর তিরঙ্গা’র ফরমান ছাড়াও ত্রিবর্ণ ওড়ে, যদি আবেগ স্বতঃস্ফূর্ত হয়। যেমনটি উড়েছিল ৭৫ বছর আগে।

অন্য বিষয়গুলি:

cinema India Independence Movement
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE