বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য— বিশেষত বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ— পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগ প্রশংসনীয়, ধরে নিয়েও একটা বড় প্রশ্ন থাকে আমাদের সামনে। সেটা হল, পশ্চিমবঙ্গ এখনও কেন এতটা পিছিয়ে?
প্রথমে বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের (একুইটি ইনফ্লো) পরিসংখ্যান দেখে নেওয়া যাক। ২০২৩-২৪ আর্থিক বছরে মহারাষ্ট্র পেয়েছে ১,২৫,১০১ কোটি টাকা, কর্নাটক ৫৪,৪২৭ কোটি টাকা, গুজরাত ৬০,৬০০ কোটি টাকা এবং পশ্চিমবঙ্গ ১৫০১ কোটি টাকা (সূত্র: শিল্প ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের উন্নয়ন বিভাগ, ভারত সরকার)। প্রথম দশটি রাজ্যের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ ছিল সবার শেষে।
বিনিয়োগ, বিশেষত বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ, অনেকগুলো বিষয়ের উপর নির্ভর করে। এই বিষয়ে বিপুল সংখ্যক গবেষণাপত্র বিদ্যমান। কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় হল রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও স্থিতিশীলতা, আইনের শাসন, কর কাঠামো, পরিকাঠামোগত উন্নয়ন, দক্ষ জনশক্তি, বাণিজ্য নীতি ও উন্মুক্ততা ইত্যাদি। সম্প্রতি উপযুক্ত জমির ব্যবস্থা করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্থান সীমাবদ্ধতার কারণে এই সমস্ত কারণ নিয়ে একটি সন্তোষজনক ও পরিপূর্ণ আলোচনা সম্ভব নয়। তবে আমরা দু’টি গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক নিয়ে আলোচনা করব, সুশাসন এবং রাজনৈতিক ফেডারালিজ়মের প্রেক্ষাপটে কেন্দ্র-রাষ্ট্র সম্পর্ক। প্রথমটি মূলত রাজ্যের বিষয়, কিন্তু দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
এই সুশাসন শব্দটি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে। আইনের শাসন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, স্বচ্ছতা, বাক্স্বাধীনতা, ভাল আর্থিক ব্যবস্থাপনা, ডিজিটাল উদ্যোগ, সবই ‘সুশাসন’-এর আওতায় রয়েছে। এ ছাড়া আরও অনেক বিষয় সুশাসনের সাধারণ সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। পশ্চিমবঙ্গে কিছু ক্ষেত্রে উন্নতির বিশাল সুযোগ রয়েছে। আইনের শাসন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং ভাল আর্থিক ব্যবস্থাপনা, এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক বলে বিশ্বাস করা হয়। আমরা এখন দু’টি বিষয় নিয়ে আলোচনা করব, আইনের শাসন ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা।
২০২২ সালে পশ্চিমবঙ্গে হিংস্র অপরাধের হার (প্রতি লক্ষ জনসংখ্যা) ছিল ৪৬.৮, জাতীয় গড় ৩১.৩-এর চেয়ে অনেক বেশি (ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো)। দিল্লি ও অসমের পরে পশ্চিমবঙ্গ তৃতীয় সর্বোচ্চ। অতএব, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সীমাবদ্ধতা, যেখানে পশ্চিমবঙ্গের উল্লেখযোগ্য উন্নতি প্রয়োজন। আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে রাষ্ট্রপুঞ্জের সংজ্ঞা অনুসারে, আইনের শাসন হল শাসনের একটি নীতি যেখানে সরকার-সহ সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান— সরকারি এবং বেসরকারি— এমন আইনের প্রতি দায়বদ্ধ যা সর্বজনীন ভাবে প্রবর্তিত, সমান ভাবে প্রয়োগ করা এবং স্বাধীন ভাবে বিচার করা হয় এবং যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের নিয়ম ও মানগুলির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই বিষয়টি নিশ্চিত করা রাজ্য সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি দায়িত্ব।
পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা করা যাক। যদিও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের আর্থিক পরিস্থিতি বছরের পর বছর ধরে উন্নত হয়েছে, তবুও এটি অত্যন্ত ঋণী রাজ্যগুলির মধ্যে একটি হিসেবেই রয়ে গেছে। ২০২৩-২৪ সালে রাজ্যের রেভিনিউ ডেফিসিট (বা রাজস্ব ঘাটতি) এবং ফিসকাল ডেফিসিট ছিল যথাক্রমে জিএসডিপি-র ১.৭% এবং ৩.৫%। রাজস্ব খাতে সঞ্চয় না থাকার জন্য রাজ্য সরকারকে ধার করতে হয় সেই সব খরচের জন্য যেগুলি উন্নয়নমূলক নয়, যেমন ঋণ পরিষেবা, অপ্রয়োজনীয় ভর্তুকি। রাজ্যের বকেয়া ঋণ ছিল জিএসডিপি-র ৩৮%-এর বেশি, এটাও সব রাজ্যের গড় থেকে উপরে। উচ্চ ঋণ-পরিষেবা ব্যয় রাজ্যকে একটি ‘ঋণ-আর্থিক ঘাটতি’ চক্রের মধ্যে রেখে দেয়। রাজস্ব ঘাটতি আর ‘ফিসকাল ডেফিসিট’ টার্গেট এই দুইয়ের যুগলবন্দি নিঃসন্দেহে রাজ্যের উন্নয়নের জন্য ব্যয় করার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। সুতরাং, আর্থিক ব্যবস্থাপনায় উন্নতির অনেক অবকাশ আছে। রাজস্ব ঘাটতি দূর করা জরুরি, যাতে শুধু সরকারি বিনিয়োগের জন্য ঋণ নিতে হয়।
এখন দেখা যাক, কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা কী? কেন্দ্রীয় সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার মধ্যে আমরা একটি বিশেষ দিক বিশ্লেষণ করব। রাজনৈতিক ফেডারালিজ়ম হল একটি শাসনকাঠামো, যা কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকারের মধ্যে ক্ষমতা ভাগ করে দেয়। ফিসকাল ফেডারালিজ়ম এই কাঠামোরই অন্তর্ভুক্ত। স্বাভাবিক ভাবেই এই শাসনব্যবস্থা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং অন্য বিষয়গুলির মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে, যাতে সামগ্রিক ভাবে দেশের উন্নতি সম্ভব হয়।
এই শাসনব্যবস্থার কার্যকারিতা বিভিন্ন চ্যানেলের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। ভারতে এই রাজনৈতিক ফেডারালিজ়মের কার্যকারিতা সঙ্গত কারণে কিছু সামঞ্জস্যহীন (অ্যাসিমেট্রিক) ব্যবস্থার উপর নির্ভর করে, কারণ সমস্ত ইউনিট সমান অর্থনৈতিক শক্তির নয়— এবং এই বিশেষ ব্যবস্থাগুলি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যেমন উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিকে কিছু বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়। কিন্তু রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং আঞ্চলিক দলগুলোর উত্থানের ফলে সময়ের সঙ্গে কিছু সামঞ্জস্যহীন ব্যবস্থার আবির্ভাব ঘটেছে। এবং আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এই যে, এই ব্যবস্থাগুলি অ-স্বচ্ছ ও অস্থায়ী প্রকৃতির। একটু বিশদে বলা যাক।
বিনিয়োগ ও বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের জন্য রাজ্য নির্ধারণে যদিও কেন্দ্রীয় সরকারের সরাসরি ভূমিকা নেই, কিন্তু একটি যুক্তরাষ্ট্রের কাঠামোয় কেন্দ্র-রাষ্ট্র সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। বিনিয়োগের সঙ্গে যুক্ত রাজনৈতিক ঝুঁকির জন্য এটি একটি প্রধান সূচক। এই সব বিনিয়োগে প্রচুর ‘সাঙ্ক কস্ট’ আছে যেগুলি ফেরত পাওয়া অসম্ভব। বহু উদাহরণ এই বিষয়ে দেওয়া যেতে পারে।
এক জন উদ্যোক্তা সর্বদাই লাভের উদ্দেশ্য দ্বারা চালিত হন। তা-ই যদি ধরে নিই, অন্যান্য সমস্ত বিবেচনা একই, তবে তিনি সেই স্থান (একটি নির্দিষ্ট রাজ্য সরকার) পছন্দ করবেন, যেখানে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে রাজ্যের রাজনৈতিক সম্পর্ক মসৃণ। ঠিক এই কারণেই সরকারি কাঠামোতে সামঞ্জস্যহীন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যবস্থার সৃষ্টি, যেটা স্বচ্ছ নয়। অনেক ক্ষেত্রেই রাজ্যগুলির রাজনৈতিক ঝুঁকির উপলব্ধি ভিত্তিহীন এবং পক্ষপাতদুষ্ট, আর এর জন্যই কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাসঙ্গিক সংস্থাগুলিকে কাল্পনিক রাজনৈতিক ঝুঁকির ভীতি যথাযথ ভাবে নির্মূল করতে হবে। তবেই ভারতে এফডিআই-এর সুষম বণ্টন সম্ভব।
ভারতের সামগ্রিক অগ্রগতি এবং উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিছু গবেষণাপত্র রয়েছে যা দেখায় যে, কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলশাসিত রাজ্যগুলি তুলনামূলকভাবে বেশি মাথাপিছু এফডিআই আকর্ষণ করে বিরোধী দলশাসিত রাজ্যগুলির তুলনায়, যখন আমরা বাকি গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারকদের (মাথাপিছু আয়, জনসংখ্যার ঘনত্ব, নগরায়ণ, অবকাঠামো, নীতি শাসন এবং মানব উন্নয়ন) প্রভাবকে বিবেচনা থেকে সরিয়ে রাখি।
একক দলের সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের সুষম বণ্টন চ্যালেঞ্জিং হতে পারে, তবে অসম্ভব নয়— যদি আমাদের সমবায় ফেডারালিজ়ম-এর জন্য আন্তরিক দায়বদ্ধতা থাকে। আমরা কি কিছু ‘নিয়মভিত্তিক’ বিদেশি বিনিয়োগ বণ্টন পদ্ধতির কথা ভাবতে পারি? এই ব্যাপারে জিএসটি কাউন্সিল একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ নির্দেশক হতে পারে।
রাজ্যগুলিতে উন্নয়ন এবং বৃদ্ধির উল্লেখযোগ্য ভিন্নতার পরিপ্রেক্ষিতে এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। ‘ক্যাচিং-আপ’ তত্ত্ব এখনও অনেক দূরে। ‘সব কা সাথ সব কা বিকাশ’ প্রধানমন্ত্রীর একটি উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ ছিল বলে জানা গিয়েছিল। এটি তখনই সম্ভব, যদি সকলে এই উদ্যোগেসততার সঙ্গে সমর্থন করে— অবশ্যই দল ও মতের ঊর্ধ্বে উঠে।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)