বিরুদ্ধতা: গুজরাত-ঘটনার পর কংগ্রেসের মিছিল। কলকাতা, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০০২
আজ নতুন নয়। যুগ যুগ ধরে, হয়তো সেই আদম-ইভের সময় থেকেই নিষিদ্ধ ফলে আমাদের আকর্ষণ বেশি— চিরকাল।
সম্ভবত সেই কারণেই বার বার দেখা গিয়েছে, কোনও বই নিষিদ্ধ করা হলে, তা পড়ার জন্য বহু জনের উৎসাহ বাড়ে। তাগিদ বাড়ে যেখান থেকে হোক, তা খুঁজে বার করার। কোনও চলচ্চিত্রের উপরে নিষিদ্ধ (ব্যান) তকমা সেঁটে দিলে, তৈরি হয় তা দেখার বাড়তি তাগিদ। স্বাভাবিক আকর্ষণেই। আর সত্যি বলতে, আজকের এই ইন্টারনেটের জাল-বিস্তৃত যুগে কোনও কিছুকে স্রেফ নিষিদ্ধ বলে দাগিয়ে দিয়ে চোখের আড়াল করাও শক্ত।
এই যখন পরিস্থিতি, তখনই সম্প্রতি ভারত সরকারের ঘোষণা, গুজরাত দাঙ্গার বিষয়ে তৈরি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি-র তথ্যচিত্র এই দেশে একদম দর্শকদের পাতে পড়া চলবে না! তার পুরোটা কিংবা অংশবিশেষ তুলে দেওয়াও যাবে না ইউটিউব কিংবা টুইটারের মতো সমাজমাধ্যমের দেওয়ালে।
অথচ, ইন্ডিয়া: দ্য মোদী কোয়েশ্চেন নামে এই তথ্যচিত্রের প্রথম পর্ব ১৭ জানুয়ারি বিবিসি ইতিমধ্যেই দেখিয়েছে। আর দ্বিতীয় পর্ব দেখানোর কথা আজ, ২৪ জানুয়ারি।
তা, কী এমন নতুন কথা আছে এই তথ্যচিত্রে?
এত দিনে সকলেই জানেন, ২০০২ সালে গুজরাতে ভয়াবহ দাঙ্গায় যখন হাজারের উপরে মানুষ মারা গিয়েছিলেন (যাঁদের অধিকাংশ সংখ্যালঘু মুসলিম), তখন নরেন্দ্র মোদী ওই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। কংগ্রেস-সহ বিরোধীদের বরাবরের অভিযোগ, গুজরাত সরকারের নিষ্ক্রিয়তা (এমনকি অনেকের মতে ইন্ধন) ছাড়া ওই হত্যালীলা সম্ভব ছিল না। সরকার ঠিক সময়ে ঠিক পদক্ষেপ করলে, বাড়িছাড়া হতে হত না বহু মানুষকে। তাইনরেন্দ্র মোদী এর দায় এড়াতে পারেন না। এ নিয়ে আইনি লড়াই আদালতের দরজায় গড়িয়েছে। শেষ পর্যন্ত এ বিষয়ে নরেন্দ্র মোদীকে ‘ক্লিন চিট’ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট।
বিবিসি-র এই তথ্যচিত্র নতুন করে আলো ফেলেছে সেই দাঙ্গায়। তাতে পুরনো সমস্ত কথা ফের এক বার নতুন করে উঠে এসেছে। তাজা হয়েছে পুরনো অভিযোগ। কিন্তু এই সমস্ত কিছুর মধ্যে নতুনত্ব নেই। নতুন কথাটি হল: ওই সময়ে ব্রিটিশ সরকারের বিদেশ মন্ত্রক এই বিষয়ে নিজেদের যে গোপন রিপোর্ট তৈরি করেছিল, এত দিনে তা নাকি হাতে পেয়েছে পশ্চিমি দুনিয়ার নামী সংবাদমাধ্যমটি। আর তাতে স্পষ্ট লেখা রয়েছে যে, এই দাঙ্গার জন্য (গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী) নরেন্দ্র মোদী নিজে ব্যক্তিগত ভাবে দায়ী। ব্রিটেনের তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী জ্যাক স্ট্র দাবি করেছেন, এই পর্যবেক্ষণ ১০০ শতাংশ খাঁটি।
স্বাভাবিক ভাবেই হইচই শুরু হয়েছে এ নিয়ে। যাঁরা মোদী সরকারের বিরোধী, তাঁরা ওই তথ্যচিত্রের প্রথম পর্বের লিঙ্ক শেয়ার করেছেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নিয়ন্ত্রণের খাঁড়া নামিয়ে ভারত সরকার জানিয়ে দিয়েছে, টুইটার, ইউটিউবের মতো মাধ্যমে এই তথ্যচিত্র দেখতে পারবেন না এ দেশের মানুষ।
কিসের বলে এমন নিদান? এ দেশে তথ্যপ্রযুক্তির আইনে কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। তা তুলে ধরে বলা হচ্ছে, এই তথ্যচিত্র ভারতের ঐক্য, সার্বভৌমত্ব এবং অন্যান্য দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে খারাপ প্রভাব ফেলবে।
আশ্চর্যের বিষয় হল, এই সমস্ত কিছুই বলা হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের সেই সব নিয়মের উপরে ভিত্তি করে, যাতে জরুরি অবস্থার সময়ে নেওয়ার মতো কিছু ক্ষমতা (ইমার্জেন্সি পাওয়ার) আছে। আমার প্রশ্ন হল, ১৯৭০-এর দশকের ইন্দিরা গান্ধীর জমানার মতো জরুরি ব্যবস্থা কি তবে ফিরে এসেছে?
বিভিন্ন সাংবাদিক, সামাজিক কার্যকর্তা, উকিল, ডেরেক ও’ব্রায়েনের মতো বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা, এমনকি আমেরিকান অভিনেতা জন কুশ্যাক— সরকারের ফতোয়া, এঁদের সকলের টুইট পর্যন্ত ব্লক বা বন্ধ করে দিতে হবে! যাঁরা ওই তথ্যচিত্র তুলে ধরে মোদী বিরোধিতায় সরব।
বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচীর দাবি, “এটা প্রোপাগান্ডা বা অভিসন্ধিমূলক প্রচার। এর মধ্যে বস্তুনিষ্ঠতা নেই। একতরফা।” তাঁর অভিযোগ, দীর্ঘ দিন ইংরেজ শাসনে থাকার মানসিকতা (কলোনিয়াল মাইন্ডসেট) যে এখনও কাটেনি, এ তার হাতেগরম প্রমাণ। বিজেপির প্রশ্ন, তবে কি এ দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় মূল্যহীন? এত পুরনো ঘটনা নতুন করে ‘খুঁচিয়ে তোলার’ পিছনে কোনও অভিসন্ধি নেই তো?
বিরোধীরা অবশ্য এর জবাব ফিরিয়ে দিচ্ছেন কটাক্ষে। তাঁদের পাল্টা প্রশ্ন, ক্লিন চিট পাওয়া মোদীর ‘কীর্তি লুকোতে’ কেন এত আগ্রাসী হতে হচ্ছে সরকারকে? তাঁরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, বিবিসি-র এক মহিলা সাংবাদিককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মোদীই বলেছিলেন, “মানবাধিকার কী, তা ব্রিটিশদের কাছ থেকে শিখতে চাই না।” আবার মনমোহন সিংহের আমলে ২০১৩ সালের ৮ এপ্রিল টুইটে মোদীর বক্তব্য ছিল, আমাদের দেশের লোকেরা দূরদর্শন, আকাশবাণীতে দেখা বা শোনা খবর বিশ্বাস করেন না। ওঁরা বিবিসি-তে তা শুনতে চান। বিশ্বাস করেন। বিরোধীদের টিপ্পনী, এ বার কি সেই বিশ্বাসভঙ্গ হল?
প্রযুক্তি-বিশারদরা বলছেন, আজকের তথ্যপ্রযুক্তির যুগে কোনও তথ্যচিত্র, কোনও বইকে এই ভাবে নিষিদ্ধের তালিকায় ফেলে আটকানো সম্ভব নয়। যাঁরা দেখার, তাঁরা দেখবেনই। সরকার এই তথ্যচিত্রকে একতরফা বলে দাবি করছে। অথচ এক সাক্ষাৎকারে মোদীর পক্ষে সাফাই দিয়েছেন স্বপন দাশগুপ্ত। তার পরেও এমন!
গোপন রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০০৩ সালে মোদী যখন ব্রিটেনে গিয়েছিলেন, তখন নাকি তাঁকে গ্রেফতারের প্রস্তাব উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত তা আর হয়নি। এখনও বহু জনের মনে এত ভয় জমাট বেঁধে আছে যে, এই তথ্যচিত্রের জন্য সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হননি ৩০ জনেরও বেশি মানুষ। তাঁরা সুরক্ষার ভয়ে কাঁটা। যদি গুজরাত নিয়ে মুখ খুললে, সরকার কিছু করে!
বিরোধী শিবিরের বক্তব্য, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের কাছে মোদী ক্লিন চিট পেতে পারেন। কিন্তু ২০০২ সালের ঘটনা ভারত এবং বিশ্বের মানুষ তাঁকে ভুলতে দেবেন না। অন্তত এমন নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে ওই স্মৃতি উধাও করে দেওয়ার চেষ্টা নিছকই বোকামি। ভাবতে অবাকই লাগছে, একটা এত বড় দেশের সরকার এমন হদ্দ বোকা হল কী করে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy