আজ কারও জানতে বাকি নেই, ভারত সরকার দেশের সব পূর্ণবয়স্ক নাগরিককে কোভিডের টিকা দেওয়ার দায়িত্ব নিতে নারাজ। যাঁদের বয়স পঁয়তাল্লিশের নীচে, তাঁদের পুরো দায়িত্ব রাজ্য সরকারগুলির— তাদের ব্যবস্থায়, তাদের খরচে, কেন্দ্রের চেয়ে দ্বিগুণ বা আরও বেশি দামে ওষুধ কিনে। পশ্চিমবঙ্গ-সহ রাজ্য সরকারগুলি স্বভাবতই দাবি করে চলেছে, সারা দেশের টিকাকরণের ভার কেন্দ্রকেই নিতে হবে— শুধু নীতিগত কারণে নয়, আর্থিক নিরিখেও সবচেয়ে প্রশস্ত উপায় বলে।
‘ইন্ডিয়া রেটিংস অ্যান্ড রিসার্চ’ সংস্থার সমীক্ষা অনুসারে, টিকা পাওয়ার কথা মোট ৮৪.১৯ কোটি নাগরিকের। ধরা যাক (এই অনুমান সমীক্ষায় নেই) কেন্দ্রের পূর্বেকার নির্ধারিত দরে ডোজ়প্রতি দাম ১৫০ টাকা। সে ক্ষেত্রে প্রত্যেক নাগরিককে দু’ডোজ় টিকা দিতে লাগবে ২৫,২৫০ কোটির সামান্য বেশি। ডোজ়প্রতি ২০০ টাকা ধরলেও মোট খরচ ৩৩,৭০০ কোটির কম। এ বছরের কেন্দ্রীয় বাজেটে কোভিডের টিকাবাবদ বিশেষ বরাদ্দ ৩৫,০০০ কোটি। বলা হয়েছিল, দরকার পড়লে অঙ্কটা বাড়ানো হবে। এবং, টাকাটা রাজ্যগুলিকে হস্তান্তর করা হবে।
তা হলে সমস্যা কোথায়? উপরেই বলেছি, সমীক্ষার হিসাব অন্য রকম, কেন্দ্রের নতুন বিধানে। সেই অনুসারে রাজ্যগুলিকে বেশি দামে খোলা বাজার থেকে টিকা কিনতে হবে। সেই দাম ডোজ়প্রতি ৪০০ টাকা ধরে কেন্দ্র-রাজ্য মিলিয়ে মোট খরচ দাঁড়াচ্ছে ৬৭,১৯৩ কোটি অর্থাৎ প্রায় দ্বিগুণ; তার মধ্যে কেন্দ্রের ভাগ মাত্র ২০,৮৭০ কোটি, অর্থাৎ তিন ভাগের এক ভাগও নয়। অন্য ভাবে বললে, করদাতার বিপুল অর্থ অতিরিক্ত ব্যয় হবে। লাভবান হবে কতিপয় টিকা প্রস্তুতকারী সংস্থা— যদিও দেশের বৃহত্তম উৎপাদক কবুল করেছেন, ডোজ়প্রতি ১৫০ টাকা দামেও তাঁদের খানিক লাভ থাকছে।
পয়লা মে থেকে পঁয়তাল্লিশের কম বয়সিদের টিকা দেওয়ার দ্বার কেন্দ্র উন্মুক্ত করে দিল। সে খুব ভাল কথা, কিন্তু তার আর্থিক দায় কেন্দ্রীয় সরকার নিল না। এ দিকে দেশে টিকা উৎপাদন রাতারাতি এক ডোজ়ও বাড়েনি। সুতরাং পঁয়তাল্লিশোর্ধ্ব ও জরুরি কর্মীদের জন্য বরাদ্দ হয়ে গেল অর্ধেক: তাঁদের টিকাকরণ এত দিন মোটের উপর সুষ্ঠু ভাবে চলছিল, সেটা হয়ে পড়ল বিক্ষিপ্ত ও অনিশ্চিত। যাঁরা ইতিমধ্যে এক ডোজ় নিয়েছেন, দ্বিতীয় ডোজ় নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়লেন। বাকি ওষুধের অর্ধেক, অর্থাৎ মোট উৎপাদনের সিকি ভাগ পঁয়তাল্লিশের কম বয়সিদের জন্য রাজ্যগুলিতে বরাদ্দ হল, আগের তুলনায় দ্বিগুণ বা তারও বেশি দামে। আর সিকি ভাগ পেল বেসরকারি সংস্থা, যথেচ্ছ মূল্যে বিতরণের জন্য— অবশ্যই পরিষেবা বাবদ একটা দক্ষিণা জুড়ে। কেন্দ্রীয় সরকার ধরেই নিচ্ছে যে, ওই বয়ঃক্রমের অর্ধেক মানুষের ডোজ়প্রতি কমপক্ষে হাজার টাকা খরচের সামর্থ্য আছে।
অবশ্যম্ভাবী ফল, কারও ভাগেই যথেষ্ট ওষুধ জুটল না, জুটতে পারে না। দেশের দু’টি সংস্থার বর্তমান উৎপাদন ক্ষমতা ৮ থেকে ১০ কোটি ডোজ়। ক্ষমতা বাড়াবার উদ্যোগ চলছে, আমদানির কথা হচ্ছে, রাশিয়া থেকে একপ্রস্ত প্রাপ্তি ছাড়া এ পর্যন্ত কিছুই জোটেনি। স্কুলপাঠ্য পাটিগণিত থেকেই স্পষ্ট, জোগানের বর্তমান হারে সকলকে দু’ডোজ় টিকা দিতে অন্তত দেড় বছর লাগবে। তত দিনে আরও কিছু লোকের বয়স আঠারো ছাড়িয়ে যাবে। যাঁরা আগে টিকা নিয়েছেন, তাঁদেরও উত্তরোত্তর বুস্টার ডোজ় নেওয়ার দরকার পড়বে।
যে সচ্ছল ব্যক্তিদের বাড়তি দাম দেওয়ার ক্ষমতা আছে, তাঁরাও টিকা নিতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন, কারণ বেসরকারি কেন্দ্রগুলিতে ওষুধের আকাল। আর সাধারণ মানুষের জন্য ওই দাম ধার্য করা যে অন্যায় ও অসম্ভব, তা বুঝতে পেরে প্রায় সব রাজ্য সরকারই বলতে বাধ্য হয়েছে, তারা শূন্য কোষাগার আরও বিপন্ন করে রাজ্যবাসীকে বিনামূল্যে টিকা দেবে। কিন্তু তার রসদই বা আসবে কোথা থেকে? উপরোক্ত মাত্রায় উৎপাদন হলে মাত্র দু’তিনটে বড় রাজ্যের মাসিক চাহিদাও মিটবে কি না সন্দেহ। অধিকাংশ রাজ্য তাই পয়লা মে কমবয়সিদের টিকাকরণ শুরু করতে পারেনি; দু’-চারটি রাজ্য করেছে ‘প্রতীকী’ ঢঙে।
মঙ্গলগ্রহের কোনও আগন্তুক দেখে ভাববে, ভারতের শাসকেরা তারই মতো ভিন্গ্রহের বাসিন্দা। এমন মনে করলে শাসক দলের প্রতি ঘোর অবিচার হবে। তাঁরা অত্যন্ত বিচক্ষণ, ভারতের বাস্তবকে খুঁটিয়ে চেনেন, নিজেরাই সৃষ্টি করেছেন কিছু অংশে। বাস্তববুদ্ধি থেকেই তাঁরা টিকাকরণের এমন অযৌক্তিক অসমঞ্জস নীতির উদ্ভাবন করেছেন। এতে তাঁদের অনেক সুবিধা।
প্রথমত, অতিমারির প্রকোপের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সর্বজনীন টিকার দাবি দুর্বার হয়ে উঠেছে। পয়লা মে থেকে সকলকে টিকা দেওয়া হবে, ঘোষণা করে জনতার মুখ বন্ধ করা গেল। এ দিকে টিকার জোগান অপ্রতুল, প্রয়োজনের ধারেকাছে নয়। অক্সিজেনের নাটকীয় প্রাণঘাতী অভাবের ফলে টিকা নিয়েও লোকের উদ্বেগ বেড়ে চলেছে। কবে দেশে উৎপাদন বাড়বে, আমদানিই বা কবে হবে কত হবে, কোনও কিছুর স্থিরতা নেই। টিকার অভাবে জনগণের ক্ষোভ ও হতাশা মোকাবিলার দায়ও এই পন্থায় নিপুণ ভাবে রাজ্যের কাঁধে চালান করা গেল। সেই রাজ্যে যদি কোনও বিরোধী দল ক্ষমতায় থাকে, সৃষ্টি হল তাদের পর্যুদস্ত করার মোক্ষম হাতিয়ার। নিজের ব্যর্থতা থেকে রাজনৈতিক লাভ তুলতে প্রতিভা লাগে। ভারতের বর্তমান শাসকেরা অন্তত সেই প্রতিভার উজ্জ্বল স্বাক্ষর পেশ করলেন।
প্রশাসন ও রাজনীতি ছাপিয়ে যে ক্ষতিটা সবচেয়ে মর্মান্তিক, তা কিন্তু সাধারণ নাগরিকের মনুষ্যত্বহানি। মানুষের স্বভাবই এই, রাগ উগরে দিতে আমরা যাকে সামনে পাই তার দিকে তেড়ে যাই; আসল দোষ কার, অত খতিয়ে দেখি না। বিশেষত ভারতের নাগরিক স্বভাবত বিভ্রান্ত ও অসহায়, উপরমহলে তার কণ্ঠ পৌঁছবে না ভালই জানে, তেমন কল্পনাই করতে পারে না; তার রাগের দৌড় তাই চেনা চৌহদ্দি অতিক্রম করে না। রাতভর লাইন দিয়ে টিকা না পেলে সেই রাগ আছড়ে পড়ে হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কর্তা-কর্মীদের উপর, শুরু হয় বচসা গালিগালাজ, হয়তো ভাঙচুর— যদিও, টিকার জোগান না থাকলে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কিছু করার নেই। নেই রাজ্য সরকারেরও: টিকাস্থল রাজ্যের হাতে থাকলেও টিকার জোগান দিচ্ছে কেন্দ্র, অথবা বণ্টনব্যবস্থা এমন যে, চাইলেও রাজ্য টিকার সংস্থান করতে পারবে না। অভাবের সুযোগ নিয়ে কোথাও হয়তো সত্যিই অনাচার ঘটছে, এক জায়গায় ঘটলে দশ জায়গায় রটনা হচ্ছে, লাইন ভাঙা নিয়ে নিজেদের মধ্যেই বচসা মারপিট বাঁধছে— এক কথায়, জনসাধারণের চূড়ান্ত হেনস্থা ও সম্মানহানি হচ্ছে।
সাধারণ নাগরিকের এই অবমাননা ভারতের দূরস্থ অনাত্মীয় শাসনব্যবস্থার চিরাচরিত অনুষঙ্গ; আজ দুর্দিনে ভারতের শাসকেরা তার মাত্রা আরও অসহনীয় করে তুললেন। এ তো গেল সুস্থ লোকের টিকা নেওয়ার দুর্ভোগ। অসুস্থ মানুষের হাসপাতালে ভর্তি থেকে ওষুধ অক্সিজেন মায় দেহ সৎকারের ব্যবস্থা করতে অসহায় নাগরিকের এমন চরম অবমাননা দেশভাগের পর ঘটেছে কি? দেখেছি কি, আপনজনকে বাঁচাতে একটু অক্সিজেনের জন্য কেউ পুলিশের পা জড়িয়ে ধরছে, নিরুপায় পুলিশটিও বিহ্বল? ভাবতে পেরেছি, গঙ্গাবক্ষে ভেসে যাবে শবের সারি? আত্মসমীক্ষা করলে অবশ্য শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত শ্রেণির স্বীকার করতে হয়, গত বছর ঘরমুখী অভিবাসী শ্রমিকদের দুর্দশা ছিল তুলনীয়। তার আঁচ আমাদের গায়ে লাগেনি, আজ বোধোদয় হচ্ছে। ‘অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।’
বিশ্বে আর একটিও নজির নেই, যেখানে দেশের সরকার কোভিডকালে তাদের দায়িত্ব এ ভাবে ঝেড়ে ফেলেছে অঙ্গরাজ্যগুলির উপর, উপরন্তু তাদের নিক্ষেপ করেছে বৃহৎ পুঁজির বাজারি শক্তির জঠরে। হতে পারে, অদূর ভবিষ্যতে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ভারত সরকার বাধ্য হবে সম্পূর্ণ টিকাদানের ভার নিতে, উপরন্তু আইনি ক্ষমতাবলে আরও কিছু সংস্থায় টিকা উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে। তেতো গেলার মতো করে সরকার এই দায়িত্ব নিলে অসংখ্য লোকের জান বাঁচবে, সেটা নিশ্চয়ই সবচেয়ে বড় কথা; কিন্তু দেশের শাসকগোষ্ঠীর প্রতি আমাদের অপরত্ববোধ ঘুচবে না। রাষ্ট্রের জীবনে এর চেয়ে বড় বিপর্যয় কিছু হতে পারে না।
ইমেরিটাস অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ,
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy