পরীক্ষা: শহরের মহিলাদের মধ্যে মহামারি প্লেগ-এর মোকাবিলা কেমন, দেখছেন ডাক্তারি দল, বোম্বাই (এখন মুম্বই), ১৮৯৬। উইকিমিডিয়া কমনস।
সওয়াশো বছর আগে এপ্রিল-মে মাসের কলকাতা এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের সাক্ষী ছিল। লক্ষ লক্ষ লোক শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছেন নিরাপদ কোনও আশ্রয়ের সন্ধানে। অসূর্যম্পশ্যা অন্তঃপুরবাসিনীদের পর্যন্ত দেখা গিয়েছিল পায়ে হেঁটে বহু রাস্তা পাড়ি দিতে! এর কারণ বিধৃত আছে চতুরঙ্গ উপন্যাসে: “যে বছর কলিকাতা শহরে প্রথম প্লেগ দেখা দিল তখন প্লেগের চেয়ে তার রাজতকমা-পরা চাপরাসির ভয়ে লোকে ব্যস্ত হইয়াছিল।” রবীন্দ্রনাথ আরও লিখেছেন: “পাড়ায় প্লেগ দেখা দিল। পাছে হাসপাতালে ধরিয়া লইয়া যায় এজন্য লোকে ডাক্তার ডাকিতে চাহিল না। জগমোহন স্বয়ং প্লেগ-হাসপাতাল দেখিয়া আসিয়া বলিলেন, ব্যামো হইয়াছে বলিয়া তো মানুষ অপরাধ করে নাই। তিনি চেষ্টা করিয়া নিজের বাড়িতে প্রাইভেট হাসপাতাল বসাইলেন।”
সেই সময়ের রূঢ়, বাস্তব ছবি ধরা পড়েছে এখানে— মানুষের ভীতি, কিছু সজ্জন মানুষের এগিয়ে এসে অসহায়ের দিকে সাহায্যের হাত বাড়ানো, সেবা কাজের নিদর্শন— প্লেগ-আক্রান্ত কলকাতার চিত্রটা এ রকমই ছিল। এ নিয়ে ইতিহাসবিদরা একটু-আধটু চর্চা করেছেন ঠিকই, কিন্তু পরিচিত আখ্যানকে অন্য ভাবে পুনঃপাঠের দরকার আছে কি না, সেই অনুসন্ধান করা যেতে পারে।
প্লেগের আবির্ভাব প্রথম নজরে এল বোম্বাই শহরে, ১৮৯৬-তে। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ কলেরা, ম্যালেরিয়া বা স্মলপক্সের বিস্তারের সময়ে সীমিত হস্তক্ষেপের নীতি অনুসরণ করতেন। সেটাই ছিল তাঁদের আর্থিক ও রাজনৈতিক অবস্থানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। ১৮৯৭-এর ফেব্রুয়ারি-মার্চে ভেনিসে ইন্টারন্যাশনাল স্যানিটারি কনফারেন্স-এ সমবেত ইউরোপের দেশগুলি ঘোষণা করেছিল যে, প্লেগ না আটকালে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ করা হবে। আর্থিক ক্ষতির ভয়ে ভারত সরকার অতি তৎপরতার সঙ্গে ব্যবস্থা করার জন্য আকুল হয়ে পড়ল! ১৮৯৭-এর ফেব্রুয়ারিতে ভাইসরয় লর্ড এলগিন চালু করলেন মহামারি আইন। যত্রতত্র মানুষের (এমনকি মহিলাদের) শারীরিক তল্লাশ, সম্পত্তি পুড়িয়ে দেওয়া, ঘরের ভিতরে সেনার অনুপ্রবেশ, জবরদস্তিমূলক স্বতন্ত্রীকরণ চালু হল। অজানা আতঙ্কে মানুষ বিপর্যস্ত হলে বহু গুজব ও কাহিনির জন্ম হয়, তা কারও অজানা নয়। গুজব রটল যে, সরকার বাহাদুর জোর করে হাসপাতালে ভর্তি করে আর টিকা দিয়েমানুষ মারার ষড়যন্ত্র করছে। বোম্বাইয়ে প্রায় এক হাজার মিল শ্রমিক আক্রমণ করল আর্থার রোড হাসপাতাল, যখন জানা গেল এক মহিলা-শ্রমিককে প্লেগে আক্রান্ত সন্দেহে আটকে রাখা হয়েছে। ভারতের নানা প্রান্তে বার্তা ছড়িয়ে গেল, ব্রিটিশ রাজের পতন ঘটতে চলেছে। প্রজাবিরোধী সরকার খাবারে, পানীয় জলে, হাসপাতালের ওষুধে বিষ মেশাচ্ছে মানুষ মারার জন্যে। কলকাতায় মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে বিশ্বাস জন্মাল, ব্রিটিশ সরকার হজে যাওয়াআটকানোর জন্যেই টিকা দেওয়ার আর হাসপাতালে আটকে রাখার ফন্দি বার করেছে।কারণ তাদের আশঙ্কা, হজযাত্রীরা ফেরার সময় তাঁদের সঙ্গে তুর্কি বাহিনী এসে ইংরেজ রাজত্বের অবসান ঘটাবে।
১৮৯৮-এর এপ্রিল নাগাদ কলকাতায় প্লেগে মানুষ আক্রান্ত— এ খবর সরকারি নথিতে উল্লেখ করা হচ্ছে। বোম্বাইয়ের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে কলকাতায় ইংরেজ সরকার সাবধানি পদক্ষেপ করছিল। কিন্তু আতঙ্কিত, দিশেহারা মানুষজনকে বোঝাবে কে? মে, ১৮৯৮ থেকে দেখতে পাচ্ছি— কিছু দরদি মানুষ নিজেদের প্রাণ বিপন্ন করে দরিদ্র, ভীতসন্ত্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছেন, শেখাচ্ছেন কী করা উচিত বা উচিত না, স্বাস্থ্যবিধি কী ভাবে পালন করতে হবে। এঁদের নেতৃত্বে ছিলেন স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ, যিনি ১৮৯৮-এর ৩ মে দার্জিলিং থেকে কলকাতায় ফিরেই মুখোমুখি হলেন ক্ষিপ্ত জনতার, যারা তাঁর বাক্স ও গাঁটরিতে টিকা দেওয়ার সরঞ্জাম আছে ভেবে আক্রমণ করতে উদ্যত। কোনও মতে বুঝিয়ে তাদের সে যাত্রা থামানো গেল। ইতিমধ্যে বিলেত থেকে কলকাতায় এসেছেন মিস মার্গারেট নোবেল; মার্চ মাসে দীক্ষা গ্রহণান্তে যিনি হলেন নিবেদিতা। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের অন্যান্য সন্ন্যাসীর সঙ্গে তিনিও ঝাঁপিয়ে পড়লেন প্লেগ থেকে মানুষকে রক্ষার কাজে।
প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ডেভিড আর্নল্ড কলোনাইজ়িং দ্য বডি গ্রন্থে দু’-একটি পঙ্ক্তি খরচ করে জানিয়েছেন, ‘দ্য ফলোয়ারস অব রামকৃষ্ণ’-রা কী করেছিলেন! কিন্তু অনেক কথা অকথিত থেকে গিয়েছে! সক্ষম, ধনী ব্যক্তিরা সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে স্বগৃহে বন্দোবস্ত করে রোগীদের রাখতে পারতেন। অবহেলিত, দরিদ্র মানুষদের বোঝানোর দায়িত্ব নিলেন এই সন্ন্যাসীরা।
স্বামীজির নির্দেশে নিবেদিতা প্রচারপত্রের খসড়া তৈরি করলেন। এর মধ্যে বিস্তারিত ভাবে লেখা হল, এই অসুখের সময় সুস্থ থাকার জন্য কী কী করা প্রয়োজন। স্বামী অখণ্ডানন্দ হিন্দি ও বাংলায় লেখা হ্যান্ডবিল বিলির উদ্যোগ করলেন। ক্ষিপ্ত ও সন্দেহপীড়িত মানুষের মধ্যে প্রচারের কাজে যাওয়ার সময় জীবনহানির ভয়কে জয় করে ১০০০০ হ্যান্ডবিল বিলি করা গেল। ১৮৯৯ সালে প্লেগের ভয়াবহ দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়ল কলকাতার বুকে। স্বেচ্ছাসেবক নির্বাচন, সাহায্যসমিতি তৈরির কাজে, স্বামীজির পাশে নিবেদিতা এবং অকুতোভয় সন্ন্যাসীরা। দরিদ্র বস্তিবাসীকে স্বাস্থ্যবিধি শেখানো, সাফাই অভিযান পরিচালনা, রোগাক্রান্তদের সেবা তাঁদের দৈনন্দিন কাজ তখন। বাগবাজার, শ্যামবাজার, শিয়ালদহ অঞ্চলে এঁদের কাজ সাড়া ফেলে দিয়েছিল। পত্রিকায় অর্থসাহায্যের আবেদন করে নিবেদিতার লেখা পড়ে সাহায্যকারী কেউ কেউ এগিয়ে এলেন। ডাক্তার রাধাগোবিন্দ করের মতো প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে বিধৃত হয়ে আছে নিবেদিতার সেবাকার্যের কথা।
উন্নাসিক বিদেশি শাসকরা মহামারি বা অন্য অসুখের বিস্তারের জন্য দায়ী করে চলেছিলেন ভারতীয়দের অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস, কুসংস্কার, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে অনাগ্রহকে।পশ্চিমি সভ্যভব্য মানুষের তুলনায় প্রাচ্যের মানুষগুলোর অভ্যাস বড্ড বর্বর আর অনুন্নত— এটা তাঁরা বরাবরই বলে এসেছেন! এদের শিখিয়ে-পড়িয়ে সভ্য করে তোলা ভগবানের অসাধ্য!প্লেগের ক্ষেত্রেও এই মানসিকতার অভাব হয়নি। জবরদস্তি করেই তাদের উপরে ব্যবস্থাগুলো চাপাতে হবে। কিন্তু ভারতের লোকজন যে এত গর্জে উঠবে, কে বুঝেছিল!পুণে শহরে প্লেগ কমিটির চেয়ারম্যান ডব্লিউ সি র্যান্ড এবং তাঁর সহকারি চার্লস এগারটন আয়ার্স্টকে জবরদস্তিমূলক কাজের জন্য হত্যা করার শাস্তিস্বরূপ চাপেকর ভাইদের ফাঁসি ও টিলকের গ্রেফতার ও কারাদণ্ড— ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে জনরোষের স্ফুরণ হিসাবে সঙ্গত ভাবেই বহু আলোচিত। টিলকের মরাঠা পত্রিকাতে লেখা হয়েছিল, জনগণ ‘মূর্খ’ বলেই এটা ধরে নেওয়া উচিত হবে না যে, শীর্ষস্থানীয় ও বিশেষত শিক্ষিত শ্রেণির মানুষরা আধুনিক স্বাস্থ্যসম্মত পদ্ধতিগুলোর গুরুত্ব বোঝেন না। নিবেদিতার কণ্ঠে ভিন্ন সুর। বিদেশি সরকার ওধনীসমাজের মানসিকতার তীক্ষ্ণ সমালোচনা করলেন নিবেদিতা। স্বার্থপর মালিকরাবস্তিবাসীর কাছ থেকে ভাড়া আদায় করে, আবার আবর্জনা পরিষ্কারের খরচও তাঁদের উপরেই চাপাতে চায়! কেউ কেউ ঘৃণা ভরে বলেন ‘নেটিভ’দের কখনও পরিষ্কার করা যাবে না।কিন্তু নিবেদিতা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে বললেন, এই কথা একদম যুক্তিহীন! জনগণ পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে খুব আগ্রহী। ২২ এপ্রিলের সভায় অসুস্থ স্বামীজি তীক্ষ্ণ ভাবে বললেন, তত্ত্বকথা না আওড়ে বাঙালিদের কাজ করতে হবে। ইংরেজদের নিন্দা ও সমালোচনার জবাব দিতে হলে আলস্য ঝেড়ে ফেলে কলঙ্ক মোচন করতে হবে।
প্লেগকে কেন্দ্র করে যা যা বলা এবং করা হল, তাকে শুধু রোগনিরাময়ের কাজ বললে হবে না। ভারতীয়দের সামাজিক দায়িত্ব পালন বিষয়ে সচেতন করা, সমাজের অবহেলিত এবং ঘৃণিত অংশকে সাহায্য দান ও স্বনির্ভরতার মন্ত্রে দীক্ষিত এবং শিক্ষিত করা, বিদেশি সরকারের দেওয়া অলস তকমাকে ভুল প্রমাণিত করা, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আত্মত্যাগের মন্ত্রে দীক্ষিত করার কাজ এক জাতীয় অনুপ্রেরণার সম্ভাবনাকে তুলে ধরেছিল। নাগরিক জীবনের নতুন, সম্মিলিত এক আদর্শ রচনার এই প্রয়াসের ক্ষেত্র সীমিত হলেও ভবিষ্যতের বৃহত্তর স্বদেশিকতা ও জাতীয়তাবাদী কাজের অনুপ্রেরণা সঞ্চারিত করার মুহূর্ত তৈরি হল। স্বনির্ভরতার মন্ত্র এখানে উচ্চারিত হয়েছিল। বর্ণবৈষম্যবাদী, উন্নাসিক বিদেশি সরকারের অবহেলার প্রতিবাদ ও দেশের বঞ্চিতদের পাশে দাঁড়ানোর প্রয়োজনকে তুলে ধরা গঠনমূলক জাতীয়তাবাদী ভাবনার অবিস্মরণীয় মুহূর্ত বললে বোধ হয় ভুল হবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy