অবস্থান: কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ তৃণমূল কংগ্রেস নেতারা, ২ অক্টোবর, দিল্লি। ছবি: পিটিআই।
এই লেখা যখন লিখছিলাম, রাজ্যের ‘পাওনা’ আদায় করতে যাওয়া তৃণমূলের সাংসদ ও মন্ত্রীদের দল তখন দিল্লির কৃষি ভবনে অবস্থানরত। সাক্ষাতের সময় দিয়েও কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী তাঁদের সঙ্গে দেখা না করায় তাঁরা ততক্ষণে ধর্নায় বসে গিয়েছিলেন। জল যে আরও গড়াতে চলেছে, বোঝার বাকি ছিল না। ঘটনা তেমনই এগোল।
ভদ্রতাকে অনেক সময় দুর্বলতা বলে ভাবা হয়। ধর্না-প্রতিরোধও কি তেমনই কোনও কোনও সময় ‘সৌজন্য’ হয়ে দাঁড়ায়? কথাটি কিছুটা হেঁয়ালির মতো। কিন্তু তৃণমূলের দিল্লি অভিযানের দিকে তাকালে এমন একটি অদ্ভুত ভাবনা মনে আসে।
কেন? কারণ মূলত বিজেপি শাসকদের বিবিধ প্রতিরোধের ‘সৌজন্যেই’ তৃণমূলের দিল্লি অভিযান সহসা জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রভূমিতে শোরগোল তুলতে পেরেছে। সেটিং-ফিটিং যে যা-ই বলুক, সাধারণ মানুষ সোজা বুদ্ধিতে এটাই মনে করবে, তৃণমূলের অভিযান ‘দমন’ করতে কেন্দ্রীয় শক্তিকে আদাজল খেয়ে নামতে হয়েছিল। মাত্র একটি রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা আঞ্চলিক দলটি যদি এ জন্য কিঞ্চিৎ শ্লাঘাবোধ করে, তা হলে এই বাজারে তাদের খুব দোষ দেওয়া যায় কি?
আমরা জানি, যে কোনও বিষয়ে ‘পারসেপশন’ বা ধারণা তৈরি হওয়া রাজনীতিতে খুব অর্থপূর্ণ। আপাতত এই ধারণাটি তৃণমূলের পক্ষে রাজনৈতিক ভাবে কিছুটা স্বস্তিজনক হওয়া স্বাভাবিক। সেই ‘স্বস্তি’র পিছনে প্রধানত দু’টি যুক্তি দেওয়া যায়। এক, তৃণমূলের ‘শক্তি’কে কেন্দ্রের বিজেপি ‘গুরুত্ব’ দেয়, এটা ময়দানে প্রতিষ্ঠা করার মওকা মিলল। দুই, রাজ্যের দাবি সঠিক বলেই ‘জনস্বার্থবিরোধী’ কেন্দ্র সামনে এল না, এটি প্রচারের হাতিয়ার হল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক অবশ্যই আশা করতে পারেন, বিরোধীদের নবগঠিত ‘ইন্ডিয়া’ এই নিয়ে সরব হবে। বস্তুত বিজেপির বিরুদ্ধে লড়ার জন্য বিরোধীদের কাছে এটি হাতেগরম বিষয়ও বটে!
একশো দিনের কাজ এবং আবাস যোজনার বকেয়া টাকার হিসাব নিয়ে রাজ্য ও কেন্দ্রের মধ্যে বিতর্ক চলছে অনেক দিন। রাজ্যের পাওনার দাবি ঠিক, না কি টাকার ‘সদ্ব্যবহার’ নিয়ে কেন্দ্রের অভিযোগের সারবত্তা আছে, সেই সব আলোচনা বহু হয়েছে এবং হবে। সর্বোপরি সত্য জানার অধিকার সাধারণ মানুষের আছে। তাই বিষয়টির দ্রুত মীমাংসা অবশ্যই জরুরি।
কিন্তু তৃণমূলের ঘোষিত কর্মসূচি আটকাতে কেন্দ্রের বিজেপি শাসকদের যে ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা গেল, তার রাজনৈতিক অভিঘাত এবং তাৎপর্য বহুমুখী। এক কথায় বললে, ‘বাজনা’ বোধ হয় এ বার ‘খাজনা’কে ছাপিয়ে যাবে। ভোটের বাজারে টাকা আদায়ের দাবির চেয়ে হয়তো বেশি জোরদার হয়ে উঠবে বিরোধীদের ‘রুখতে’ শাসকের ভূমিকা।
কোনও শাসকই বিরোধীদের প্রতিবাদ-আন্দোলনকে খোলা মনে গ্রহণ করতে পারেন না। কেন্দ্র, রাজ্য ও দল নির্বিশেষে এমন দেখতে দেখতে অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ হচ্ছে আমাদের। আসলে গণতন্ত্রে এটি এক দুর্ভাগ্যজনক সত্য! রাজনীতিতে সহিষ্ণুতা ও মূল্যবোধের মাত্রা যত কমছে, ততই এ সবের মাত্রা বাড়ছে। পশ্চিমবঙ্গ সেখানে কোনও ব্যতিক্রম হতে পারে না। বামেদের রাইটার্স এবং তৃণমূলের নবান্ন ক’বার বিরোধীদের ক’টি অভিযান এগোতে দিয়েছে? ক’বার ক’টি আন্দোলনকারী দলের সঙ্গে তারা ডেকে কথা বলেছে? বিরোধী নেত্রী থাকাকালীন মমতাকে এক বার চুলের মুঠি ধরে রাইটার্সের অলিন্দ থেকে লালবাজারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। জ্যোতি বসু তখন মুখ্যমন্ত্রী। মমতার মুখ্যমন্ত্রিত্বেও বিরোধীদের আন্দোলন রুখতে পুলিশ-প্রশাসন কী ভাবে কোমর বাঁধে, তা প্রায়ই দেখা যায়। আর বিজেপি ক্ষমতায় থাকলে কী হয় তার নজির দিল্লি এবং তাদের শাসিত রাজ্যগুলির দিকে তাকালে বুঝতে বাকি থাকে না। সুতরাং এগুলি নিয়ে তুল্যমূল্য বিচার করার চেয়ে ভস্মে ঘি ঢালা ভাল!
কিন্তু তৃণমূলের এই দিল্লি অভিযান ঘিরে কেন্দ্রের বিজেপি শাসকেরা ‘গণতন্ত্র’-এর যে পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করলেন, তা সম্ভবত সব কিছুকে ছাপিয়ে যায়। শুধু সোমবার বা মঙ্গলবারের ঘটনায় ব্যাপারটি সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। দেখতে হবে আন্দোলন ঘোষণার গোড়া থেকে।
আগেই বলেছি, সত্যাসত্য তর্কের বিষয় ও প্রমাণসাপেক্ষ। তবে রাজ্যের পাওনার পরিমাণ দাবি করে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে রাজ্যের টানাপড়েন জারি আছে। তাই অভিষেক সদলবল দিল্লি অভিযানের ঘোষণা করেছিলেন ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে। তার পরে কী হল?
সংক্ষেপে মূল ঘটনাগুলি একটু ফিরে দেখা যাক। অভিযানের তারিখেই কেন্দ্রীয় এজেন্সি অভিষেককে তদন্তের কারণে কলকাতায় তলব করেছিল। দলের লোকজনের ট্রেনে দিল্লি যাওয়ার জন্য আগাম টাকা দিয়ে করা বিশেষ বুকিংয়ের আবেদন শেষ মুহূর্তে খারিজ করা হল। গান্ধীজয়ন্তীর দুপুরে রাজঘাটে তৃণমূলের অনিয়ন্ত্রিত ভিড় এবং লাঠি ওঁচানো পুলিশের ‘অ্যাকশন’ মিলেমিশে বড় অশান্তি তৈরি হল। পরের দিন নিরাপত্তার বেড়া পেরিয়ে যন্তর মন্তরের সমাবেশে পৌঁছতে তৃণমূলের সাধারণ কর্মীদের কালঘাম ছুটল। সর্বশেষ কৃষি ভবনে কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রীর ‘দর্শন-বঞ্চিত’ তৃণমূলের সাংসদ, মন্ত্রী প্রমুখ পুলিশের হাতে ধাক্কা খেতে খেতে বেরিয়ে ‘আটক’ হলেন। একাধিক মহিলাকে চ্যাংদোলা করে বার করতেও দেখা গেল। অনেক পরে ওই মন্ত্রী বললেন, “আমি তো বসেই ছিলাম!”
আপাতদৃষ্টিতে এর কোনওটিই কি শাসকের পক্ষে যায়? আমজনতার চোখে বরং উল্টোটাই বেশি ধরা পড়ে। বিষয়টি আরও দৃষ্টিকটু মনে হয়, যখন জানা যায়, যে মন্ত্রীর দেখা পেতে তৃণমূলের নেতারা দেড়-দু’ঘণ্টা বসেছিলেন, তিনিই তার দু’চার ঘণ্টা আগে রাজ্যের বিরোধী দলনেতার সঙ্গে ‘পাওনা-বিরোধী’ বৈঠক সেরে ফেলেছেন! সব মিলিয়ে সেখানেই তৃণমূল, আরও নির্দিষ্ট ভাবে বললে অভিষেক, এখনকার মতো হয়তো খানিক এগিয়ে থাকলেন।
এ তো গেল বৃহত্তর রাজনীতির দিক। তৃণমূলের অন্দরে এই কর্মসূচির কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে, তা-ও চর্চার বাইরে নয়। যে কথা আগেই বলেছি, যে উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য নিয়ে এই আন্দোলন সংগঠিত করা হয়েছিল, তাকে সরাসরি ‘ব্যর্থ’ বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। বস্তুত বৈঠক হওয়া, না-হওয়া দু’দিক থেকেই তৃণমূলের পক্ষে এটি খানিকটা ‘উইন-উইন’ পরিস্থিতি ছিল।
যদি কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে সুষ্ঠু ভাবে আলোচনা হত, তা হলে অভিষেকরা বলতে পারতেন, তাঁরা কেন্দ্রকে আলোচনায় বসিয়ে বিবেচনার ‘আশ্বাস’ আদায় করেছেন। হয়নি বলে এখন তাঁরা আঙুল তুলতে পারবেন বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে। সন্দেহ নেই, প্রথম থেকে নেতিবাচক ভুমিকা থাকায় বিজেপির অবস্থান সে দিক থেকে কিছুটা নড়বড়ে হয়ে রয়েছে। গিরিরাজ সিংহের মতো পূর্ণমন্ত্রী নিজে বৈঠকে বসে কিছু ‘তথ্য’ হাজির করে অন্তত রাজ্যের দাবি খারিজ করতে চাইলেও পাল্টা বলার একটা জায়গা থাকত। বৈঠক এড়িয়ে সেই পথটিও সঙ্কীর্ণ হয়ে গেল।
এই অভিযান কর্মসূচি ছিল অভিষেকের মস্তিষ্কপ্রসূত। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হিসাবে এর জন্য কয়েক মাস ধরে যাবতীয় প্রস্তুতি নিয়েছিলেন তিনিই। তাতে এতটাই পেশাদারিত্ব ছিল যে, যাত্রার এক দিন আগে বিশেষ ট্রেনের আবেদন খারিজ হওয়া মাত্র পঞ্চাশটিরও বেশি বাস জোগাড় করে লোক পাঠানোর বিকল্প ব্যবস্থা হয়ে যায়।
কথা ছিল মমতা নিজে দিল্লির কর্মসূচিতে থাকবেন। শারীরিক কারণে তাঁর যাওয়া হয়নি। ঘটনাচক্রে সবটাই তাই আক্ষরিক অর্থে ছিল ‘অভিষেক শো’। অনেকের মতে, একক নেতৃত্বে দিল্লির এই কর্মসূচি অভিষেকের ‘কর্তৃত্ব’ আরও মজবুত করল। তবে এমনিতেই তো মমতার অনুমোদনে দলে অভিষেকের ‘শীর্ষত্ব’ এখন প্রশ্নাতীত ভাবে প্রতিষ্ঠিত। দিল্লির অভিযান তার একটি অঙ্গ মাত্র। এ বার দেখার হল, আগামী দিনে বিরোধী রাজনীতির জাতীয় মঞ্চে তাঁর ‘অবস্থান’ কী ভাবে চিহ্নিত হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy