স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী আর শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবার্ষিকীর আলোতে একই সঙ্গে উদ্ভাসিত বাংলাদেশ। অদ্ভুত সমাপতন। এ কথা তো সত্যি যে, মুজিবের মতো নেতা ছাড়া বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের সাহসী চেতনার বিস্তার হত না। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সেই বজ্রকণ্ঠের উচ্চারণ বাংলাদেশের মানুষকে স্বাধীনতার যুদ্ধে পাঠিয়েছিল, মানুষ বীরদর্পে মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করেছিল চেতনায়। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ত্রিশ লক্ষ জীবন উৎসর্গকারী সেই যুদ্ধ নিয়ে এসেছিল গৌরবময় বিজয়। স্বাভাবিক ভাবেই সেই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী আর বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষের এই সংযোগ বাংলাদেশের কাছে, বাঙালির কাছে যেন এক মাহেন্দ্রক্ষণ। দুটো ঘটনাই ভবিষ্যতের বাংলাদেশে ঐতিহ্যের দিশা হয়ে থাকবে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়াবে অগ্নিশিখার আলো।
১৯৬৮-৬৯ সাল নাগাদ যুবসমাজের নেতৃত্বে কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের স্লোগানে মুখরিত হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান— ‘শেখ মুজিব এসেছে, বাঙালি জেগেছে’। স্লোগানে জেগে উঠেছিল বাঙালি। বাঙালির চেতনায় ফুল ফুটিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতার স্বপ্নে মানুষকে উদ্দীপিত করে বাঙালিকে লড়াকু জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। স্বাধীনতার পরে সরকারের দায়িত্ব নিয়ে তিনি দেশ পুনর্গঠনের নানামুখী কর্মকাণ্ড শুরু করেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনেতিক-সামাজিক কাঠামো ভেঙে পড়েছে, স্বজনহারানো মানুষের কান্না থামেনি। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে তিনি অস্ত্র জমা নিতে থাকেন। যুদ্ধের সময় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের সাহায্যের ব্যবস্থা করেন। যোগাযোগ ব্যবস্থা সচল করতে রাস্তাঘাট, সেতু, রেললাইন পুনর্নির্মাণের নির্দেশ দেন। শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করতে শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। গঠিত হয় পরিকল্পনা কমিশন। ২৫ বিঘা পর্যন্ত কৃষিজমির খাজনা মকুব করেন। চালু করেন পল্লি বিদ্যুৎ। শিল্প-কারখানা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় পরিচালনার ব্যবস্থা করেন। নতুন দেশের যাত্রা শুরুর পরিকল্পনা তিনি সুচিন্তিত ভাবে করেছিলেন। ১৯৭২-এর মধ্যেই প্রণীত হয় সংবিধান— জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা যার মূল নীতি।
ধর্মনিরপেক্ষতা তাঁর জীবনদর্শনের অন্যতম দিক। ছাত্রজীবন থেকে তাঁর অবস্থান সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। ১৯৪৬-এর কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবিধ্বস্ত এলাকায় তিনি রিলিফের কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন, দাঁড়িয়েছিলেন বিপন্ন মানুষের পাশে। অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্ত ১৯৪৩ সালে তদানীন্তন ইসলামিয়া কলেজে শিক্ষক ছিলেন। আট দশক গ্রন্থে তাঁর স্মৃতিচারণ: ‘ইসলামিয়ার ছাত্ররা যে আমাদের জন্য কতটা করতে পারত তার প্রমাণ পেলাম ১৯৪৬-এর রক্তাক্ত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়। বালিগঞ্জ থেকে ইসলামিয়া কলেজের রাস্তায় পদে পদে বিপদ। এই রাস্তা আমাদের ছাত্ররা পার করে দিত... কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি সেই সব মুসলমান ছাত্রদের, যাঁরা আমাদের সঙ্গে করে নিয়ে বিপজ্জনক এলাকাটা পার করে দিতেন। এই সব ছাত্রের এক জনের নাম ছিল শেখ মুজিবুর রহমান।’
বঞ্চিত মানুষদের কথা মনে রেখে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা চিন্তা করেছিলেন তিনি। এই লক্ষ্যেই ১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি গঠন করেন রাজনৈতিক সংগঠন ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’, সংক্ষেপে ‘বাকশাল’। বাকশালকে ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ বলে উল্লেখ করেন বঙ্গবন্ধু। বাকশাল-এর মূল লক্ষ্য চারটি— গণমুখী প্রশাসন, গণমুখী বিচারব্যবস্থা, বাধ্যতামূলক বহুমুখী গ্রাম সমবায় ও শোষিতের গণতন্ত্র। তিনি সাধারণ মানুষের দারিদ্র মোচনে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিশ্বাসী ছিলেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে লিখেছেন, “আমি নিজে কমিউনিস্ট নই। তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণের যন্ত্র হিসেবে মনে করি।” সাধারণ মানুষের জীবনে সমতা তৈরিতে তাঁর নিবিড় পর্যবেক্ষণ ছিল। এ ভাবে তিনি নিজ দর্শনের আলোকে রাষ্ট্রের মৌলিকতায় গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।
দেশবাসীর জন্য বঙ্গবন্ধু যা করেছেন, সেই আদর্শ ধারণ করে পথ চলছেন তাঁর কন্যা, বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা— এমন বললে একটুও অতিরঞ্জন হবে না। উন্নয়নের ধারাবাহিকতার কর্মযজ্ঞকে তিনি এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন বিশ্বের দরবারে। তাঁর শাসনের এক যুগের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পেয়েছে। পিতার দূরদৃষ্টি তিনি আত্মস্থ করেছেন, বাস্তবায়িত করেছেন জনগণের কল্যাণে।
ইতিমধ্যে বাংলাদেশের ২১ ফেব্রুয়ারি ইউনেস্কো-র স্বীকৃতিতে হয়ে উঠেছে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ইউনেস্কো-র ঐতিহাসিক প্রামাণ্য দলিল হিসেবে সংরক্ষিত। বিশ্বের সামনে এ এক গৌরবময় অর্জন। প্রধানমন্ত্রী হাসিনাও পুরস্কার লাভ করেছেন, এই আন্তর্জাতিক পুরস্কার বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে উজ্জ্বল করেছে। পিতা থেকে কন্যা, শেখ মুজিবুর রহমান থেকে শেখ হাসিনা— এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ, হয়তো উজ্জ্বলতর ভবিষ্যতের দিকে।
এই পঞ্চাশ বছরের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা? পরিবার-সহ বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু, কিছু পর্বে স্বাধীনতা-বিরোধীদের ক্ষমতা গ্রহণ। অন্য দিকে, এই পঞ্চাশ বছরের যে সাফল্য, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আজ সেই গণজীবনেরই উজ্জ্বল সমারোহ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy