Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
Anti-Indian Sentiment

ভারতের ক্ষুব্ধ পড়শিরা

পোড়-খাওয়া কুটনীতিজ্ঞরা অবশ্য বরাবরই বলেন যে, এ ভাবে কোনও ভৌগোলিক অঞ্চলকে নিজের ঘরের লাগোয়া বাগান বলে ধরে নেওয়ার মধ্যেই রয়েছে সমস্যার বীজ।

—প্রতীকী ছবি।

প্রণয় শর্মা
শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০২৪ ০৮:৩৪
Share: Save:

গত বছর পর্যন্ত মলদ্বীপ বলতে ভারতীয়রা বুঝত পর্যটনের এক স্বর্গরাজ্যকে। ভারত মহাসাগরের বুকে সবুজ দ্বীপপুঞ্জ ছিল প্রিয়জনের সঙ্গে সময় কাটানোর সেরা জায়গা। পরিস্থিতি ঘুরে গেল যখন ভারত-বিরোধিতার হাওয়া তুলে জিতে এলেন প্রেসিডেন্ট মহম্মদ মুইজ্জু। পূর্বতন প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম সোলি ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখে চলতেন। মুইজ্জুর মন্ত্রিসভার তিন জন সদস্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রতি কুরুচিকর মন্তব্য করায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে ভারতে। ভারতের চিত্রতারকা থেকে সাধারণ পর্যটক, সকলেই মলদ্বীপকে বয়কটের ডাক দেন। মলদ্বীপের পর্যটনে ভাটার টান ধরিয়ে হয়তো তাঁরা মলদ্বীপকে ‘শিক্ষা’ দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু এর পর পর দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলে যে সব ঘটনা ঘটে গেল, তাতে তাঁদেরও তাক লেগে গেল।

ফেব্রুয়ারিতে নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্পকুমার দহল প্রচণ্ড জোট ভেঙে দিলেন নেপালি কংগ্রেসের সঙ্গে। ভারতবন্ধু বলে পরিচিত নেপালি কংগ্রেসের পরিবর্তে প্রচণ্ড নতুন জোটসঙ্গী করলেন কে পি শর্মা ওলির নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপালকে। ওলি চিনের কট্টর সমর্থক বলে সুপরিচিত। নেপালে এই পটপরিবর্তনের ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার আগেই বাংলাদেশে সমাজমাধ্যমে ঝড় তুলল ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাক। এই প্রচারের পিছনে সে দেশের প্রধান বিরোধী, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টির প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল। ভারতেও বিষয়টা নজরে এল। বাস্তবে এই বয়কটের ডাক কতটা প্রভাব ফেলতে পেরেছে, তা নিয়ে কূটনৈতিক মহলে বিতর্ক চলতে চলতেই শ্রীলঙ্কা নিয়ে তৈরি হল নতুন সঙ্কট। মোদী তামিলনাড়ুতে নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে ডিএমকে এবং কংগ্রেসের উপর দোষারোপ করলেন, তারা কলম্বোর সঙ্গে চুক্তি করে পক প্রণালীর এক ক্ষুদ্র দ্বীপকে শ্রীলঙ্কার হাতে তুলে দিয়েছে। পঞ্চাশ বছরের পুরনো সেই চুক্তি বাতিলের কোনও উদ্দেশ্য সম্ভবত সরকারের ছিল না, ভোটযুদ্ধে বিজেপির প্রভাব বাড়ানোই মোদীর লক্ষ্য ছিল। কিন্তু শ্রীলঙ্কার সংবাদমাধ্যমে তৎক্ষণাৎ প্রসঙ্গটি নিয়ে আলোচনা শুরু হল, বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুললেন, জোটসঙ্গী হিসাবে ভারত কতটা নির্ভরযোগ্য?

ভারতের প্রতিবেশী রাজ্যগুলিতে ভারত-বিরোধিতার দমকা হাওয়া যেমন দ্রুত বেগে ছড়িয়ে পড়ল, তাতে ফের ভেসে উঠল একটা প্রশ্ন যা মাঝেমাঝেই ভাবায় নীতি নির্ধারক ও বিশেষজ্ঞদের— যে ভৌগোলিক অঞ্চলকে ভারত চিরকাল নিজের ঘরের আঙিনা বলে ভেবে এসেছে, সেখানে কি সে পিছু হটে যাচ্ছে?

পোড়-খাওয়া কুটনীতিজ্ঞরা অবশ্য বরাবরই বলেন যে, এ ভাবে কোনও ভৌগোলিক অঞ্চলকে নিজের ঘরের লাগোয়া বাগান বলে ধরে নেওয়ার মধ্যেই রয়েছে সমস্যার বীজ। অতীতের অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে, কোনও বৃহৎ শক্তি কোনও অঞ্চলে নিজের একক আধিপত্য জারির চেষ্টা বেশি দিন ধরে রাখতে পারেনি। আমেরিকার বিদেশ নীতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল ‘মনরো নীতি’— যা পশ্চিম গোলার্ধকে ইউরোপের দেশগুলির ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত রাখতে চেয়েছিল। বিশেষত উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় আমেরিকানদের প্রাধান্য বজায় রাখতে চেয়েছিল মনরো নীতি। সেই নীতিও সম্পূর্ণ সফল হয়নি— আজ রাশিয়া, চিন স্বচ্ছন্দে আমেরিকার খিড়কি দুয়ারের দেশগুলির সঙ্গে কূটনৈতিক এবং ব্যবসায়িক সম্পর্ক তৈরি করছে, প্রভাব বাড়াচ্ছে।

তেমনই, শীতল সমর আমলে রাশিয়ার আশেপাশের যে দেশগুলিতে মস্কোর একক প্রভাব ছিল, সোভিয়েট ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পরে সেগুলি ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, এবং নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অ্যালায়েন্স-এর (নেটো) সদস্য হয়েছে। আবার, চিনের সরকার ক্ষুদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও তার প্রতিবেশী দেশগুলি, এমনকি কমিউনিস্ট মতাদর্শী ভিয়েতনাম, লাওস, কাম্বোডিয়ার মতো দেশগুলিও নিজের নিজের জাতীয় স্বার্থে বহু-পাক্ষিক জোট তৈরি করেছে।

অতএব এই বিশ্বায়নের যুগে ভারত কোনও অঞ্চলে তার একক প্রভাব জারি রাখবে, এ এক অবাস্তব প্রত্যাশা। প্রতিবেশী দেশগুলিতে যে পর পর ঘটে গিয়েছে এমন কিছু ঘটনা যা ভারত-বিরোধী মনোভাবের দ্রুত বৃদ্ধি ঘটিয়েছে, তা বস্তুত এক নয়া বাস্তবের প্রতিফলন। তা এই যে, ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলি নতুন নতুন সঙ্গীর খোঁজ করছে, বিশেষ করে চিনের দিকে হাত বাড়াচ্ছে।

চিন যে সম্প্রতি ভারতের আশেপাশের দেশগুলিতে নিজের প্রভাব আরও বাড়াচ্ছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে তার মানে এই নয় যে, ভারত ছবির বাইরে চলে যাচ্ছে। এই সব দেশই ভারত এবং চিন, এবং সম্ভবত আমেরিকা এবং অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক থেকে যথেষ্ট লাভবান হচ্ছে। ভারত-বিরোধিতার অবস্থান নিলে তাদের পক্ষে দরদস্তুরে কিছুটা সুবিধা হয়, চাপ তৈরি করে আরও কিছু আদায়ের সম্ভাবনা বাড়ায়।

যত দিন ভারতের মৌলিক স্বার্থ সুরক্ষিত রয়েছে, কোনও দেশে চিন-বান্ধব সরকার এলে, কিংবা ভারত-বিরোধিতার পালে হাওয়া দিয়ে কোনও দল নির্বাচন লড়লে, ভারতের খুব বেশি বিচলিত হওয়ার কারণ নেই। বড় জোর কিছু দিন সমাজমাধ্যমে হইচই চলবে। অন্যান্য দেশ আগেই যা করেছে, তা এখন করতে হবে ভারতকেও— দক্ষিণ এশিয়ার এই ‘নিউ নর্মাল’ পরিস্থিতি মেনে নিতে হবে।

অন্য বিষয়গুলি:

India China Maldives
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy