Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Durga Puja 2023

পুজো, না অসুস্থ প্রতিযোগিতা

উৎসব মানুষের জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ, এর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কিন্তু সেই উৎসবকে উপলক্ষ করে যদি একটা প্রতিযোগিতার মনোভাব মানুষের মনে সঞ্চারিত হয়, তা সুস্থতার পরিচায়ক নয়।

An image of Durga Puja Pandal

রাজ্য তথা দেশের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ আসেন এই সময় কলকাতায় পুজো দেখতে। —ফাইল চিত্র।

সুগত ত্রিপাঠী
শেষ আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০২৩ ০৪:২৯
Share: Save:

দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে রাজ্য জুড়ে একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতার আসর বসে চলেছে বিগত বেশ অনেক বছর ধরে। সর্বজনীন পুজোয় একে অপরকে টেক্কা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। এ সঙ্ঘ এ বছর চামচের মণ্ডপ তৈরি করে, তো পরের বছর ওই ক্লাব সাবুদানা দিয়ে প্রতিমা বানায়। এক জনের মণ্ডপ বিশ্বের অতিখ্যাত সৌধের অক্ষম অনুকরণ, তো অপরের প্রতিমা অভ্রংলিহ। মণ্ডপের ভিতরেও কত না কারুকাজ! ‘আসল সোনা’, ‘আসল হিরে’ দিয়ে তৈরি হয়েছে প্রতিমার গয়না, ঝাড়লণ্ঠন আনা হয়েছে রাজস্থানের রাজপ্রাসাদ থেকে, এই জাতীয় কথাগুলি লোকের মুখে মুখে ফেরে কোনও কোনও সর্বজনীন পুজো সম্পর্কে। দর্শকসংখ্যা বাড়ে, ক্লাবের নামডাক হয়।

উৎসব মানুষের জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ, এর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কিন্তু সেই উৎসবকে উপলক্ষ করে যদি একটা প্রতিযোগিতার মনোভাব মানুষের মনে সঞ্চারিত হয়, তা সুস্থতার পরিচায়ক নয়। নামেই আরাধনা, প্রকৃতপক্ষে বৈভবের প্রদর্শন চলে ওখানে। ইউনেস্কো নাকি ‘হেরিটেজ’ ঘোষণা করেছে কলকাতার দুর্গাপুজোকে। তাতে কার কী এসে গেল, বুঝতে পারলাম না। মাঝখান থেকে পুজোকেন্দ্রিক উৎসাহ অনেকের সাঙ্ঘাতিক বেড়ে গিয়েছে। প্রসঙ্গত, সেই ইউনেস্কো বিশ্বব্যাপী এমন কিছু বস্তুকে ‘ইনট্যান্‌জিবল হেরিটেজ’ ঘোষণা করেছে, যা বিতর্কিত, বহু মানুষই তা মেনে নেননি। উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে মাদাগাস্কার দ্বীপের এম্বোহিমাঙ্গো পর্বত, ফিলিপাইনসের পুয়ের্তো প্রিনসেসা সাবটেরানিয়ান রিভার ন্যাশনাল পার্ক, কানাডার রিডু ক্যানাল প্রভৃতির কথা। অনেক মানুষের কাছেই এ সবের বিরাট কিছু গুরুত্ব নেই, আবার অনেকের কাছে এগুলি মহামূল্যবান। অনেকে এমন অনেক জিনিসের উল্লেখ করতে পারেন, যেগুলি তাঁদেের চোখে অসাধারণ অথচ ইউনেস্কো-স্বীকৃতি পায়নি— তাঁদের মতে, তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ বহু জিনিস স্বীকৃতি পেয়ে গিয়েছে। কোনও সংস্থার স্বীকৃতি কোনও কিছুর উৎকর্ষের পরিচায়ক নয়। ঠিক যে ভাবে কোনও পুরস্কার কোনও সৃষ্টির গৌরবের পরিচায়ক নয়।

পুজোর আগে বড়-মেজো-ছোট নানা মাপের পুজো-উদ্যোক্তারা দল বেঁধে গিয়ে হাজির হন গৃহস্থের দরজায়। এত জনসমাগম দেখে ভদ্রলোকের ভয় পাওয়াই স্বাভাবিক। হয়তো সেটাই উদ্দেশ্য থাকে পুজো-উদ্যোক্তাদের। অতঃপর মোটা চাঁদা দিয়ে তবে রেহাই মেলে। যাঁদের পক্ষে সেটা সম্ভব হয় না, তাঁরা ফাঁদে পড়ে যান। যেমন, ছাত্রাবস্থায় কলকাতার মেসে থাকাকালীন এদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে বর্তমান লেখক মেসের কলঘরে আত্মগোপন করতেন। আর কেউ যদি চাঁদা না দেন, সে ক্ষেত্রে দু’রকম ব্যবহার হতে দেখা যায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। এক শ্রেণির চাঁদা-পার্টি সেখানেই তর্কাতর্কি জুড়ে দেয়; অন্যরা তখনকার মতো কিছু বলে না, পরে ‘দেখে নেয়’।

দ্বিতীয় সঙ্কট, শব্দতাণ্ডব। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, যে সমস্ত তথাকথিত পুজো-আয়োজক বিপুল পরিমাণ শব্দযন্ত্রণা সৃষ্টি করেন, তাঁদের বেশির ভাগই চূড়ান্ত মদ্যপ, স্রেফ ফূর্তি করাই উদ্দেশ্য। জবরদস্তি চাঁদার একটা বড় অংশ তার জন্যই ব্যয়িত হয়। তাঁরা সহানুভূতি বা পরচিন্তার ধার ধারেন না। যে শব্দসীমা, সময়সীমা মেনে মাইক বাজানোর নির্দেশ রয়েছে, তাতে মানুষের অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, কিন্তু তাঁরা সে-সব মানেন না।

তৃতীয় সঙ্কট, আতশবাজি। যে বিপুল পরিমাণ নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড, সালফার ডাইঅক্সাইড, কপার-ম্যাগনেশিয়াম-জিঙ্ক-ক্যাডমিয়াম-বেরিয়াম-সোডিয়াম-পটাশিয়াম প্রভৃতির যৌগ নির্গত হয় বাজির বিষাক্ত ধোঁয়া থেকে, তাতে মারাত্মক ফুসফুসের সমস্যা এবং শ্বাসনালীর সমস্যা দেখা দিতে পারে। পরিবেশের এমন দুর্দিনেও এই ধারা কিন্তু কমার কোনও লক্ষণ নেই, বরং বৈভবের প্রমাণ হিসাবে তা বেড়েই চলেছে।

ভদ্র পুজো-উদ্যোক্তাদের উচিত চাঁদার কথা কাউকে না-বলা, কারও বাড়ি না-যাওয়া। যাঁর ইচ্ছে হবে তিনি নিজে এসে টাকা দিয়ে যাবেন। একেবারেই যদি চাঁদা না-পাওয়া যায়, সে ক্ষেত্রে উদ্যোক্তারা নিজেদের টাকা দিয়ে পুজো করবেন, সম্ভব না-হলে পুজো বন্ধ করে দেবেন। কিন্তু বহু মানুষের বিরক্তি উৎপাদন করে মোচ্ছব করার কোনও মানে হয় না। যাঁরা চাঁদা দেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই কিন্তু পুজোর ধারকাছ মাড়ান না। ক্লাবের সঙ্গে তাঁদের কোনও সম্পর্কও নেই। শব্দ কিংবা বাজির তাণ্ডব একেবারেই বন্ধ করা উচিত। কিছু মানুষের আনন্দের জন্য এত মানুষের দুর্ভোগ কোনও মতেই সমর্থনযোগ্য নয়।

রাজ্য তথা দেশের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ আসেন এই সময় কলকাতায় পুজো দেখতে। বলা ভাল, আড়ম্বর দেখতে। কিন্তু এর কোনও মানে আছে কি? পুজোর জাঁকজমক কমিয়ে দিলে পুজো হবে, সবই হবে— শুধু বাড়াবাড়ি বাদ যাবে। কারণ আড়ম্বর তথা বাড়াবাড়ি অসুবিধা ছাড়া কিছু করে না। অনেক জায়গায় রাস্তার একটা বড় অংশ নিয়ে প্যান্ডেল করা হয়। এটিও বন্ধ করা প্রয়োজন। হঠাৎ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে, দুর্ঘটনাগ্রস্ত হলে যেন অ্যাম্বুল্যান্স কিংবা দমকল ঢোকার অসুবিধে না হয় ওই রাস্তায়, সেটা দেখতে হবে। পাশ্চাত্য দেশগুলিতে ক্রিসমাস কিংবা গুড ফ্রাইডে বিরাট বড় উৎসব। কিন্তু সেই উপলক্ষে শহরগুলিকে এ ভাবে বাঁশ দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয় কি? এমন ভয়ঙ্কর পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়?

একটা উৎসবকে কেন্দ্র করে বহু মানুষের রুজি-রোজগারের ভাল ব্যবস্থা হয়। কিন্তু তার জন্য উৎসবের আতিশয্যের প্রয়োজন নেই। কী ভাবে আনন্দ করতে হয়, মানুষ নিজেই জানেন। বাহ্যিক চাকচিক্যে অনেকেই আকৃষ্ট হন না। বেশি দিন পিছোতে হবে না, চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগেও বঙ্গভূমিতে পুজোর এই ঘনঘটা ছিল না। অর্থের অপচয় হত না এ ভাবে। তখনও কিন্তু মৃৎশিল্পী থেকে দোকানদার, প্রত্যেকেই পুজোর সময় দু’পয়সার মুখ দেখতেন। সর্বজনীন পুজোর অভব্য হাঁকডাকের প্রয়োজন পড়ত না তাঁদের।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy