পুষ্প পল সিংহ। ফাইল চিত্র।
শাহরুখ খানের সঙ্গে গৌরী খানের প্রথমে আইনি মতে বিয়ে হয়েছিল। তার পরে তাঁরা ইসলামি নীতি মেনে ‘নিকা’ করেছিলেন। শেষে হিন্দু মতে ‘শাদি’-র অনুষ্ঠানও হয়েছিল। শাহরুখ খান প্রায়ই বলেন, তাঁদের পরিবারে কোনও হিন্দু-মুসলমানের ব্যাপার নেই। তাঁর স্ত্রী বিয়ের পরেও হিন্দু। তিনি মুসলমান। তাঁর ছেলেমেয়েরা ‘হিন্দুস্থানি’। স্কুলের ফর্ম পূরণ করার সময় শাহরুখের মেয়ে ছোট্টবেলায় এসে বাবার কাছে জানতে চেয়েছিল, তার ধর্ম কী? শাহরুখ ফর্মে লিখেছিলেন ‘ইন্ডিয়ান’।
আমরা এ সব শুনে ভাবতেই পারি, এ সব সিনেমার পর্দায় হয়। রুপোলি পর্দার নায়ক-নায়িকারা নিজের জীবনের কথা বলার সময়ও সিনেমার বুলি আওড়ান। বাস্তবে এ সব হয় না।
সিপিআইএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরি এক বার সংসদে বলেছিলেন, তাঁর জন্ম গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবারে। কিন্তু তিনি নাস্তিক। ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না। তাঁর স্ত্রী-র বাবা মুসলমান সুফি পরিবারের। মা মাইসুরুর রাজপুত পরিবারের। তাঁর সন্তান হিন্দু না মুসলমান? ইয়েচুরি নিজেই এর উত্তরে বলেছিলেন, “আমার একমাত্র পরিচয় আমি ভারতীয়। এটাই ভারতের ভাবনা, যার মধ্যে সব নিহিত রয়েছে।”
আমরা অনেকেই ভাবি, এ সব রাজনীতির কথা। রাজনীতিবিদরা নিজেদের গরিমা প্রচারের জন্য এ সব কথা বলেন। বাস্তবে এ সব হয় না।
বাস্তবে যে এমন হয়েই থাকে, চার পাশেই যে এমন অজস্র উদাহরণ রয়েছে, তার জীবন্ত প্রমাণ ছিলেন পুষ্প পল সিংহ (ছবি)। গোটা উত্তর-পূর্ব ভারতে যিনি ‘পিপি সিংহ’ নামেই পরিচিত। পঞ্জাবের ভূমিপুত্র পুষ্প পল সিংহের পিতা ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতার অধ্যাপক। কিন্তু পুষ্প পল যোগ দেন সেনাবাহিনীতে। সেনার ক্যাপ্টেন হিসাবে অবসরের পরে ত্রিপুরার আগরতলায় ব্যবসা শুরু করেন। তার পরে যোগ দেন সাংবাদিকতায়। প্রথম সারির সর্বভারতীয় ইংরেজি দৈনিকে প্রথমে ত্রিপুরা, তার পরে অসম থেকে সাংবাদিকতা করেছেন। সাংবাদিকতা থেকে চিত্রসাংবাদিকতার নেশাও পেয়ে বসেছিল তাঁকে।
শুধু পেশার প্রয়োজনে নয়। ভালবাসার টানেও পুষ্প পল উত্তর-পূর্বাঞ্চলেই থেকে গিয়েছিলেন। সংসারও পেতেছিলেন অসমের উত্তর-পূর্বে। বিয়ে করেছিলেন নাগাল্যান্ডের কন্যা ক্যারলকে। পুষ্প পল শিখ। রীতিমতো পাগড়িধারী। ক্যারল খ্রিস্টান। গুয়াহাটিতে পুষ্প পলের বাড়িতে একই সঙ্গে শিখদের আচার-অনুষ্ঠানও পালন হত। ক্যারল খ্রিস্টানদের উৎসবও পালন করতেন। তাঁদের ছেলেমেয়েরা গুরুদ্বারেও যেত, রবিবার সকালে গির্জাতেও। পুষ্প পলের গুয়াহাটির বাসভবনে ফুটে উঠত এক টুকরো ভারতের ছবি।
আজকের ভারতে যখন মানুষকে ধর্মের পরিচয়ে বা জাতের পরিচয়ে বেঁধে ফেলার চেষ্টা হয়, নাগরিক পরিচিতির থেকেও ধর্ম-জাতের পরিচিতি বড় হয়ে ওঠে, তখন সংঘাতের মঞ্চও একই সঙ্গে তৈরি হয়। একই দেশে থেকেও ধর্মীয় সত্তার ভিত্তিতে মানুষ একে অপরের বিরুদ্ধে লড়তে শুরু করে। একে অন্যকে অবিশ্বাসের চোখে দেখতে শুরু করে। মনের মধ্যে বাসা বাঁধে আতঙ্কের আবহ। এই বুঝি আমার ধর্ম বিপদে পড়ল! ওই বুঝি ওর ধর্ম আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হল! অথচ একই ছাদের তলায় থেকেও যে দু’টি মানুষ নিজের ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন, পুষ্প পল সিংহের ছাপোষা জীবনই তার আদর্শ উদাহরণ। তিনি দেখিয়েছিলেন, এর জন্য শাহরুখ খান হতে লাগে না।
হিন্দি বলয়ের অনেকেই উত্তর-পূর্বের মানুষদের খাটো চোখে দেখেন। তাঁদের শারীরিক গড়ন নিয়ে হাসিঠাট্টা করেন। পুষ্প পল ছিলেন এ সবের ঊর্ধ্বে। অসমিয়া থেকে নাগা, খাসি-গারো থেকে মণিপুরি, মিজ়ো, বাঙালি থেকে হিন্দিভাষী— সকলের সঙ্গেই ছিল তাঁর গাঢ় বন্ধুত্ব। সকলের সঙ্গে মানিয়েগুছিয়ে চলা, সকলকে নিয়ে থাকার যে ‘ভারতের ভাবনা’, তা তাঁর মধ্যে নিহিত ছিল। এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্যই উত্তর-পূর্বের সব রাজনীতিকের সঙ্গেই তাঁর পারিবারিক স্তরে বন্ধুত্ব ছিল।
কথায় বলে, কেউ নিজের স্বপ্ন পূরণের জন্য আপনজনের থেকে দূরে থাকে। কেউ আপনজনের কাছে থাকার জন্য স্বপ্ন পূরণ থেকে দূরে থাকে। বহু মানুষই পেশার প্রয়োজনে নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে অন্য রাজ্যে সংসার পাতেন। নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে নিজের জন্মভূমি ছেড়ে থাকেন। কিন্তু তাঁদের অনেকেই ভিনরাজ্য বা ভিনদেশের ঠিকানাকে নিজের বলে ভাবতে পারেন না। পঞ্জাবের ভূমিপুত্র হলেও পুষ্প পল উত্তর-পূর্বকে আপন করে নিয়েছিলেন। সাংবাদিকতার সঙ্গে তাঁর ধ্যানজ্ঞান ছিল গোটা বিশ্বের সামনে উত্তর-পূর্বকে তুলে ধরা। গোটা বিশ্বের পর্যটকদের সামনে কী ভাবে উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে জনপ্রিয় করে তোলা যায়, তার জন্য নিজের মতো করে মাথা ঘামাতেন তিনি।
এই ভাবনারই ফসল, কাজ়িরাঙা এলিফ্যান্ট ফেস্টিভ্যাল। দু’দশক আগে পুষ্প পলের মস্তিষ্কপ্রসূত এই ভাবনা এখন ‘কাজ়িরাঙা হস্তী মহোৎসব’ হিসাবে পরিচিত। একই ভাবে কোনারক ডান্স ফেস্টিভ্যালের ধাঁচে গুয়াহাটির কামাখ্যা মন্দিরের প্রাঙ্গণে কামেশ্বরী নৃত্য মহোৎসবের কথা ভেবেছিলেন পুষ্প পল। কামাখ্যা দেবোত্তর বোর্ডের উদ্যোগে এখনও সেই নৃত্য মহোৎসব হয়ে চলেছে। জীবনের শেষ পর্বে খালসা সেন্টার নর্থ ইস্ট-এর কাজকর্মে জড়িয়ে পড়েছিলেন পুষ্প পল। কোভিডের সময় লক্ষ লক্ষ কাজ-হারা মানুষের জন্য লঙ্গর খুলেছিলেন। অক্সিজেনের অভাব মেটাতে নিজের যোগাযোগে বিদেশ থেকে ২০টি অক্সিজেন কনসেনট্রেটর আনিয়ে ‘অক্সিজেন লঙ্গর’ও চালু করেছিলেন।
পুষ্প পল সিংহ সদ্য প্রয়াত হয়েছেন। জীবনের শেষে তাঁর চোখ দান করেছেন। আশা করতে দোষ নেই, তাঁর চোখ পেয়ে যিনি দৃষ্টিশক্তি পাবেন, তিনিও পুষ্প পলের মতোই সকলের জন্য, সকলকে নিয়ে ভারতের ভাবনা থেকেই এই দেশকে দেখবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy