স্বাধীনতার কিছু পর থেকে দেশের অন্য জলধারাসমূহের মতো এই ধারাটিরও ভুল ব্যবহার শুরু হয়। ফাইল চিত্র।
পঁচিশশো পঁচিশ কিলোমিটার লম্বা একটা আস্ত গঙ্গা মজুত থাকার পর আবার পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ কিলোমিটার লম্বা একটা আদিগঙ্গা কেন, এটা একটা প্রশ্ন হতেই পারে। এবং অধিকাংশ প্রশ্নের মতোই এরও থাকতে পারে একাধিক উত্তর। এমনকি দুই গঙ্গার মধ্যে কে বয়সে বড়, কে কার চেয়ে পরে এসেছে, সে প্রশ্নও উঠতে পারে। নামকরণের কারণ যা-ই হোক না কেন, খিদিরপুরে দইঘাটের কাছ থেকে বাঁ দিকে ঢুকে পড়ে আলিপুর ব্রিজের তলা দিয়ে, মেট্রো রেলের লাইন ধরে আজকের কামালগাজি হয়ে বারুইপুর শাসন কীর্তনখোলা, সূর্যপুরের খাল পেরিয়ে ঢোসার খাল অবধি দেখতে পাওয়া এই শাখানদীটির গুরুত্ব যে এই ভূভাগে বহুকাল ধরেই যথেষ্ট, তাতে কোনও দ্বিমত থাকতে পারে না। এক সময়ে এর তীরবর্তী অনেকখানি জায়গা যখন সুন্দরবনের অন্তর্গত ছিল, তার অন্যতম সেচখাল এবং নিকাশিপথ ছিল এই নদী। ছিল গড়িয়া সোনারপুর বারুইপুর শাসন কীর্তনখোলা জয়নগরের মতো কৃষিসম্পন্ন জনপদের অস্তিত্বের শর্ত। অনেকের মতে এক কালে এটিই ছিল গঙ্গানদীর আদি গমনপথ। স্বাভাবিক প্রয়োজনেই এই কৃষিসমৃদ্ধ জনপদগুলির পুরনো হাটবাজারে জিনিসপত্র নিয়মিত যাতায়াত করত ছোট বড় নৌকার সাহায্যে। এই নদী-তীরবর্তী এলাকার সামাজিক গুরুত্বও কম নয়। শহর কলকাতার চেয়ে বেশ পুরনো কালীঘাট মন্দিরের গা বেয়ে আসাই কেবল নয়, বিপ্রদাস পিপলাইয়ের মনসামঙ্গল কাব্য অনুযায়ী এটাই ছিল চাঁদ সদাগরের সাগরযাত্রার বাণিজ্যপথ। সাতশো বছর আগে এ নদীর কূল ধরে নীলাচলে যাত্রা করেছিলেন জাতিভেদবিরোধী তরুণ সন্ন্যাসী সশিষ্য শ্রীচৈতন্য। নদীঘাটে বসেছিলেন পথশ্রান্ত বৈষ্ণবরা, জায়গার নাম তাই বৈষ্ণবঘাটা। সেখান থেকে কত দূর আজ নদীঘাট। তবু আজও নদীর কূলে রয়েছে কীর্তনখোলা।
পরবর্তী সময়ে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও ব্যবসাবাণিজ্যের কারণে এই নদীপথ জরুরি ও সুবিধাজনক বলে মনে করে। ফলে ছোটবড় নৌকা বজরা ব্যবহারের জন্য প্রতি দিনের জোয়ারে বালিপলিতে মজে আসা এই শাখানদীটির খাত গভীর করে খুঁড়ে নেওয়ার দরকার হয়। এ কাজ আগে পর্তুগিজরাও করেছিলেন। শেষ উল্লেখযোগ্য কাজ করেন উইলিয়াম টলি। ১৭৭২ থেকে ১৭৭৭ সাল অবধি এই নদীকে, যা তত দিনে মাথার দিকটি বন্ধ হয়ে প্রায় একটা বড় খালের চেহারা নিয়েছে, গভীর করে খুঁড়ে ও সংস্কার করে তিনি একে নতুন নৌজীবন দেন। ফলত যত দূর খনন ওই নদীখাতের মধ্যে হয়েছিল, তার নাম হয়ে যায় ‘টলির নালা’। এই সংস্কারের পিছনে ছিল তৎকালীন শাসকদের বাণিজ্যবুদ্ধি। কলকাতা শহর যথেষ্ট আগ্রাসী বিস্তার লাভ করার আগে পর্যন্ত তার দক্ষিণ-পূর্বের ওই সব জায়গা থেকে ক্রমবর্ধমান শহর ও সেনা ছাউনির জন্য খাদ্য-সহ অন্যান্য সামগ্রী আমদানি করতে হত। বাণিজ্যবস্তুও থাকত তার মধ্যে। তা ছাড়া, কলকাতার উত্তর ও দক্ষিণের অন্য নদী ও খালগুলোর মতো আদিগঙ্গাও ছিল বড় হয়ে উঠতে থাকা নিয়মিত বর্ষাকালের এই শহরের প্রাকৃতিক নিকাশিব্যবস্থা। সে বিষয়ে ইংরেজরা অবহিত ছিলেন।
জলপথই তখন সবচেয়ে নিরাপদ ও সুবিধাজনক উপায়। ১৯৫০-এর দশক পর্যন্ত সেই পথই সহজ ছিল। এ দেশের ইংরেজ শাসকরা এই নদীর নাব্যতা বজায় রাখতে ও প্রয়োজনমতো বাড়াতে সচেষ্ট হন।
স্বাধীনতার কিছু পর থেকে দেশের অন্য জলধারাসমূহের মতো এই ধারাটিরও ভুল ব্যবহার শুরু হয়। যেই প্রাচীন জলধারা শহরাঞ্চলের সমস্ত জল নিয়ে সুন্দরবন দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ত, দীর্ঘ অবহেলায় ক্রমশ স্রোত হারিয়ে তা বদ্ধজলের দূষিত আধার। তবু তার প্রাণ ছিল। ২০০২ সাল পর্যন্ত জোয়ারের জল ঢুকত। রাসবিহারী মোড়ে অমাবস্যায় রাস্তাডোবানো জল এখনও অনেকেরই স্মৃতিতে জীবন্ত। কিন্তু প্রতি দিন জোয়ারের সঙ্গে আসা বিপুল বালির যে স্তূপ নদীখাতকে ভরে দিচ্ছিল তা সরাবার স্রোতক্ষমতা বহুকাল ধরেই নদীর আর ছিল না, নদীর স্বাভাবিক গতিপথ ব্যাহত হওয়ায়। দু’পাশে অপরিকল্পিত নগরায়ণ, নদীর মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়া, মূল গঙ্গার জলে বালি অপসারণের জোর না থাকা।
আদিগঙ্গার স্রোতবিহীন জলধারাকে অবরুদ্ধ করার কাজটি সম্পূর্ণ হয় কলকাতা মেট্রোর টালিগঞ্জ পরবর্তী মাটির উপর দিয়ে যাওয়ার অংশ তৈরির সময়। অসংখ্য পরিবেশকর্মী, ভূতত্ত্ববিদ, সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে বসবাসকারী এবং সাধারণ লোকজনের বার বার আপত্তি সত্ত্বেও এই দুর্বল কিন্তু জীবন্ত নদীটির বাঁধিয়ে ফেলা খাতের মধ্যে গেঁথে দেওয়া হয় ৩০০টি কংক্রিট স্তম্ভ। সে সব স্তম্ভ হয়ে দাঁড়ায় জলে ভেসে আসা মাটি ও যাবতীয় কঠিন বর্জ্যের সংগ্রহশালা। আগে থেকেই এলাকার সমস্ত পূর্ত তরল বর্জ্য ঢালা হত এই নদীতেই। বর্তমানে শুধু পুর আবর্জনার পাহাড় নয়, অবশিষ্ট খাতটির মধ্যে বসানো হচ্ছে বিশাল প্রস্থের পানীয়জলের পাইপ— কে জানে কোনখানে যাচ্ছে তা। ফলে নদীপূজা ও আরতির দেশে একটি ক্ষীণপ্রাণ নদী দম আটকে মরে যায়। ত্রৈলোক্যনাথ বলেছিলেন “ভূত মরিলে মার্বেল হয়।” আমরা জানি, নদী মরলে দুর্গন্ধ নালা হয়।
গত ২১ নভেম্বর তিন তরুণ নদীসন্ধানীর সঙ্গে সেই মৃত আদিগঙ্গার খাত খুঁজতে গিয়ে এক আশ্চর্য সাক্ষ্য পাওয়া গেল। মেট্রোর কুঁদঘাট অঞ্চলের স্টেশনের পর গড়িয়া বাজারে আদিগঙ্গার কোনও চিহ্ন দেখা যায় না। নদী যেন ওখানে ছিলই না! এখান থেকে কোথায় গেল জলের ধারাটি এ প্রশ্ন আগ্রহী নদীসন্তানদের বিভ্রান্ত করেছে বহু দিন। সে দিন ওই কাছাকাছি জায়গায় কাঁধে-ক্যামেরা লোকদের দেখেই হয়তো স্থানীয় কয়েক জন জিজ্ঞেস করেন যে তাঁরা কী খুঁজছেন। উত্তর শুনে বলেন, এই তো নদী। এই যেখানে আপনারা দাঁড়িয়ে আছেন, এখানেই নদী ছিল, ওই যে ঝোলানো পুলের রশি। গোলপোস্টের মতো আকারের ফুট বিশেক উঁচু একটা কাঠামো থেকে ঝুলে থাকা মোটা লোহার ‘দোলা’ শূন্যে ঝুলন্ত হয়ে এক লুপ্ত নদীর সাক্ষ্য দিচ্ছিল। নবাগতরা তার সামনে খানিক বিহ্বল আর স্থানীয় মহিলাপুরুষরা অনর্গল বলে যান অষ্টআশি সালের আগে পর্যন্ত ওইখানে জোয়ার-ভাটা খেলা একটি জ্যান্ত নদীর কথা। “এখানে পর্যন্ত বড় বড় নৌকা আসত। মাটির হাঁড়িকলসি এই এতখানি উঁচু বিচালি নিয়ে। এখানেও এক বিচালিঘাট ছিল। ষাঁড়াষাঁড়ির জোয়ারে গড়িয়ার হাট অবধি জল উঠে যেত। হাটের গায়েই ঘাট ছিল। হ্যাঁ, ষাঁড়াষাঁড়ির বানে আমাদের ঘরে জল ঢুকত। মাছ আসত এই বড় বড়। জল আবার নেমে যেত দু’দিনে।” বর্তমানে সেখানে মাটি ভরাট করে গড়ে ওঠা পাকা রাস্তা, আস্ত একটি পাড়া। প্রধানত আশির দশকে সরকারি সৌজন্যে। অবশিষ্ট জল মাটির নীচে পাতা নর্দমার পাইপ দিয়ে পার করা হয়েছে। স্বভবতই কামালগাজির কাছে কবর থেকে বেরিয়ে আসে দু’পাশ থেকে টুঁটি টিপে ধরা একটি নর্দমা। মশার বাথান। কিন্তু তবু প্রাণ আছে তার। সেই জলের বিভ্রমেও নড়াচড়া করছে জীবন্ত পোকা। শিকার ধরছে ছোট জলচর পাখি। ঘষটে চলা ধারার ধুঁকতে থাকা প্রাণ। সূর্যপুরের খালে যখন সে মিশছে তখন আবার এক ক্ষীণ স্রোতস্বিনী।
এক সময় এই ধারাটি পথ ছিল। আজ পথের জন্য তাকে নষ্ট করা হয়েছে। স্বাভাবিক জলধারা পরিবহণ ছাড়াও বহু কাজ করে দিত প্রকৃতির স্বাভাবিক শৃঙ্খলায়। তার সঙ্গে যুক্ত ছিল কেবল কলকাতার নিকাশি নয়, সুন্দরবনেরও সুরক্ষা। তার সেই স্ব-ভাব নষ্ট হওয়ার দায় ও জটিলতার সমাধান আজ আমাদের অসাধ্য। একটানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কেষ্টপুর খাল, বাগজোলা খাল, বেলেঘাটা খাল, চড়িয়াল খাল, যার প্রতিটি যুক্ত ছিল অন্য কোনও নদীর সঙ্গে। ভুললে চলে না যে, এ শহরের পশ্চিম দিক ঘেঁষে বড় নদীটি থাকলেও শহরের স্বাভাবিক ঢাল কিন্তু নদীর দিকে নয়, বিপরীতে, সমুদ্রের দিকে। কিংবা বলা যায়, পূর্ব জলাভূমির দিকে। অথচ সে দিকে জল গড়িয়ে যাওয়ার সব ক’টি স্বাভাবিক পথ রুদ্ধ হয়েছে নির্মাণের দাপটে।
কোনটা তবে আমাদের প্রাথমিকতা? পথ না গাড়ি? সুস্থতা না নির্মাণ? শহরের নানা অংশ দিয়ে বয়ে যাওয়া জলধারা হতে পারত শহরের সম্পদ, তাদের সংহার করে বিস্মৃতিময় নতুন ভূদৃশ্য নির্মাণ? না কি মৃত জলধারাময়, প্রতি বছরের বর্ষণ-অভিশপ্ত এক প্রকাণ্ড বদ্ধ জলা, যার নাম কলকাতা শহর?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy