একাকী: মিলান কুন্দেরা, বেছে নিয়েছিলেন নিভৃত যাপন। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস।
এই পৃথিবী তাঁর মৃত্যুর আগে বা পরে তাঁকে নিয়ে খুব হইচই করল কি না, সে খবরে মিলান কুন্দেরার কোনও আগ্রহ ছিল না। চিন্তার আকাল আর গণমাধ্যমের অর্বাচীন বিস্ফোরণের মাঝে ক্রমাগত একা হয়ে পড়া, বাতিল হয়ে যাওয়াই এক নিশ্চিত ভবিতব্য, বুঝে নিয়েছিলেন তিনি।
কুন্দেরা যে ছিলেন, আমাদের মাঝেই ছিলেন, সে কথা আমরা মনে করিনি বহু দিন। এক রকম বাতিল করে দিয়েছিলাম তাঁকে। তবে এই বাতিল হয়ে যাওয়ার ভিতরে মনে হয় একটা অপূর্ব ঠাট্টা লুকিয়ে রেখেছিলেন কুন্দেরা। কেউ বাতিল করার আগে নিজেই বাতিল হয়ে গিয়েছিলেন। ঢুকে গিয়েছিলেন নিশ্চিন্ত, নিঃশব্দ মননের আধারে। কিছু কিছু চেনা মানুষের কাছে কখনওসখনও মেলে ধরেছেন নিজের চিন্তা, দিয়েছেন সাক্ষাৎকার, ভাগ করে নিয়েছেন নিজের দার্শনিক প্রজ্ঞা। কিন্তু ক্রমাগত যেন আমাদের প্রতি দিনের জগৎ থেকে সরে-সরে গিয়েছেন কুন্দেরা। আচমকাই ওঁর মৃত্যুর খবরে খেয়াল হল যে, কুন্দেরা জীবিত ছিলেন।
তিনি নিজেই আমাদের তা টের পেতে দিচ্ছিলেন না। বহু বছর ধরে তিল-তিল করে নিজের এই নিস্তব্ধতা গড়ে নিয়েছেন কুন্দেরা। দেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছেন, আবার কখনও রাষ্ট্র তাঁর অস্তিত্ব স্বীকার করেছে, অনুমতি দিয়েছে দেশে ফিরে আসার। দেশ, অথবা শিকড়ের টান জটিল, অন্তর্ভেদী টানাপড়েনের আকর। কুন্দেরা তাঁর দেশে ফিরেছেন কখনওসখনও। থাকেননি বেশি দিন। রয়ে যাননি। তীব্র আকাঙ্ক্ষা উপেক্ষা করে ফিরে গিয়েছেন আবার তাঁর নতুন দেশ ফ্রান্সে। তবু, এই যাওয়া-আসা নিয়ে কোনও ঘোষণা ছিল না। সংবাদমাধ্যমে হইচই ছিল না। বেশির ভাগ সময়ে তাঁর এই যাতায়াত টের পর্যন্ত পাননি কেউ। অনুমান করতে পারি হয়তো ফিরে গিয়ে নিজের পরিচিত রাস্তায় হেঁটেছেন কয়েক বার, চেনা রঙের কোনও দরজায় করাঘাত করবেন কি না এই নিয়ে ভেবেছেন খানিক, হয়তো চুপ করে খানিক বসেছেন কোনও পার্কের বেঞ্চিতে। চিন্তা করেছেন নিজের মতো, নিজের দেশ, নিজের শহরকে ফিরে দেখেছেন আরও এক বার।
অথচ দেশ ছেড়ে ফ্রান্সে চলে যাওয়া, নিজের ভাষা ত্যাগ করে ফরাসি ভাষায় লেখা, ফরাসি নাগরিকত্ব স্বীকার করা, এর ভিতর কোনও তীব্র অভিমান আছে এ কথা ভেবে নিলে বুঝি ভুল হবে। বরং নিজের মধ্যে চলতে থাকা দার্শনিক সংলাপকেই বার বার ঝালিয়ে নিচ্ছিলেন বোধ হয়। এদমুন্দ হুসের্লের নিবিষ্ট পাঠক কুন্দেরা। আমাদের সমাজজীবন যে প্রতি দিন অল্প অল্প করে একটা রাজনৈতিক বয়ানে পরিণত হচ্ছে ক্রমাগত এই উপলব্ধি তাড়া করে ফিরেছে কুন্দেরাকে। প্রতিনিয়ত হ্রাসপ্রাপ্তির এই যাপনকে লক্ষ করছিলেন কুন্দেরা। লিখছেন, “মানুষ বুঝি বা ক্রমহ্রাসমানতার একটা ঘূর্ণিতে আবদ্ধ হয়ে গিয়েছে, যেখানে হুসের্ল বর্ণিত ‘যাপনবিশ্ব’ (ওয়ার্ল্ড অব লাইফ) দারুণ অস্ফুট এবং সত্তা সম্পূর্ণ বিস্মৃত।”
রাজনীতির সঙ্গে এক সময় ওতপ্রোত সম্পর্ক ছিল তাঁর। কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য। বামপন্থী কবিতা লিখেছেন সে সময়। তার পর ক্রমাগত বিদ্রোহ, পার্টি থেকে দু’বার বিতাড়িত। ১৯৬৮-র ‘প্রাগ স্প্রিং’— সোভিয়েট রাষ্ট্রযন্ত্রের দমনের বিরুদ্ধতা করা এক বিকল্প দেশীয় বামপন্থী বিদ্রোহ। এই সবের মধ্যে থেকে ভেবেছিলেন বুঝি চেকোস্লোভাকিয়া একটা ভিন্নতর সাম্যবাদী সামাজিক বিপ্লবের দিকে যাবে। সেই ভুল ভেঙেছে অচিরেই। দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে তাঁকেই। স্বপ্নভঙ্গের নিশ্চিত চেতনা থেকেই বুঝি সমাজজীবন থেকে তাঁর ক্রমাগত বিযুক্তি।
এই সময়ে দাঁড়িয়ে মনে হয় কুন্দেরার উপলব্ধি আমাদের আরও একটু বিস্তারে বোঝা প্রয়োজন। সমাজের কেন্দ্রে রয়েছে মানুষ, মানুষকে উপলক্ষ করেই তার চার পাশে গড়ে ওঠে সমাজ নামের প্রক্রিয়া। অথচ, ভেবে দেখা প্রয়োজন এই যে মানুষ সামাজিক হয়ে ওঠার আগে থেকেই সে সাত্ত্বিক। হাইডেগার বর্ণিত ‘ডাজ়াইন’ যা মানুষকে বিশ্বের নিরিখে তার আত্মের সঙ্গে পরিচয় করায়, আধুনিক সমাজ যেন ক্রমশ এই সাত্ত্বিকতা অথবা ‘বিয়িংনেস’-কে অস্বীকার করে চলেছে। আধুনিকতা চেয়েছে সব প্রশ্নের চটজলদি উত্তর, কয়েকটা ফর্মুলা বা সূত্র যার মাধ্যমে বুঝে নেওয়া যাবে এই বিশ্বের সমস্ত আয়োজন। আধুনিকতার আবর্তে দর্শনের নির্লিপ্তিকে খানিক দিশাহারা হতে দেখেন কুন্দেরা। সমস্ত প্রশ্নের তাৎক্ষণিক উত্তর, সব অন্বেষণের চটজলদি সমাধান, আর এই সব সমাধানের ঝুলি হাতে গণমাধ্যমের ক্রমাগত বিস্ফোরণ হতাশ করে কুন্দেরাকে। সত্তা বিষয়ে তলিয়ে চিন্তা করা, হুসের্ল বর্ণিত সেই ‘ওয়ার্ল্ড অব লাইফ’ বা যাপনবিশ্বকে প্রতি দিন একান্তে অনুভব করা যে একটা অভ্যাস, কুন্দেরার এই প্রতীতি ধাক্কা খায় নিয়ত, আর তিনি আরও খানিক গুটিয়ে যেতে থাকেন নিজের ভিতরে। তাঁর তাত্ত্বিক লেখায় কুন্দেরা তাঁর পাঠককে ধরিয়ে দেন যে সাহিত্যের অথবা আখ্যানের বেঁচে থাকা প্রয়োজন শুধুমাত্র মানুষকে তার সত্তাকে ভুলে যাওয়ার থেকে রক্ষা করতে। মানুষের সঙ্গে আখ্যানের দেখা হয় নিভৃতে, একের সঙ্গে এক, এই নিবিড়তার ভিতরেই রয়েছে জীবনবোধের আকর। এই যোগাযোগ না ঘটলে মানুষের সত্তার বোধ লোপ পায়, প্রত্যেকে ক্রমাগত হয়ে ওঠে একে অপরের মতো, একই রকম চিন্তা করে, একই কাজ করে, একই খাবার খায়, একই বই পড়ে, একই বুলি আওড়ায়! ডানে আর বামে কোনও তফাত করা দুষ্কর হয়ে ওঠে। আমেরিকা মিশে যায় ইউরোপে। মানুষে মানুষে চিন্তার, প্রতীতির, বিশ্বাসের তফাত করা যায় না আর, সত্তার সঙ্গে তার নিজস্ব, একান্ত, স্বকীয় পৃথিবীর একটা বিচ্ছিন্নতা তৈরি হতে থাকে ক্রমাগত।
খানিক তলিয়ে ভাবলে বোঝা যায় কুন্দেরার লেখার ভিতরে রয়েছে এক ধরনের নিষ্ফল বিষণ্ণতা। খেদ আর যন্ত্রণার ‘ইমপ্লোশন’ বা আন্তরিক বিস্ফোরণ। আধুনিকতার কাঠামোয় সমস্ত প্রশ্নের নিশ্চিত উত্তর খুঁজে নেওয়ার, অথবা সমস্তটা জেনে ফেলার ফলপ্রসূ সমাপ্তির বিরুদ্ধতা করেন কুন্দেরা। বার বার ফিরে যান দান্তে, বোকাচ্চিও অথবা সেরভান্তেসের কাছে। তাঁর পাঠককে মনে করিয়ে দেন কী ভাবে এঁদের সকলের কাছে একটাই মূল প্রশ্ন ছিল: সত্তা কী? সত্তাকে বোঝার চেষ্টা করবই বা কী ভাবে? কিন্তু এই প্রশ্নের কোনও নিশ্চিত একমাত্রিক উত্তর এঁরা খোঁজেননি, অথবা বলে দিয়ে যাননি। সত্তার শুরু আর শেষ কোথায়? কুন্দেরা নিজেই একটি সাক্ষাৎকারে এর উত্তর দিচ্ছেন: “আত্মার অনন্ত অপরিমেয়তায় অবাক হোয়ো না, বরং নিজের সত্তার অনিশ্চিত চরিত্র এবং তার পরিচয়ে অবাক হতে পারো।”
ভেবে দেখি যে এই ‘মেকানিক্যাল রিপ্রোডাকশন’ বা যান্ত্রিক প্রজননের বিশ্বব্যাপী আয়োজনে কুন্দেরা সমাজবিমুখ হয়েছিলেন নিশ্চিত, কিন্তু আত্মবিমুখ হয়ে যাননি মুহূর্তের জন্যও। সত্তার ক্রমাগত অন্বেষণের কথা লিখে গিয়েছেন, লিখে গিয়েছেন ‘মেডিটেটিভ ইন্টারোগেশন’ বা ধ্যানমগ্ন আত্মজিজ্ঞাসার কথা। এই প্রশ্ন নিশ্চিত ভাবেই আধুনিকতারও প্রশ্ন, সন্দেহ নেই। নিজের অস্তিবাদী চেতনাকে খুঁচিয়ে তোলাই এর উদ্দেশ্য। নিবিষ্ট হয়ে কাফকা পড়তে বলছেন আমাদের। এই ভাবে ‘এগজ়িসটেনশিয়াল’ আর ‘ফেনোমেনাল’-এর মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করার কথা বলছেন। নিজের দায়িত্ব থেকে বিচ্যুত হচ্ছেন না কুন্দেরা মুহূর্তের জন্যও, সমাজজীবন সম্বন্ধে তীব্র দার্শনিক বিরাগ সত্ত্বেও তাঁর পাঠককে প্রায় হাত ধরে বুঝিয়ে দিচ্ছেন তাঁর চিন্তার নির্যাস। আদত সম্পর্কটা আসলে মানুষের সঙ্গে তার জগতের। এতে না আছে সমাজ, না আছে রাজনীতি। বলছেন মানুষের সঙ্গে তার জগতের সম্পর্ক বিষয়ী আর বিষয়ের সম্পর্ক নয়, অর্থাৎ চোখ আর ক্যানভাসের সম্পর্ক, অথবা অভিনেতা আর মঞ্চের সম্পর্কের মতো নয়। মানুষ আর তার জগতের সম্পর্ক আসলে শামুক আর খোলের সম্পর্ক। সম্পৃক্ত। অবিচ্ছিন্ন। কুন্দেরা বলছেন, “দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ় পার্ট অব ম্যান, ইট ইজ় হিজ় ডাইমেনশন।”
তাঁর দি আনবেয়ারেবল লাইটনেস অব বিয়িং উপন্যাসে এক জায়গায় কুন্দেরা লেখেন, মানুষ যেখানে নিরানন্দ হয়ে বাঁচে সে জায়গা থেকে সে সরতে চায়, বেরোতে চায় সমানেই। এই কথা হয়তো তাঁর আত্মজীবনীর অংশ হিসাবে পড়া চলে। প্রায় গোটা জীবন ধরেই সরে-সরে এসেছেন তিনি। কমিউনিস্ট পার্টি থেকে সরে এসেছেন, অসমাপ্ত বিপ্লব ছেড়ে চলে গিয়েছেন অন্য দেশে, জন্মাবধি অন্তরঙ্গ দেশ, শহর, ঘরবাড়ি, সব ছেড়েছেন। এক সময় ছেড়ে দিয়েছেন নিজের মাতৃভাষা। এই সব ছেড়ে দেওয়ার ভিতরে কিন্তু নির্লিপ্তি আর দুঃখবোধ একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি হয়ে রয়ে গিয়েছে। শেষ বিচারে মনে হয় হয়তো তাঁর চার পাশের পৃথিবীর সঙ্গে কোনও ভাবেই মানিয়ে নিতে পারেননি লেখক। তাই তাঁকে ঘিরে কোনও সমারোহের সম্ভাবনাও এড়িয়ে গিয়েছেন সন্তর্পণে: “বিস্মৃত হওয়ার আগে আমরা এক ধরনের স্থূল গতানুগতিকতায় পরিণত হব। এই গতানুগতিকতা আসলে সত্তা আর বিস্মৃতির মাঝের বিরতির পরিসর মাত্র।”
কোলাহল আর সমারোহের দ্বিচারিতার বদলে এই অসাধারণ লেখক বেছে নিয়েছিলেন নিভৃত যাপন। এও হয়তো আমাদের আধুনিকতার এক অমোঘ পরিণতি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy