—প্রতীকী ছবি।
একটি শিশু তার ভালবাসার মানুষদের ক্রমান্বয়ে সাজাচ্ছিল। শূন্য থেকে শুরু। তার পর ১, ২, ৩ ইত্যাদি। যাকে সে সব থেকে বেশি ভালবাসে, তার ড্রয়িং ম্যাম, তাকে সে দিল শূন্য। ‘শূন্য কী রে, শূন্য মানে তো কিছু নেই। নাথিং।’ মায়ের কথা শুনে শিশুটি বলল, “না, শূন্য সবচেয়ে বড় সংখ্যা। এটা সবচেয়ে বড়। তাই ড্রইং ম্যাম শূন্য, তার পর বাকিরা।”
পাঁচ বছরের শিশু না জানে দর্শন, না জানে গাণিতিক শূন্যের উৎস, ‘শূন্যতাই জানো শুধু? শূন্যের ভিতরে এত ঢেউ আছে সেকথা জানো না?’ (শঙ্খ ঘোষ) পড়ার বয়সই তার এখনও হয়নি।
তা হলে কেন তার কাছে শূন্য সবচেয়ে বৃহৎ? অনেক জায়গা নিয়ে একটি বৃত্ত সে আঁকে বলে? সে কি মনে করে ওই বৃত্তের মধ্যে যে অনেকটা ফাঁকা জায়গা, তাতে অনেক কিছু ভরে দেওয়া যায়। ২, ৩, ৪, ৫— কোথাও তো সেই পূর্ণ করার অবকাশ নেই। স্কুলে আঁকার ক্লাসে রংবেরঙের পেনসিল দিয়ে খাতায় গোল আঁকতে বলা হত আমাদের, সে তো আসলে শূন্যই। নানা রঙের শূন্য, সকলে চেষ্টা করত যাতে ঠিকঠাক বৃত্তটি হয়। পাতায় পাতায় একের পর এক শূন্য, ছোট, বড়, মাঝারি। দিদিমণিরা কি শুধু হাত পাকানোর জন্য গোল আঁকাতেন নানা রঙের, না কি এখন পিছন ফিরে দেখি, অবচেতনে শূন্যের একটা ধারণা, শূন্য আঁকার স্বাধীনতা ঢুকে যাচ্ছিল সেই সময়ে (পরীক্ষার খাতায় যা পাওয়ার অধিকার শিশুর থাকে না, যদিও সে পায়)।
শূন্য আঁকার স্বাধীনতা। শূন্য পাওয়ার অধিকার, স্বাধীনতা। সেটাই তো সূচনা হওয়া উচিত। কারণ, সত্যি তো, কত সম্ভাবনা লুকিয়ে থাকে শূন্যের মধ্যে। আমরা বলি শূন্য থেকে শুরু, কারও সাফল্য বোঝাতে। না খেতে পাওয়া এক শিশু, অনাথ আশ্রমে বেড়ে ওঠা শিশু যখন সফল হয় জীবনে, তার সমস্ত লড়াই, না খেতে পাওয়া, বড় হওয়া, ধাক্কা খাওয়া সমস্তই কি জমে থাকে না ওই শূন্যের ভিতরে, যা অনন্ত, যা বাড়তে থাকে জীবনের সঙ্গে।
আবার কাজী নজরুল ইসলাম যখন লিখেছেন, ‘শূন্য এ-বুকে পাখি মোর আয় ফিরে আয় ফিরে আয়’, সে এক ভয়াবহ শূন্যতার হাহাকার। যাঁর হয়, শুধু তিনিই জানেন। কিন্তু সেই শূন্যতার মধ্যেও ধীরে ধীরে জমতে থাকে অকালপ্রয়াত পুত্রের স্মৃতি, তার সঙ্গে কল্পিত কথোপকথন, তাকে জড়িয়ে ধরা বুকে। কোথাও মিলে যায় শমী-হারা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপলব্ধি— ‘‘জ্যোৎস্নায় আকাশ ভেসে যাচ্ছে, কোথাও কিছু কম পড়েছে তার লক্ষণ নেই। মন বললে, কম পড়েনি, সমস্তর মধ্যেই সবই রয়ে গেছে!’’
বেশ কিছু কাল ধরেই সমাজমাধ্যমে ঘুরে বেড়ায় চার্লস বুকোস্কির কবিতাটি, ‘দেয়ার ইজ় আ প্লেস ইন দ্য হার্ট,/ দ্যাট/ উইল নেভার বি ফিলড/ অ্যান্ড/ উই উইল ওয়েট/ অ্যান্ড ওয়েট/ ইন দ্যাট স্পেস।’
হৃদয়ের শূন্যস্থানে আমরা চিরকাল সেই মানুষটির জন্য অপেক্ষা করব, আমরা জানি সেই শূন্যস্থান কোনও দিন পূর্ণ হবে না। কিন্তু এই যে কবি বলছেন শূন্যের মধ্যে একটা জায়গার কথা, একটা স্পেস-এর কথা, সেটাও কি ভরে নেই অপেক্ষায়?
বিষাদের, মৃত্যুর সেই বিশাল গহ্বর, সেই শূন্য, সেই শূন্যতা শুধু মানসিক ভাবেই নয় শারীরিক ভাবেও আমরা যারা অনুভব করি প্রতি মুহূর্তে, তাও তিলে তিলে জমে ওঠে অপেক্ষায়, কল্পনায়, শোকে, বেদনায়। এ এক অসীম গহ্বর যাতে হাত ঢোকলে রক্তাক্ত হবে, হয়তো শুধু অন্ধকার আর সর্বগ্রাসী একা হাওয়ার ডাক। পূর্ণিমার চাঁদও এক বৃহৎ শূন্য, কী অসীম সম্ভাবনা, কল্পনায় ভরন্ত, এক পিঠ দৃশ্যমান ও আলোকোজ্জ্বল। অন্য দিকটি দর্শনের বাইরে, রহস্যময়। খিদের মুখে তাই সে ‘ঝলসানো রুটি’, আর একটি পরিচিত এবং বৃহৎ শূন্য।
আর এ কালে জয়াশিস ঘোষ লিখেছেন ‘বিয়োগ’ কবিতাটি
‘আমাদের বাড়িতে যেদিন ভাত হত না,/ গান হত উঠোনে মাদুর পেতে/ লেবুফুলের গন্ধে অখিলবন্ধু মেখে/ একটা একটা করে গরাস মুখে দিতেন মা/ ঠিক সেদিনই পাশের বাড়িতে মাংস রান্না হত,/ মা শেখাতেন/ বিয়োগের আশ্চর্য রূপকথা/ কম পড়লে শূন্য থেকে এক টেনে নিতে হয়।’
শিশু তাই ঠিকই বলে, শূন্য সবচেয়ে বড় সংখ্যা, তার সবচেয়ে ভালবাসার মানুষকে সে তাই শূন্য দেয়, কারণ সে ‘উইনার’। শিশু ঠিকই বলে। কারণ, অসীম সেই শূন্যের সম্ভাবনা, সীমাহীন তার শোক। সে সব মেটাতে পারে কল্পনায়, সে গিলে খেতে পারে শোক, ক্ষুধা। তোমার ইচ্ছেমতো তার পরিধি তুমি বাড়িয়ে দাও, ভরে দাও প্রাপ্তিতে, বা বেদনায়, শোকে। তবু সে পূর্ণ হবে না। শূন্য বলেই তো তার পূর্ণতার আকাঙ্ক্ষা অসীম। মতি নন্দী তাঁর অপরাজিত আনন্দ উপন্যাসে কি এই শূন্যতাকেই কল্পনায় ভরে দেননি? যেখানে পক্ষাঘাতগ্রস্ত ও মৃত্যুপথযাত্রী কিশোর আনন্দ ভাবছিল— বিছানায় শুয়ে একটার পর একটা খেলা সে খেলে যাবে চিরকাল, শেষ সুযোগ সব সময় থাকবে তার কাছে, সারা পৃথিবী সব সময় অনন্ত অপেক্ষা করবে রোজ়ওয়ালের সঙ্গে তার ম্যাচটা দেখার জন্য। তার শেষ নেই। তা অনন্ত।
শূন্য বলেই সে ভালবাসার সমার্থক বা ভালবাসা শূন্যতার। বিরহের। সে শূন্য বলেই সে অসীম। মিলনের পূর্ণতা বা পূর্ণতায় শেষ তার ভবিতব্য নয়, যে চিরবিরহে বাস করে, সে জানে এ অসীম, এ কোনও দিন ফুরোবে না। সে দুঃখ পাবে, ক্ষত গভীর হবে, আরও বড় হবে, এক দিন হয়তো সহ্য হয়ে যাবে, আর বুঝতে পারবে সেই ক্ষত কত বিশাল হয়ে, তাকে পূর্ণ করে চলেছে, প্রত্যাশা নেই বলে সে নিজের মতো বিকশিত— স্মৃতিতে, কল্পনায়, ভালবাসায়, দুঃখে।
লন টেনিসে শূন্যকে কেন ‘লাভ’ বলা হয় (ফিফটিন-জ়িরো নয়, ফিফটিন লাভ), তা নিয়ে মেরিয়াম-ওয়েবস্টার অভিধানে যে অপেক্ষাকৃত গ্রহণযোগ্য তত্ত্ব দেওয়া রয়েছে, তা হল: মানুষ খেলে ভালবাসার জন্য, খেলাটাকে ভালবেসে, তাই এক মুহূর্তে সে শূন্য পেতেই পারে অর্থাৎ কোনও পয়েন্ট না-ই পেতে পারে, তবু সে খেলবে, সে এগোবে, সে একটা গেম না নিতে পারলেও আবার খেলবে। তাই জ়িরো এখানে ‘লাভ’। ‘বুরুন, তুমি অঙ্কে তেরো’ বলে তাকে দাগিয়ে দেওয়ার কোনও দরকার নেই। অভিধানে এ-ও লেখা রয়েছে, লন টেনিসের আগেও অষ্টাদশ শতাব্দীতে তাস খেলা প্রসঙ্গে একটি লেখায় ‘লাভ’ শব্দের ব্যবহার দেখা যায় এই একই অর্থে।
অভিধান এ-ও লিখছে, আনুষ্ঠানিক ব্যবহারের আগে, বহু আগেই নিশ্চয় মানুষ তার স্বাভাবিক অনুভূতিতেই ভালবেসে খেলেছিল, বুঝেছিল ভালবাসা ভালবাসাই, সে ‘নাথিং’ হলেও ভালবাসা।
কিন্তু ভালবাসাকে ‘নাথিং’ ভেবেছিল কে?
সে কি জানিত না, ‘কাল ছিল ডাল খালি, আজ ফুলে যায় ভ’রে’!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy