—ফাইল চিত্র।
সেই যখন দুই তলার বেশি উঁচু সিলিংওয়ালা বিরাট হলঘরে ন্যাশনাল লাইব্রেরির রিডিং রুম ছিল, আর ছিল পুরনো কালো কাঠের টেবিল চেয়ার খাতা ডট পেন গম্ভীর বই, পরমেশ্বরন থাঙ্কাপ্পান নায়ারকে দেখা যেত একটা নির্দিষ্ট টেবিলে বসে আছেন। দীর্ঘ সময় ধরে কলকাতা বিষয়ে থাঙ্কাপ্পান নায়ার চল্লিশটির উপর আকর-গ্রন্থ লেখেন।
অনেক দিন পর যখন প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডে হাঁটতে নামলাম, আবিষ্কার করলাম যে, আনোয়ার শাহ টিপু সুলতানের পরিবারের আর টিপুর কনিষ্ঠ ছেলে গোলাম মহম্মদ শাহ ধর্মতলায় শাহি টিপু সুলতান মসজিদ আর টালিগঞ্জে শহিদ টিপু সুলতান মসজিদ তৈরি করেছেন, এটুকুই আমার দৌড়। কিন্তু যেই মুহূর্তে হাতে এল আ হিস্ট্রি অব ক্যালকাটা’স স্ট্রিটস (১৯৮৭), এই রবীন্দ্র সরোবর মেট্রো স্টেশন, টালিগঞ্জ ফাঁড়ি, পঙ্কিল খাল সব মিলিয়ে গেল সামনে থেকে। ভেসে উঠল ইরান থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে আগত দূতদের থাকার বাড়ি, টিপুর বংশধরদের তৈরি একাধিক প্রাসাদ। সেই রসা রোড থেকে নবীনা সিনেমা আর ওই দিকে মুদিয়ালি পর্যন্ত কর্ণাট থেকে আগত লোকজনের বসবাসের চিহ্ন। কোম্পানির নানা স্তরের চাকুরে আর ইউরোপ থেকে আগত পর্যটকদের ডায়েরি, চিঠিপত্র, দস্তাবেজ ঘেঁটে বার করা আইনি নথি আর ব্যবসায়িক লেনদেনের কাগজ— এই সব দিনের পর দিন ঘেঁটে থাঙ্কাপ্পান নায়ার শহরের চাপা পড়া ইতিহাস খুঁজে বার করেন, যে ইতিহাসের কোনও চিহ্ন আজ দেশপ্রাণ শাসমল রোড, প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোড বা প্রিন্স গোলাম মহম্মদ শাহ রোডে খুঁজে পাওয়া যায় না। মনে রাখতে হবে যে, এটা শুধু কোন রাস্তা কার নামে নামাঙ্কিত, কেবল এর তালিকা নয়। মহাফেজখানায় বসে দিনের পর দিন মাসের পর মাস যাবতীয় দস্তাবেজ থেকে কোনও একটি নির্দিষ্ট রাস্তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সমস্ত তথ্যের সমাহার। আর এই বইতে ২০০০টিরও বেশি রাস্তার নামকরণের ইতিহাস রয়েছে।
একক চেষ্টায় এমন একটি এনসাইক্লোপিডিয়া তৈরি একমাত্র কোনও জিনিয়াসের পক্ষেই সম্ভব। আর শুধু তো এইটি নয়। বাঙালি জাতিসত্তার প্রবল দাপটে যে ইতিহাস ম্লান হয়ে গেছে আজ, অথচ কলকাতার নির্মাণে ও গড়ে ওঠায় যে দক্ষিণ ভারতীয় প্রাদেশিক ভাষিক গোষ্ঠীগুলির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যারা ‘সাউথ ইন্ডিয়ান’ নামে তাদের বিভিন্নতা খুইয়ে বসেছে, সেই কন্নডিগা, কোঙ্কনি, মালয়ালি, তামিল ও তেলুগুদের ইতিহাস উদ্ধারের জন্য সাউথ ইন্ডিয়ানস ইন কলকাতা (২০০৪) বইটি প্রায় একমাত্র সূত্র এখনও পর্যন্ত। এই বইয়েরই শেষ অংশে টিপু সুলতানের বংশলতিকা। কে কবে কোন বাড়ি তৈরি করলেন, ক’কাঠা ক’ছটাক জমি, কে মাসোহারা বাড়াতে কোম্পানিকে কোন চিঠি লিখলেন, মাসোহারা জমিয়ে কী ভাবে গোলাম মহম্মদ শাহ তৈরি করে ফেললেন দুটো মসজিদ আর একটা ইমামবাড়া, মেমরা চায়ের নিমন্ত্রণে এসে শরিফ জেনানাদের দারিদ্রের মধ্যেও উচ্চ আদব কায়দা বজায় রাখতে দেখে চোখের জল ফেলে কী বলেছিলেন, আনোয়ার শাহ বর্মা থেকে টিক আমদানি করে কত টাকা রোজগার করতে পারলেন, টিপুর কোন নাতনির সঙ্গে আর এক নামজাদা শরিকের বিয়ে হল, তিনি কলকাতা মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান হলেন আর একটা রাস্তার নাম সেই নাতনির নামে হয়ে গেল আঞ্জুমান আরা রো, এই সব।
থাঙ্কাপ্পান নায়ার ১৯৫৫ সালে কেরলের এর্নাকুলামের মঞ্জাপ্রা গ্রাম থেকে হাওড়ায় এসে পৌঁছন, বয়স ২২। এখানে ওকালতি পাশ দেওয়ার পর তিনি মাসে ১২৫ টাকায় টাইপিস্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন। তার পর অ্যানথ্রোপলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া-য়। মাস মাইনে সেই জমানায় ৩৫০ টাকার মতো। কিন্তু তত দিনে থাঙ্কাপ্পানের প্রাণে-মনে শুধুই কলকাতা। তিনি সরকারি চাকরি ছাড়েন। মহাফেজখানা হয়ে যায় তাঁর বসতবাড়ি। ব্রিটিশ কলোনির মূল শহর কলকাতার যে দিকগুলি তখনও ইতিহাসবিদদের অনুধ্যানের বিষয় হয়ে ওঠেনি, সেগুলির সন্ধান তিনি শুরু করেন পুরনো, কীটদষ্ট, ঝুরঝুরে বইয়ের মধ্যে। কলকাতার লাইব্রেরি (২০১২), পুলিশি ব্যবস্থা ও (২০০৭), কর্পোরেশন (১৮৯৮) ছাপাখানার শুরুয়াত (১৯৮৭), মহাবিদ্রোহের আগে পর্যন্ত ব্রিটিশ সামাজিক জীবন (১৯৮৩) পানশালা সবের এক অনুপুঙ্খ ইতিহাস উঠে এসেছে একের পর এক বইয়ে। এ ছাড়াও তাঁর নানাবিধ উৎসাহের সূত্র পাওয়া যায় পিকক: দ্য ন্যাশনাল বার্ড অব ইন্ডিয়া (১৯৭৭), দুই খণ্ডে দ্য ম্যাঙ্গো ইন ইন্ডিয়ান লাইফ অ্যান্ড কালচার (১৯৯৬-৯৭) বইয়ে।
থাঙ্কাপ্পান নায়ারের বিশেষ কৃতিত্ব গ্রন্থপঞ্জি নির্মাণে। কলকাতার ৩০০ বছর উদ্যাপনে বেরিয়েছিল সুবৃহৎ ক্যালকাটা টারসেন্টেনারি বিব্লিয়োগ্রাফি (১৯৯৩), যা এক বিপুল তথ্যের সমাহার। ব্রিটিশ আমলে কলকাতায় আগত পর্যটকদের বয়ানগুলিকে নানা লাইব্রেরি ও ব্যক্তিগত সংগ্রহের দুষ্প্রাপ্য বই থেকে তিনি উদ্ধার করে একত্র করেন তিন খণ্ডে, ব্রিটিশ কলকাতাকে বুঝতে। এ ছাড়াও যাঁদের জীবনের রূপরেখা-সহ থাঙ্কাপ্পান নায়ার সাহিত্যের দিকটি উদ্ধার করে জনসমক্ষে আনেন, তাঁদের অনেককেই সাহিত্যিক হিসেবে আজও পড়া হয়নি। সেখানে থাঙ্কাপ্পান নায়ারের বিবেচ্য থাকে তাঁদের চোখে ভারত ও কলকাতা যেমন উঠে এসেছে সেই রূপটি দেখানো। ‘দ্য জার্নাল অব দ্য এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল’-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক জেমস প্রিন্সেপ যিনি খরোষ্ঠী ও ব্রাহ্মী লিপির পাঠোদ্ধার করেন, একাধারে বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, স্থপতি এবং জলরং ও লিথোগ্রাফে পারদর্শী, তাঁর নানা শাখার গুরুত্বপূর্ণ লেখাগুলি (১৯৯১)। জেমস অগাস্টাস হিকির বেঙ্গল গেজেট থেকে নানা গুরুত্বপূর্ণ সূত্র (২০০১)। “পেশায় প্রকাশক, ইচ্ছে করলে শস্ত্রধারী ডাক্তার, আর হৃদয়ে সাংবাদিক”, এই ভাবে হিকি-র বর্ণনা দেন থাঙ্কাপ্পান। ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরির (ন্যাশনাল লাইব্রেরি) মূল গ্রন্থাগারিক (১৯১১-১৯৩০) জন আলেকজ়ান্ডার চ্যাপম্যানের জার্নাল, ইংরেজি ও বাংলা কবিতা বিষয়ে লেখা ও বাংলা ভক্তিগীতি সংগ্রহ (২০০৪) ইত্যাদি।
এই বিপুল রসদ ভান্ডার নির্মাণ করলেও থাঙ্কাপ্পান নায়ার ঠিক ইতিহাসবিদ কি না, গ্রন্থপঞ্জি নির্মাণ আর অন্যদের লেখার সংগ্রহ তৈরি করাকে ঠিক ততখানি বিদ্যাচর্চা বলা যায় কি না, এই সব তর্ক চলতেই থাকে। গায়েগতরে খেটে তৈরি করা সঙ্কলনের থেকে আখ্যানধর্মী ইতিহাসের ধারণাগত ও তাত্ত্বিক আলোচনার মান অনেকের কাছে অনেক বেশি। তা ছাড়া, সূত্র হিসেবে ইংরেজিতে প্রাচ্যবাদী উপনিবেশবাদী লেখার উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল একটি তথ্য-সংস্থান কী ভাবেই বা কলকাতার বহুস্বরবাদী ইতিহাসের ধারণা দিতে পারে? এর অবস্থান তো পূর্বাহ্ণেই আত্ম-অপরে বিভক্ত ও ‘হেজিমনিক’। শিবনাথ শাস্ত্রী থেকে অমৃতলাল বসু, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত থেকে শ্রীপান্থ, রোজনামচা, আত্মজীবনী, ব্রিটিশ আর্কাইভের সঙ্গে বাংলায় ছাপা নানা সূত্র মিলিয়ে এবম্বিধ অসংখ্য উৎস যদি থাঙ্কাপ্পান নায়ার তাঁর আর্কাইভ নির্মাণে ব্যবহার না করেন, সে যতই তথ্যনিষ্ঠ হোক, তাঁর সংগ্রহও তো তবে ঔপনিবেশিক মূল্যবোধ বহন করে। আর যদি আর্কাইভই তাঁর মূল সূত্র হয়, তাঁকে কোন যুক্তিতে ডাকা হয় ‘খালি পায়ে হাঁটা ইতিহাসবিদ’ বলে? সে কি তিনি বিদ্যায়তনিক প্রাতিষ্ঠানিকতায় বসে কাজ করেননি বলে?
এত সব প্রশ্নের পরও থাঙ্কাপ্পান নায়ারের ঐতিহাসিক গুরুত্ব কমে না। বিশেষত যারা গত দশ বছরের বেশি সময়টাই ‘দুষ্প্রাপ্য’ বইয়ের সন্ধানে কলকাতা ও ঢাকার লাইব্রেরিগুলি চষে বেরিয়ে হতোদ্যম, তারাই জানে আর্কাইভে বা লাইব্রেরিতে একটা নতুন তথ্য বা একটা ছেঁড়াখোঁড়া বই পেলে তাকে জনসমক্ষে নিয়ে আসাটা ইতিহাসের পুনরুদ্ধারের জন্য কতখানি জরুরি। যখন সারা পৃথিবীতে সমস্ত তথ্য ডিজিটাইজ়ড আর্কাইভে মুক্ত ও সহজলভ্য, আমাদের চার পাশের দুনিয়ায় কেউ যাতে লাইব্রেরি থেকে ‘ধনরত্ন’ হাতিয়ে অর্থকরী ভেঞ্চারে না নেমে পড়েন, এই শঙ্কায় এখানে ৫ পাতার বেশি ছবি তোলা মানা। অন্য সময় হাজার আকুতি সত্ত্বেও বই খোঁজার লোক মেলে না, এ দিকে পাশে দাঁড়িয়ে শ্যেনদৃষ্টিতে পাহারা চলে যাতে চৌর্যবৃত্তি করে ১৮৫৬ সালে ছাপা কোনও বটতলা দোভাষী পুঁথির এক পাতা অতিরিক্ত ছবি কেউ তুলে না বসে। এই দুনিয়ায় আমাদের সম্বল থাঙ্কাপ্পান নায়ারের বইগুলি।
দ্বিতীয়ত, যেমন আজ উইলিয়াম জোনসের লেখাকে শুধু প্রাচ্যবাদের আলোয় না দেখে তাঁর মধ্যে বিশ্বসাহিত্যের সন্ধান চলে, সে রকম অনেক নতুন দিকচিহ্নই খুলে যেতে পারে থাঙ্কাপ্পান নায়ারের গ্রন্থাবলিতে প্রাপ্ত ভাষ্য ও কাব্য থেকে। থাঙ্কাপ্পান নায়ারের গ্রন্থ থেকে পাওয়া তথ্য ধরে প্রাপ্ত কলকাতার ইতিহাসকে বি-উপনিবেশিত করার দায়িত্ব পরের প্রজন্মের গবেষকদের। তাঁর কাজ আজকের গবেষককে পথে নামিয়ে দিতে পারে কলকাতাকে পথে হেঁটে হেঁটে শুনতে ও দেখতে শেখার জন্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy