বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ফাইল ছবি।
সেটাও ছিল শুক্রবার, অকালবৃষ্টিস্নাত কলকাতার সকাল, ১০০ বছর আগে। কলকাতায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত তখনও শুকোয়নি। লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়াতে গণ-অভ্যুত্থান, ভারতে ব্রিটিশবিরোধী ও অসহযোগ আন্দোলন, তুরস্কে মুস্তাফা কামাল পাশার প্রজাতন্ত্র গঠনের লড়াই পরাধীন বাঙালিদের আলোড়িত করছে। বাইশ বছরের নজরুলের মনে তার ছায়া পড়ছে। কয়েক বছর আগেই নজরুল সেনাবাহিনীর বাঙালি পল্টনের চাকরি ছেড়ে কলকাতায় এসেছেন। ঠিক সেই সময়ে বাংলা সাহিত্যে এক বিস্ফোরণ ঘটল। সাপ্তাহিক পত্রিকা বিজলী-তে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশিত হল। সালটা ছিল ১৯২২, ৬ জানুয়ারি: ২২ পৌষ, ১৩২৮ বঙ্গাব্দ। মুজফ্ফর আহমদের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, সেই সময় পত্রিকাটির এত চাহিদা হয়েছিল যে, সেই সপ্তাহে দু’বার ছাপতে হয়েছিল। অনুমান করা যায়, প্রায় দু’লক্ষ মানুষ কবিতাটি পড়েছিলেন।
প্রেমেন্দ্র মিত্র বলছেন, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত একটি কাগজ কোথা থেকে কিনে তীব্র উত্তেজনায় তাঁর ঘরে ঢুকে কাগজটা সামনে মেলে ধরে পড়তে বলেছিলেন। চার পয়সা দামের কাগজটি কেনার জন্য শহরে হুড়োহুড়ি পড়ে। ঘরে-বাইরে, মাঠে-ঘাটে-রাজপথে-সভায় এ কবিতা উচ্চৈঃস্বরে আবৃত্তি করা হয়। কবিতাটি লেখা হয়েছিল এর দিন দশেক আগে। তখন নজরুল ও মুজফ্ফর আহমদ থাকেন ৩/৪-সি, তালতলা লেন-এর বাড়িতে, নীচের তলার দক্ষিণ-পূর্ব কোণের ঘরটিতে।
‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি ছয় মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দে লেখা। অতিমাত্রার ব্যবহারে মুক্তবদ্ধ কবিতা। মুজফ্ফর আহমদ বলছেন, দোয়াতে কলম ডোবাতে গিয়ে তিনি মাথার সঙ্গে হাতের তাল রাখতে পারবেন না ভেবেই নজরুল সম্ভবত কবিতাটি প্রথমে পেনসিলে লিখেছিলেন। একটু বেলা হতে ওই বাড়িতে আসেন মোসলেম ভারত পত্রিকার আফজালুল হক। নজরুল তাঁকে কবিতাটি পড়ে শোনান। তিনি শুনে হইচই শুরু করে দেন এবং কবিতাটি নিয়ে যেতে চান। তার বেশ কিছুক্ষণ পরে এলেন বিজলী পত্রিকার ম্যানেজার অবিনাশ ভট্টাচার্য। তিনিও কবিতাটি চান। নলিনীকান্ত সরকার সম্পাদিত ১৯২০ সালে প্রথম প্রকাশিত সাপ্তাহিক পত্রিকাটিতে প্রকাশিত হল সেটি। কারণ, আফজালুল হক মোসলেম ভারত-এর যে কার্তিক সংখ্যার জন্য নিয়েছিলেন, সেই সংখ্যাটি প্রকাশিত হয় ১৩২৮ সালের ফাল্গুন মাসে। এ ছাড়াও, ‘বিদ্রোহী’ প্রবাসী পত্রিকার ১৩২৮ সালের মাঘ এবং সাধনা পত্রিকার ১৩২৯ সালের বৈশাখ সংখ্যায় এবং ধূমকেতু পত্রিকায় ১৯২২-এর ১১ অগস্ট সংখ্যায়, তার পর বসুমতী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। একটি কবিতা এত বার পুনর্মুদ্রণের ঘটনা সুলভ নয়।
‘বিদ্রোহী’ সেই সময় যুব সম্প্রদায়ের আশা, আকাঙ্ক্ষা, ব্যথা, নিরাশার মধ্যে প্রাণশক্তির সঞ্চার করেছিল, ইংরেজ-বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির মনোবল নাকি এই কবিতা বাড়িয়ে দিয়েছিল, তা হয়ে উঠেছিল বিপ্লবীদের গুপ্তমন্ত্র। তখন মধ্য গগনে রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রবলয়ের মধ্যে বাংলা কবিতা ঘোরাফেরা করছে। নজরুল রবীন্দ্রবৃত্ত থেকে বেরিয়ে সম্পূর্ণ নতুন এক কাব্য ধারার সূচনা করলেন। স্বভাবতই প্রশংসার পাশাপাশি কবি ঈর্ষা, আক্রোশ, বিদ্বেষও পেতে থাকলেন। নজরুল এবং মুজফ্ফর সাহেবের ঘনিষ্ঠ কবি মোহিতলাল মজুমদার দাবি করলেন, মানসী পত্রিকায় ১৩২১ সালের পৌষ সংখ্যায় প্রকাশিত তাঁর ‘আমি’ শীর্ষক একটি গদ্যরচনা থেকে চুরি করে এই কবিতা লিখেছেন, যা নজরুলকে তিনি বছরখানেক আগে শুনিয়েছিলেন, এবং তার জন্য নজরুল কোনও ঋণ স্বীকারও করেননি। উল্টো অভিযোগ ওঠে, মোহিতলাল মজুমদারের প্রবন্ধটি ক্ষেত্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভয়ের কথা গ্রন্থের মর্মার্থ চুরি করে লেখা, ঋণ স্বীকার ছাড়াই। কবি সজনীকান্ত দাস ‘বিদ্রোহী’কে ব্যঙ্গ করে ‘ব্যাঙ’ নামক প্যারডি লিখলেন, ছাপা হল শনিবারের চিঠি-তে। কবি গোলাম মুস্তাফা সওগাত পত্রিকার ১৩২৮ সালের মাঘ সংখ্যায় নজরুলকে তীব্র সমালোচনা করে উপদেশ দেওয়ার ছলে পরিহাস করে ‘বিদ্রোহী’-র নকলে ছয় মাত্রার মাত্রাবৃত্তে লিখলেন ‘নিয়ন্ত্রিত’ শীর্ষক কবিতা। এর কিছু দিন পরে শুরু হল নজরুলের বিরুদ্ধে মৌলবাদী আক্রমণ। ইসলাম দর্শন পত্রিকার সম্পাদক আব্দুল হাকিম ১৩২৯ সালের কার্তিক সংখ্যায় কুৎসিত ভাষায় লিখলেন ‘বিদ্রোহদমন’ কবিতা। গোলাম হোসেন একই পত্রিকায় অগ্রহায়ণ ১৩২৯ সংখ্যায় লিখলেন ‘প্রলয়ের ভেরি’ নামের তীব্র গালাগালি করে আর একটি কবিতা। আবার অনেক কবি সাহিত্যিক কবিতাটির অকুণ্ঠ প্রশংসা করেন, যেমন প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, বুদ্ধদেব বসু।
১৯৪২ সালে কবি বাক্শক্তি হারান। কাজী সব্যসাচীর মেয়ের সাক্ষাৎকার থেকে জানতে পারি, কাজী সব্যসাচী অসুস্থ, বাক্রুদ্ধ কবির সামনে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার আবৃত্তি প্রায়ই করতেন। আর কবির চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠত, যেন বলছেন, “বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy