Advertisement
০৫ ডিসেম্বর ২০২৪
Labour market

কেন মজুরি ফাঁকি, প্রশ্ন উঠুক

নজর করলে বোঝা যায় যে, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে দুশ্চিন্তায় ফেলার মতো বিপুল সংখ্যক নারী, কর্মী-বাহিনী তথা শ্রমবাহিনীতে উপস্থিতই নেই।

—প্রতীকী ছবি।

উর্বা চৌধুরী
শেষ আপডেট: ১৫ জুন ২০২৪ ০৮:১৮
Share: Save:

কোন কাজ ‘কাজের কাজ’, আর কোন কাজ মোটে ‘কাজ নয়’, সে সম্পর্কে বোঝাপড়া তৈরি করতে ‘রোজগার’ শব্দটা বেশ খানিকটা কম্পাসের কাজ করে। প্রশ্ন হল, কাজ মানে কী, কারা কাজ করে বা করে না, আর কারা রোজগার করে বা করে না?

২০১৭-১৮ সাল থেকে এ-দেশে ‘পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে’ (পিএলএফএস) নামক একটি সমীক্ষার কাজ শুরু হয়েছে, যাতে ‘শ্রমবাহিনী’ বলতে বোঝানো হচ্ছে গোটা কর্মী-বাহিনী অর্থাৎ যাঁরা কাজ করছেন তাঁদের (এমপ্লয়েড), এবং যাঁরা কোনও কাজে যুক্ত না হয়ে থাকলেও, কাজ খুঁজছেন বা কাজ করতে প্রস্তুত আছেন তাঁদের (আনএমপ্লয়েড)। এর বাইরে যে জনসংখ্যা রয়েছে তা হল শ্রমবাহিনী-বহির্ভূত (আউট অব লেবার ফোর্স)— এঁরা কোনও কাজে যুক্তও নন, কাজ খুঁজছেনও না, কাজের জন্য প্রস্তুতও নন। সমীক্ষার সংজ্ঞায় ‘কাজ’ মানে হল ‘আর্থিক কার্যকলাপ’।

শ্রমবাহিনীর মধ্যে কর্মী-বাহিনীর তিনটি রকম— ১) স্বনিযুক্ত (সেলফ এমপ্লয়েড), ২) অস্থায়ী শ্রমজীবী (ক্যাজুয়াল লেবার), ৩) নিয়মিত মজুরি বা বেতনপ্রাপক কর্মী। ‘স্বনিযুক্ত’ বিভাগটির দু’টি উপ-বিভাগ। নিজ-মালিকানার আর্থিক উদ্যোগে যুক্ত কর্মী, আর পারিবারিক আর্থিক উদ্যোগে উপার্জনহীন সহায়ক। এই দ্বিতীয় উপ-বিভাগের কর্মীরা পারিবারিক আর্থিক উদ্যোগে যুক্ত হয়ে পূর্ণ বা আংশিক সময় কাজ করেন, কিন্তু সেই কাজের বিনিময়ে বেতন বা মজুরি পান না। ২০২২-২৩’এ ‘শ্রমবাহিনী’-তে যোগদানের হার ৮৩.২% (পুরুষ) ও ৩৯.৮% (নারী), যা পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে ৮৭% (পুরুষ) ও ৩৬.৯% (নারী)। এই শ্রমবাহিনীর মধ্যে দেশের গড় কর্মী-সংখ্যার অনুপাত ৮০.২% (পুরুষ) ও ৩৮.৫% (নারী), পশ্চিমবঙ্গে— ৮৪.৮% (পুরুষ) ও ৩৬.১% (নারী)।

নজর করলে বোঝা যায় যে, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে দুশ্চিন্তায় ফেলার মতো বিপুল সংখ্যক নারী, কর্মী-বাহিনী তথা শ্রমবাহিনীতে উপস্থিতই নেই। কিন্তু যে নারীরা কর্মী-বাহিনীতে আছেন, তাঁরা কারা, তাঁদের খাটনি এবং খাটনির মজুরির ধারা কেমন, তা দেখতে গিয়ে চোখে পড়ে এক আশ্চর্য মজুরি-ফাঁকির কাহিনি। দেখা যায়, কর্মী-বাহিনীর স্বনিযুক্তদের দ্বিতীয় উপ-বিভাগে, অর্থাৎ রোজগারের বা উৎপাদনের কাজে পারিবারিক উদ্যোগে উপার্জনহীন ভাবে সহায়কের কাজে যুক্ত বিরাট সংখ্যক নারী-কর্মী। ২০১৭-১৮ সালে দেশে এঁরা ছিলেন গোটা নারী কর্মী-বাহিনীর ৩১.৭%, ২০১৮-১৯ সালে ৩০.৯%, ২০১৯-২০ সালে ৩৫%, ২০২০-২১ সালে ৩৬.৬%, ২০২১-২২ সালে ৩৬.৭% এবং ২০২২-২৩ সালে ৩৭.৫%। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে: ২০১৭-১৮ সালে ১৩.৮%, ২০১৮-১৯ সালে ১৫.৬%, ২০১৯-২০ সালে ১৭.৩%, ২০২০-২১ সালে ১৮.১%, ২০২১-২২ সালে ২০.২% এবং ২০২২-২৩ সালে ২৩.৩%। গত ৬ বছরে স্পষ্ট, কী বিরাট সংখ্যক নারী সরাসরি দেশের উৎপাদন বা আর্থিক কার্যকলাপের সঙ্গে কর্মী হিসাবে যুক্ত থেকেও ‘বেরোজগার’। এঁরা পারিবারিক উদ্যোগে স্ব-নিযুক্ত কর্মী হয়েও ‘মালিক’ নন, এঁদের নামে মালিকানা নেই বলে এই উদ্যোগগুলির উপার্জন মোটেই এঁদের নয়, আবার পারিবারিক উদ্যোগে যুক্ত কর্মী হওয়ায় এঁরা ‘মজুর’-ও নন, তাই মজুরি বা বেতন নেই। বাইরের কর্মী এঁদের কাজটি করলে কিন্তু সেই কর্মীকে মজুরি দিতে হত।

সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান দু’টি প্রশ্ন তুলছে। এক, রোজগারই না থাকলে এঁরা ‘এমপ্লয়েড’ কেন? দুই, এঁরা ‘এমপ্লয়েড’ হলে রোজগার কেন নেই? প্রথম প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, এই বেরোজগার নারী-কর্মীদের গুনে নিতে পারলে বেকারত্বের হার দারুণ ভাবে কমিয়ে দেখানো যাচ্ছে। দ্বিতীয় উত্তরটির খোঁজ আছে লিঙ্গ-রাজনীতির সঙ্গে শ্রেণিশোষণের চিরায়ত যোগে।

ইতিমধ্যে শাপে বর হয়েছে গঞ্জনা। ক’দিন আগেও রোজগেরে নারী ছিল চক্ষুশূল, ‘ঘরের বাইরে চরে বেড়ানো মেয়েমানুষ’! আর আজ তাঁর কর্মসংস্থানের প্রশ্নেই মুখর হচ্ছে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ! মহিলাদের সরাসরি অর্থ দেওয়ার যোজনা নিয়ে সমাজের একাংশের যে রকমারি গঞ্জনার ইট-পাটকেল পড়ছে প্রাপকদের প্রতি, তার মধ্যে সবচেয়ে দাপুটে পাটকেল দু’টি হল, ‘ফ্রিতে পাওয়া টাকা’, ‘ভিক্ষা’। মজার কথা হল, এই দাপুটে সমাজই দশকের পর দশক অনায়াসে কাটিয়ে দিয়েছে পরিবারের রোজগার সম্বন্ধীয় কাজে যুক্ত বিরাট সংখ্যক মহিলার গতরের খাটনির বিনিময়ে ‘প্রাপ্য মজুরি’ ফাঁকি দিয়ে।

তবে কথাটা যখন উঠেছে, আলোচনা খোলাখুলি হওয়া দরকার। যে বিরাট সংখ্যক নারী-কর্মী পারিবারিক রোজগারের কাজে, উৎপাদনের কাজে শ্রমশক্তি ব্যয় করেছেন, বদলে মজুরি পেয়েছেন ‘শূন্য’, তাঁরা তাঁদের মজুরি কী হিসাবে, কবে থেকে বুঝে পাবেন, তা নিয়ে এ বার স্পষ্ট মুখ খুলতে হবে। আর কল্যাণকর রাষ্ট্রের জটিল অর্থনীতিতে কাকে বলে ‘ভিক্ষা’, তা এক তুড়িতে বুঝে যাওয়া, অথচ দশকের পর দশক ‘মজুরিবিহীন গতরের খাটনি’-র মানে না-বুঝতে পারা সমাজকেও এ বার কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় দিতে হবে। দেখতে হবে যাতে বিপুল সংখ্যক মহিলাকে উপার্জনকারী কর্মী-বাহিনীর বাইরে থাকতে না হয়।

কাজের বাজারে নারীর শ্রমের সুযোগ, ন্যূনতম আয় নিশ্চিত করা, এবং ভর্তুকি বাবদ মেয়েদের সরাসরি অর্থ পাওয়াকে অধিকার হিসাবে আইনি স্বীকৃতি দান অত্যন্ত জরুরি, যাতে এই ভাতার ধারাবাহিকতা কোনও শাসকের ইচ্ছা-অনিচ্ছার মুখাপেক্ষী না হয়, বা এই টাকা কোন খাত থেকে আসছে, তা নিয়ে টালবাহানা না চলে, সর্বোপরি বাজেটের এই সব প্যাঁচের দায় প্রাপক মহিলাদের ঘাড়ে চাপিয়ে কেউ চড়াও না হতে পারে।

এই লেখায় কেবল পারিবারিক আর্থিক কার্যকলাপে নারী-কর্মীদের বিরুদ্ধে ঘটে চলা শ্রমচুরি ও আয়-ফাঁকির বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। নিত্য দিনের ‘গৃহকাজ’-এ নারীর শ্রমশক্তি, দেশের আর্থিক কার্যকলাপের সঙ্গে তার যোগ, বা সেই খাটনির মজুরি প্রসঙ্গে একটি শব্দও ব্যয় করা হয়নি, তা করলে এই রাষ্ট্র এবং পিতৃতান্ত্রিক সমাজের লজ্জা বাড়বে বই কমবে না।

অন্য বিষয়গুলি:

Women Society
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy