Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪
তথ্যপ্রমাণে ভরসা থাকুক
coronavirus

তৃতীয় ঢেউয়ে শিশুদের বিপদ বেশি, এ কথা কত দূর বিজ্ঞানসম্মত

শিশু সংক্রমণের অযথা আতঙ্ক সামাজিক পরিমণ্ডলে আরও ভীতির সঞ্চার করবে। এ আলোচনা বন্ধ হোক সর্বস্তরে।

অভিজিৎ চৌধুরী এবং অরুণ সিংহ
শেষ আপডেট: ৩০ জুন ২০২১ ০৫:৪৬
Share: Save:

করোনার মেঘ এখনও কাটেনি। ঝড়বাদলের রাতে পাখির ডাক শুনলেও যেমন মনে হয় দত্যি-দানোর দাঁত কিড়মিড়, ঠিক তেমনই ভাল খবর এলেও এখন বুকটা কেঁপে ওঠে। আজকের সুখ কালকের অসুখের মাঠ তৈরি করছে না তো? সংক্রমিত ও মৃতের যে হিসেব সরকার দিচ্ছে, তা আমাদের করোনা-ক্লান্ত মনকে এই মুহূর্তে কিছুটা স্বস্তি দিলেও, সামাজিক অবসাদের সঙ্গে ঘর করতে করতে বুক ভরে নিশ্বাস নেওয়ার সাহসটা যেন আমরা ফিরে পাচ্ছি না। গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রথম ঢেউ, দ্বিতীয় ঢেউয়ে আমরা দোল খেয়েছি, ডুবেছি, ভেসেছি। উঁকি মেরে এখন যখন আশার আলো দেখার চেষ্টা চলছে, তখনই কানে এল নতুন শঙ্কার ভবিষ্যদ্বাণী— তৃতীয় ঢেউ এল বলে! তা নাকি আবার বাচ্চাদের পক্ষেই বেশি মারাত্মক। করোনা যেন এমন এক দৈত্য, যা প্রথমে মুড়িয়েছে পাকা মাথাগুলো; দ্বিতীয় দফায় তার লক্ষ্য ছিল সমাজের মাঝবয়সিরা; আর এর পরে ধরবে শিশুদের। শুনে আতঙ্কিত আমরা সবাই। প্রশ্ন হচ্ছে যে, এর পিছনে আদৌ বিজ্ঞানের কোনও হিসাবনিকাশ আছে? না কি এই আতঙ্কের পুরোটাই জল্পনা?

নির্বোধ আত্মতুষ্টি, বিজ্ঞানের বদলে বিশ্বাসের উপর ভর করেই দেশের পরিচালকেরা করোনা মোকাবিলায় নিতান্ত কিছু অগোছালো পদক্ষেপ করেছিলেন। ফলে দ্বিতীয় ঢেউয়ে নাকানিচোবানি খেতে হয়েছে দেশকে। বহু স্বজনকে হারিয়ে দেশ আবার গুটিগুটি পায়ে সামনের দিকে পথ হাঁটছে। পরিচ্ছন্ন বিজ্ঞান-ভাবনা ও সরকারি পদক্ষেপের স্বচ্ছতাই এখন পাথেয় হতে পারে। তার বদলে গনতকারের মতো কোন মাসে তৃতীয় ঢেউ উঠবে, কবেই বা তা বেছে বেছে বাচ্চাদের ঘাড় মটকাবে— এগুলো বলে যাঁরা আত্মতুষ্টি পাচ্ছেন, তাঁরা দেশের বিজ্ঞানকে আরও পিছনে ঠেলছেন।

মনগড়া কথা না বলে আমরা বরং কয়েকটা পরিসংখ্যান নিয়ে আলোচনা করতে পারি। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে প্রাপ্তবয়স্ক এবং ১০ থেকে ১৮ বছর বয়সিদের মধ্যে করোনাভাইরাসের অ্যান্টিবডিগুলি নিয়ে একটি দেশব্যাপী গবেষণা চালানো হয়েছিল। তাতে দেখা গিয়েছে যে, প্রাপ্তবয়স্ক এবং শিশু (১০ বছরের বেশি বয়স), উভয় জনসংখ্যারই প্রায় ২৫ শতাংশ সমান ভাবে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করেছিল। অর্থাৎ, শিশুরাও প্রথম তরঙ্গে বড়দের মতো সমান ভাবে সংক্রমিত হয়েছিল। কিন্তু তাদের লক্ষণগুলো অপ্রকাশিত ছিল। বিভিন্ন জৈবিক কারণে কোভিড-আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে কোনও লক্ষণই থাকে না, বা সামান্য লক্ষণ থাকে। ভারতে দ্বিতীয় তরঙ্গে শিশুরাও আক্রান্ত হচ্ছিল। হবে না-ই বা কেন? পরিবারের সকলের যদি কোভিড হয়, তা হলে শিশুরা রক্ষা পাবে, তা কি সম্ভব? যদি শিশু হাসপাতালগুলোতে দ্বিতীয় তরঙ্গের সময় ভিড় উপচে না পড়ে, তবে কেন এমন আশঙ্কায় ভুগব যে, না-দেখা তৃতীয় তরঙ্গে শিশু হাসপাতালগুলো উপচে পড়বে? বিজ্ঞানের সমস্ত তথ্য ও তত্ত্ব এর বিপরীতেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। দেশের মানুষকে আগাম বিপদের জন্য প্রস্তুত রাখতে হবে। কিন্তু তা যুক্তি ও তথ্যনিষ্ঠ হওয়া দরকার।

অবশ্যই মাথায় রাখা দরকার যে, করোনা এখনও চলে যায়নি। শৃঙ্খলার প্রতি আমাদের মজ্জাগত অশ্রদ্ধার ফাঁকফোকর দিয়ে করোনা আবার হানা দিতে পারে। গঙ্গায় ভেসে চলা লাশ, বা কাবেরীর জলে ভাসিয়ে দেওয়া স্বজন-পরিত্যক্ত করোনা-মৃতের অস্থিকলস প্রতি মুহূর্তে আমাদের এত দিনের করোনা মোকাবিলার পদ্ধতির অসততা, অস্বচ্ছতা আর দুর্বলতাকে স্পষ্ট করে দিচ্ছে।

এখনও পর্যন্ত এটা পরিষ্কার যে, করোনাভাইরাস নিজের থেকে মানুষের কোষের ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখে না। বরং মানবশরীরকে তার নিজেরই বিরুদ্ধে ব্যবহার করে। মানবশরীরের যে রোগপ্রতিরোধী শক্তি, যাকে ইমিউন সিস্টেম বলা হয়, তার নিজস্ব একটা ছন্দ রয়েছে। বাইরের রোগ-জীবাণুর আক্রমণের বিরুদ্ধে শরীরকে রক্ষা করার কাজ করে সাইটোকাইন নামক এক রাসায়নিক। এরা একটা নিয়ন্ত্রিত ও শৃঙ্খলাবদ্ধ ‘সিগন্যালিং’-এর মাধ্যমে কাজ করে। ভাইরাস এই সাইটোকাইনের সিগন্যালিংকেই এলোমেলো করে দেয়। বিশৃঙ্খল সাইটোকাইনগুলো তখন পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণ ভুলে শরীরের মধ্যে ছুটতে থাকে এক অঙ্গ থেকে অন্য অঙ্গে। এই ছোটার গতি ও বিস্তৃতি ভিন্ন ভিন্ন মানুষের শরীরে আলাদা হয়। একে বলা হয় সাইটোকাইন ঝড়, যার আঘাতে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কখনও কখনও বেশ বিপাকে পড়ে। মজার ব্যাপার হল, কারও ইমিউন সিস্টেম যথেষ্ট মজবুত না হলে ভাইরাসের খোঁচা খেয়ে এই প্রলয় নাচে দোলার ক্ষমতা শরীরের থাকে না। খেয়াল রাখা ভাল, জীবনের দ্বিতীয় দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত শিশুদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা পরিপক্ব হয় না। ফলে, বিজ্ঞানের কাণ্ডজ্ঞান বলছে যে, কোভিডে শিশুদের সাংঘাতিক অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ, পরিপক্ব ইমিউন সিস্টেম ছাড়া শরীরে এই ঝড় তুলবে কে?

অহেতুক ভয় পেয়ে লাভ নেই। বিজ্ঞানের যতটুকু খবর আমাদের কাছে আছে, সেগুলোকে যুক্তিযুক্ত ক্রমে গুছিয়ে নিতে হবে। তার সাহায্যেই বুঝতে হবে যে, ভবিষ্যতে নিরাপদ থাকার জন্য কী কী করা প্রয়োজন। ভাইরাসের গঠনগত ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে নিরন্তর বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান জারি রাখতে হবে; আবার মানুষকে বিধি-শৃঙ্খলা মেনে চলার জন্য ক্রমাগত সতর্ক করে যেতে হবে, দ্রুত সবার জন্য ভ্যাকসিনের ব্যবস্থা করতে হবে। এবং, নাগরিক বলতে যে শুধু আলোকপ্রাপ্ত মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে বোঝায় না, গ্রামের স্বল্পশিক্ষিত, দরিদ্র জনগোষ্ঠীকেও বোঝায়, তা স্মরণে রাখতে হবে।

জনসমষ্টির ঘনত্বের কারণেই করোনা যাত্রা শুরু হয়েছিল শহর থেকে। আমাদের অবিমৃশ্যকারিতা, মেলা-খেলা-নির্বাচনের হাত ধরে তা এখন গ্রামীণ ভারত ও বাংলার মাঠেঘাটে যথেষ্টই বেগবান। গ্রামের সংক্রমণের হিস‌াবনিকাশ, প্রকরণ বোঝার কাজ সুনির্দিষ্ট ভাবে এখনই করা দরকার। আর গ্রাম-সুরক্ষার কাজে শুধু সরকার নির্ধারিত মাইনে পাওয়া কর্মীদের উপর নির্ভর না করে, গ্রামাঞ্চলের অন্যান্য ক্রিয়াশীল ও সৃষ্টিশীল স‌ংস্থাকে কাজে লাগানো দরকার। মহিলা স্বনির্ভর দল, গ্রামীণ স্বাস্থ্যপরিষেবকরা এ কাজে সরকারি কর্মীদের সহায়ক হতে পারেন। প্রলম্বিত এ লড়াই কোনও এক জন বা একটি গোষ্ঠীকে দিয়ে হবে না। এ কাজ যদি আমরা এখনই না করতে পারি, তা হলে ধিকধিক জ্বলতে থাকা সংক্রমণের আগুন অচিরেই শহরে আসবে দাবানল হয়ে। আমরা তখন তাকে আবার একটা নতুন ঢেউ হিসেবে চিহ্নিত করব।

গাণিতিক কারসাজিতে ক্ষণিকের সাফল্য, আর তা থেকে উঠে আসা আত্মতৃপ্তি আমাদের ভুগিয়েছে। শিশু সংক্রমণের অযথা আতঙ্ক সামাজিক পরিমণ্ডলে আরও ভীতির সঞ্চার করবে। এ আলোচনা বন্ধ হোক সর্বস্তরে। প্রস্তুতি অবশ্যই থাক সব বয়সের জন্যেই। প্রাকৃতিক ভাবে প্রাপ্তবয়স্কদের মতো শিশুদেরও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়েছে। তৃতীয় তরঙ্গ এলে বড়দের মতো শিশুরাও কোভিড বাহক হতে পারে। সংক্রমণও ছড়াতে পারে। কিন্তু কোনও বিশেষ আনুপাতিক হারে নয়।

সচিব, লিভার ফাউন্ডেশন;
নবজাতক ও শিশু বিভাগ, এআইআইএমএস, জোধপুর

অন্য বিষয়গুলি:

coronavirus COVID19
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy